শেষ আপডেট: 30th January 2025 19:11
বিহঙ্গী বিশ্বাস
'দেয়ার ইজ নাথিং গুড অর ব্যাড, থিঙ্কিং মেকস ইট সো'-- হ্যামলেটে লিখেছিলেন শেক্সপিয়ার। ভাল আর মন্দের দ্বন্দ্ব সৌমিত্র-অপর্ণা না জানলেও, তার হিসেব না রাখলেও, ডিজিটাল যুগের কনটেন্ট ক্রিয়েটাররা সে বিষয়ে বেশ ওয়াকিবহাল। আর এই হিসেব কষতে গিয়েই কি ঘুচছে আগল? মধ্যবিত্ত বাঙালির বেডরুমের অন্তরঙ্গ দৃশ্য অথবা শাঁখা-পলা পরিহিতা বঙ্গললনার স্নান শেষের ভেজা শরীরই কি তবে জোগাচ্ছে ভিউ? নাকি তথাকথিত 'ভাল'র ছুঁতমার্গ ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্য আকাশে উড়াল দিচ্ছে তাঁদের স্বপ্নেরা?
অর্ণব চট্টোপাধ্যায় ও প্রিয়াঙ্কা চট্টোপাধ্যায়— ব্যক্তিগত সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী।রয়েছে এক সন্তানও। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই দম্পতি এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটার। তাঁদের টপিক কখনও শাশুড়ির কুসংস্কার, কখনও পুত্র-বিদায় আবার কখনও বা দজ্জাল শাশুড়ির কড়া নিয়ম। বৌমার চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা আর শাশুড়ির চরিত্রে খোদ অর্ণব। তাঁরা একটি ভিডিও করেন সম্প্রতি। সেখানেই একটি দৃশ্যে স্নান সেরে প্রিয়াঙ্কা বেরিয়ে এসেছেন গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে। শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলছেন ওভাবেই।
এখানেই উঠেছে প্রশ্ন, মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ের এমন টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে আসার দৃশ্য কি নেহাতই কন্টেন্টের জন্য, নাকি দর্শক টানার সেই অমোঘ ইচ্ছেই কাজ করে এর নেপথ্যে? পেশাদার অভিনেত্রী না হয়েও, লক্ষ লক্ষ দর্শকের সামনে সাহসি দৃশ্যে 'ভাল ইমেজ’ হারানোর ভয় তাড়া করে না? সোশ্যাল মিডিয়া ভর্তি ভালগার ও অতি নিম্নরুচির কনটেন্টের ভিড়ে মিশে যাওয়ার ভয়ও কি থাকে না?
সাবস্ক্রাইবার-দর্শকদের মধ্যে অনেকে ওই ভিডিওতে মন্তব্যও করেছেন এই নিয়ে। প্রশ্ন তুলেছেন, টাওয়েল পরা শরীর না দেখালেই কি চলছিল না?দ্য ওয়ালের বিশ্লেষণে উঠে এল সেই প্রশ্ন, দ্বন্দ্ব, আলোচনা। মন খুলে কথা বললেন অর্ণব-প্রিয়াঙ্কা।
চাঁপাডাঙার প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা প্রিয়াঙ্কার। পড়াশোনা দশম শ্রেণি পর্যন্ত। প্রথাগত অভিনয় শেখার সুযোগ তো দূরের কথা, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই ছিল কঠিন। অন্যের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করে প্রিয়াঙ্কাকে বড় করেছেন মা-দিদা।
প্রিয়াঙ্কা বললেন, 'যেটাকে লোকের এত সাহসি বলে মনে হচ্ছে, এত ছকভাঙা মনে হচ্ছে, আমার কাছে সেটা খুবই স্বাভাবিক। গ্রামের মেয়ে আমি। বিশ্বাস করুন, ছোট থেকে এটাই দেখেছি। স্নান করে গায়ে পেটিকোট জড়িয়ে বেরিয়ে আসছে মায়েরা। বাড়ির পাশে পুকুর ছিল। ছেলে-মেয়ে সবাই স্নান করত। মেয়েরা ডুব দিয়ে গায়ে কোনও মতে গামছা গায়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওইভাবেই বাড়ি ফিরত। তার শরীরের অর্ধেক অংশ দেখা গেলেও কিছু যেতে আসত না। হ্যাঁ, এখনকার সোশ্যাল মিডিয়ার দর্শকদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সেগুলো দেখেননি। তার মানে এটা তো নয়, যে এগুলো ঘটেনি বা ঘটে না। যা দেখেছি তাই তো তুলে ধরেছি। সাহসিকতা বা নোংরামি—আলাদা করে তাই কিছুই মনে হয়নি আমার।’
একই মত প্রিয়াঙ্কার স্বামী অর্ণবেরও। কনটেন্টের চিত্রনাট্য লেখা থেকে পরিচালনা—সব তাঁরই দায়িত্ব। তিনি বললেন, ‘শাশুড়ি-বৌমা বসে আছে। দু'জনেই মহিলা। পরিচালক হিসেবে মনে হয়েছে শাশুড়ির সামনে ওই পোশাকে বৌমার বের হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেক বেশি ন্যাচারাল। সে কারণেই রাখা। যদি শ্বশুর থাকতেন, তা হলে পোশাকও অন্যরকম হত।’
কন্টেন্ট ইজ দ্য কিং
আলোচিত এই কন্টেন্টের নাম 'উন্মাদ শাশুড়ি'। থাম্বনেলে তোয়ালে জড়ানো বৌমা। যদি মেনেও নেওয়া যায় ওই দৃশ্য শুধুমাত্র সেক অব কনটেন্ট, তবে তা থাম্বনেলে রাখা কেন? এটা কি সরাসরি ‘লোকটানা নয়’?
