শেষ আপডেট: 25th September 2023 09:16
নাটক - চিচিং ফাঁক
নাট্যদল - চার্বাক
সংলাপ সংগীত ও নির্দেশনা - অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়
শব্দ প্রক্ষেপণ - সব্যসাচী চক্রবর্তী ও গৌরব চক্রবর্তী
মঞ্চ - আদিত্য সেনগুপ্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায় না বলা সহজে…।” খুব কঠিন কথা, কঠিন পরিস্থিতি আমরা কিন্তু সহজ করে সবসময় বলতে পারি না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই সহজ ভাবে করে দেখিয়েছেন নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় (Chiching fank bengali drama review)।
লক্ষ্মীগড় গ্রামের অভিজাত বাড়ি নলিনী ভিলা। বাড়ির কর্তা সদাশিব, গিন্নি মন্দাকিনী আর তাদের একমাত্র মেয়ে কামিনী ওরফে খেঁদি। ধনী ব্যবসায়ী সদাশিবের গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় আছে। সরকারি অনুদান, মিড ডে মিল ছাড়াই চলে এই বিদ্যালয়। মিড ডে মিলের খিচুড়ি-ডিমের প্রলোভন না থাকলেও গ্রামের মেয়েদের প্রথম পছন্দ এই বিদ্যালয়। বিরল উদাহরণ গড়ে তুলতে পেরেছে সদাশিব। ভাঙতে পেরেছে সরকারি মিথ। কিন্তু মেয়ে খেঁদিকে নিয়ে সদাশিবের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। খেঁদির কথায় অন্ত্যজ শ্রেণীর টান, জংলির মতো আচরণ, পড়াশোনায় অমনোযোগী, একের পর এক প্রাইভেট টিউটর চলে যাওয়া থেকে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দেওয়াতে খেঁদির জুরি মেলা ভার। তাকে বাগে আনতে গৃহশিক্ষক হিসেবে আনা হয় এক তরুণকে, নাম পিনাকী। কিন্তু গৃহশিক্ষককে ভালবেসে ফেলে খেঁদি। সুদর্শন পিনাকী জামাই হিসেবেও মন্দ নয়। খেঁদির মা-ও তাকেই জামাই করতে উদ্যোগী। এভাবেই কমেডি মোড়কে এগোতে থাকে 'চিচিং ফাঁক' নাটকের চিত্রনাট্য।
'চিচিং ফাঁক' নাটকের সদাশিব চরিত্রটি করে থাকেন সঞ্জয় সরকার। কিন্তু এই প্রথম মধুসূদন মঞ্চে সদাশিবের চরিত্রে মঞ্চে আবির্ভূত হলেন নাট্যকার অরিন্দম গাঙ্গুলি নিজেই। অরিন্দম যেন এই নাটকের মূল আকর্ষণ। কমেডি নাটক পরিচালনা থেকে সংলাপ সঙ্গীত অভিনয়ে অরিন্দম অনবদ্য। কেন হবে না! অরিন্দম গাঙ্গুলি সেই শিশুবয়স থেকে বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কে নেই সেই তালিকায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়,জহর রায়,অনুপ কুমার বা রবি ঘোষ। মঞ্চে যখন অরিন্দম হাত পা নাড়িয়ে কমেডি করছিলেন তখন মনে পড়ে যাচ্ছিল অনুপকুমারকে। কমেডির আড়ালে ঘুণ ধরা সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন অরিন্দম সংলাপের পরতে পরতে। কমেডির ছলে সাহসী সংলাপের নাটক। মিড ডে মিলের লোভ দেখিয়ে শিক্ষা হয় না। মিড ডে মিল নিয়ে দুর্নীতিও কিছু কম হয় না। তারথেকে যদি ঐ পরিবারগুলোকে আর্থিক সুবিধে দেওয়া যায় তাহলে অনেক বেশি কাজের কাজ হয়। নাটকের নাম চিচিং ফাঁক কেন? সেটা নাটক যত এগোয় ততই বোঝা যায়।