উত্তরে সোজাসাপটা অর্ণব। বললেন, ‘ভণিতা না করেই বলছি, আমরা সবাই এখানে ব্যবসা করছি। যে বলে, ভালবেসে কনটেন্ট বানাই, ডাহা মিথ্যে বলে। ওই ভালবাসার স্থায়িত্ব বেশিদিন নয়। আমরা জানি, যে থাম্বনেলে ওই ছবি দিলে মানুষ ঢুকবে বেশি। ভিউ বেশি হবে। মানুষ যদি ক্লিক নাই করে তাহলে তো কন্টেন্টের ভিতরের বার্তাও তাঁদের কাছে পরিষ্কার হবে না। এমন অনেক সময় হয়েছে, ওই ছবি দেখে ঢুকেছে। ক্লিক করে দেখেছে ভিডিওতে ওই দৃশ্য কেবল কয়েক সেকেন্ড।
তবে গোটা কনটেন্ট তাঁদের ভাল লেগেছে। সাবস্ক্রাইব করে রয়ে গিয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য সফল। সিটিআর বলে একটা কথা হয়েছে। ক্লিক থ্রু রেট। আমি যদি আর্থিকভাবে সফলই না হই, তাহলে তো কোনও লাভ হল না।’
কন্টেন্টের প্রভাব ব্যক্তিগত জীবনে পড়ে না? আশপাশের কানাঘুষো প্রভাবিত করে না?
প্রিয়াঙ্কার উত্তর, ‘হ্যাঁ, আলোচনা করে অনেকে। অনেক কিছু বলে। অনেকে হয়তো বাড়ি আসাও বন্ধ করে দিয়েছে। মনে করছে নোংরামি করছি। আমাদের খুব একটা যায় আসে না।’ অর্ণব যোগ করলেন, ‘আমরা অভিনেতা। মিডিয়োক্রিসির এই বেড়াজাল ভাঙাই আমাদের কাজ। নিজেদের ওই স্পেসটাতে তাই পিসিমা, মাসিমা বা আত্মীয়দের ঢুকতেই দিই না আমরা। এই বেশ ভাল আছি।’
প্রিয়াঙ্কা বা অর্ণব যে অনায়াস দক্ষতায় নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন আমজনতার দরবারে, টেলিভিশনের ধারাবাহিকে তা সম্ভব নয়। অথচ দুই ক্ষেত্রেই কনটেন্ট মোটের উপর এক। সেই দজ্জাল শাশুড়ি, সেই নিরীহ বৌমা, সেই রোম্যান্স বা পিতৃতন্ত্রের বেড়াজাল ভাঙা।
মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন তথা চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘আমি যখন টিভি দেখব তখন বাড়ির সবাই মিলে দেখব, কিন্তু ইউটিউবের ক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেকজন মিলে দেখছে তা কিন্তু সচরাচর ঘটে না। মানুষ একা দেখে। আর সেই কারণেই ইউটিউবেরা যা করার স্বাধীনতা পান। তা যদি টিভির পর্দায় দেখানো হয় তবে আলোড়ন ঘটবে। হইহই হবে। রিয়ালিস্টিক করতে গিয়ে যদি কী অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হচ্ছি, তা দেখিয়ে ফেলি, টিভির দর্শকরা ভালভাবে নেবেন না বলেই আমার মনে হয়। তবে স্নানপোশাক বা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যই মানেই যে অশ্লীল তা নয়! অনেকেই সাধারণ পোশাকেও নিজেকে এত বিজ্ঞাপিত করছেন যা দেখে হয়তো খানিক অশোভন লাগে।’
তিনজনে
সব মিলিয়ে কনটেন্টের অস্ত্রেও আগল ভাঙছে, সাহসী হচ্ছে মধ্যবিত্ত বাঙালি। ভালগারিটির ঊর্ধ্বে উঠে সামিল হচ্ছে সাবালকত্বের দৌড়ে। মনস্তত্ত্ববিদ রীমা চক্রবর্তীর কথায়, ‘এমনটা তো হওয়ারই ছিল। আমরা যত ডিজিটাল হচ্ছি, তত এক্সপোজার বাড়ছে। মানুষও নিজেকে এক্সপোজ করছে বা এক্সপ্লোর করছে। সে দেখছে, টাকা আসছে। তার টাকার দরকার। আর সেখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন কনটেন্ট। তবে একথা ঠিক, অশ্লীলতা আর সাহসিকতার ফাইন লাইনটা অনেকে গুলিয়ে ফেলছেন। যারা ফেলছেন না, তাঁরাই লংটার্মে টিকে যাচ্ছেন। যারা ফেলছেন, তাঁরা সাময়িক ভাবে ভিউ পেলেও অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছেন।’
এখানেই আলাদা হয়েছেন অর্ণব-প্রিয়াঙ্কা। হারিয়ে যেতে আসেননি তাঁরা। ছ’বছরের বিবাহিত জীবন, চার বছরের কেরিয়ার। ছোট্ট মেয়েটাকে যদিও এই সবের অংশ বানাতে চান না তাঁরা। আপাতত নিজেদের নিয়েই স্বপ্ন রয়েছে দু'চোখ জুড়ে। পরিশ্রমও চলছে প্রতিনিয়ত। ফলস্বরূপ নিন্দে করছে গাঁয়ের লোকে, সঙ্গে বিস্তর জমছে প্রশংসাও! সবকিছু গায়ে মাখা নিষেধ। কারণ, 'কুছ তো লোগ কহেঙ্গে...।'