নির্দেশক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় "বিশাল ধনরত্নের সন্ধান পেলে তুমি নিজেকে কতটা সংযত রেখে মানবধর্মে কাজে লাগাতে পারবে সেটাই হচ্ছে বড় কথা। আলিবাবা অতুল ঐশ্বর্য দেখেও লোভের বশবর্তী হয়নি। যার ফলে গুহা থেকে বেরোনোর 'চিচিং ফাঁক' মন্ত্রটা আলিবাবা ভুলে যায়নি। কিন্তু তাঁর ভাই কাসেম লোভে পা দিয়েছিল বলেই ডাকাতদের হাতে গুহার মধ্যে নিহত হয়। নাটকে এই লোভ জিনিসটা প্রতীকী ভাবে ফুটে উঠছে। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু আজও ঘটছে। আমি মনে করি লোভের বশবর্তী হলে মানুষ মানবিকতার মন্ত্র ভুলে যায়। এই নাটকের মূল বক্তব্য যুগে যুগে ঘটছে। তাই প্রতিটি সংলাপ ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক।"
সদাশিবের স্ত্রীর চরিত্রে সুস্মিতা বসু বেশ চমৎকার কমেডি অভিনয় করে গেছেন। সদাশিব আর মন্দাকিনীর স্বামী-স্ত্রীর রসায়ন দুর্দান্ত। ততটাই মন ভরিয়েছে নবীন জুটি পিনাকী আর খেঁদি। পিনাকীর চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় নজর কাড়ল। স্পষ্ট উচ্চারণ, স্মার্ট বাচনভঙ্গী ও দক্ষ অভিনয়ে নাটকের রাশ টেনে রেখেছিলেন কৌশিক। অরিন্দম গাঙ্গুলির মতো নায়ক গায়ক নাটকে থাকলেও কৌশিকের খালি গলায় গান বেশ লাগে শুনতে। কৌশিক লম্বা দৌড়ের ঘোড়া বোঝাই যায়। আর যে চরিত্রের কথা উল্লেখযোগ্য সে খেঁদি স্বপ্নেশা চক্রবর্তী। এক নবীনা অভিনেত্রীর প্রাণচঞ্চল অভিনয় মঞ্চ ভরিয়ে রাখে। চার্বাকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অভিনেতাদের সঙ্গে কী সুন্দর যোগ্য সঙ্গত দেন স্বপ্নেশা! খেঁদি যে আসলে জংলি নয় সে জংলি সেজে থাকে বড় উদ্দেশ্যে, সেটা বড় চমক এই নাটকের। সঠিক কাজ হল, সমাজে শ্রেণীবৈষম্য দূর করা-- সেই বার্তাই দেয় খেঁদি। এছাড়াও নাটকের বাকি চরিত্রগুলো একদম যথাযথ।
চার্বাকের এই চিচিং ফাঁক নাটকের শব্দ প্রক্ষেপণের দায়িত্ব সামলেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী ও তাঁর পুত্র গৌরব চক্রবর্তী। জনপ্রিয় পিতা-পুত্র আড়ালে মেঘনাদ এই নাটকের। পোশাক পরিকল্পনায় খেয়ালী দস্তিদার অনবদ্য। বিশেষ ভাবে বলতে হয় মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনায় আদিত্য সেনগুপ্তর কথা। চার্বাকের যোগ্য উত্তরসূরী আদিত্য। এত সুন্দর নাটকে বৈঠকখানার ঘর সাজিয়েছেন আদিত্য ও বিলু দত্ত যা নাটকটিকে আরও শৈল্পিক করে তোলে। মনে হয় বাস্তব বৈঠকখানায় নাটক দেখছি।
কমেডি অভিনয় করিয়ে নেওয়া কিন্তু খুব শক্ত। এতজন অভিনেতাকে দিয়ে কমেডিটা দারুণ সুচারু ভাবে করিয়ে নিয়েছেন অরিন্দম গাঙ্গুলি। সুর কাটেনি একদম। যা চড়া দাগের কমেডি নয়। আবার নাটক দেখতে দেখতে হাসি দর্শকদের আসবেই।
আজ যখন চলচ্চিত্র থেকে ওটিটি মাধ্যমের প্রতিবাদী ভাষা হয়ে উঠছে শুধুমাত্র ভায়োলেন্স, সেখানে অরিন্দম সুক্ষভাবে হাসির ছলে প্রতিবাদ করেছেন মঞ্চে। যা এ যুগে কজন পারেন! সুন্দর ভাবে শিল্পকে প্রদর্শন করার লোক আজকাল বিরল। চিচিং ফাঁক নাটক শুধুমাত্র বর্তমান প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই কথা বলে না। যুগে যুগে এ নাটকের ভাষা প্রাসঙ্গিক। সহজেই আমাদের মনের কথা বলেছে চার্বাকের 'চিচিং ফাঁক'। নাটকের শেষ দৃশ্যটি মন ভাল করে দেয়। দর্শক হাসিমুখে হল থেকে বেরোয়। নাটকের পরের শো কোথায় খোঁজ করে অবশ্যই দেখুন।
আরও পড়ুন: মহুয়ার মৃত্যুর পর বাদ দেওয়া হয় তাঁর নাম, প্রতিবাদ করেননি টালিগঞ্জের শিল্পীরা