Latest News

Chhaya Devi: বাংলা ছবির আইকনিক ‘মা’ ছায়াদেবী, বাস্তবে তাঁকে আগলে রেখেছিলেন মানসকন্যা তনুশ্রী-দেবশ্রী

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Subhadeep Bandyopadhyay
কনক সচ্ছল সুখী জীবন কাটিয়েছেন চিরকাল। শেষজীবনও অভাবে কাটাননি মোটেই। বরং সব কাছের মানুষদের সঙ্গে আনন্দ করেই বেঁচেছেন। কেন কনক জনমদুখিনী হতে যাবেন কেন? যা সব জায়গায় লেখা হচ্ছে উনি খুব দুংখের জীবন কাটিয়েছেন ইত্যাদি এগুলো খুব ভুল কথা। তাঁর ভাই, ভাইঝি, ভাইপোরা তাঁকে মাথায় করে রাখত। কনকের অন্দরমহলে সবাই ঘুরে দেখেছে নাকি? আমরা কনককে যেমন দেখেছি, কনক যা বলে গেছেন, সেগুলোই তো বিশ্বাস করব। নাকি আমরা ঘরের লোক হয়েও অন্য লোকের কথা বিশ্বাস করব?

বাংলা সিনেমা জগতের ভুলতে না পারা অভিনেত্রী ছায়া দেবীর (Chhaya Devi) জন্মদিনে, এক রাশ ক্ষোভ নিয়ে এই কথাগুলিই বলছিলেন ঝুমকি রায় ওরফে তনুশ্রী রায় ভট্টাচার্য। এই ঝুমকি হলেন স্বর্ণযুগে সব বিখ্যাত জলসায় বিখ্যাত দুই শিশু শিল্পী রুমকি-ঝুমকি জুটির ঝুমকি। ওঁদের নাচের অনুষ্ঠানে দর্শকাসনে কে বসেননি! অমলা শঙ্কর, মলিনা দেবী, বিকাশ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন। ছয়-সাত দশকের মানুষরা জানবেন এই বালিকা জুটির দাপট। এই দু’জনকেই ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন নিঃসন্তান ছায়া দেবী। আর এই রুমকির বাড়ির নাম ছিল আবার চুমকি। বড় হয়ে যিনি হলেন নায়িকা দেবশ্রী রায়। আর ঝুমকি তনুশ্রী রায় গানটাকে পেশা হিসেবে নিলেন।

তাঁদের কাছেই ছায়া দেবী ছিলেন আদরের কনক। এই দুই কন্যাও পক্ষীমাতার মতো ছায়া দেওয়া ছায়া দেবীকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আগলে যত্নে রেখেছিলেন। সেখানে কোনও দুঃখ ছিল না। আনন্দময়ী ছায়া আনন্দেই কাটিয়েছেন ‘আপনজন’দের সঙ্গে।

ঝুমকি-রুমকি জুটি, ছোটবেলায় তনুশ্রী-দেবশ্রী।

ছায়া দেবী। যাঁর আসল নাম কনকবালা গাঙ্গুলি। ডাক নাম কনক। বাংলা ছবিতে খাঁটি সোনার মতোই ফসল ফলিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মনটাও ছিল নিখাদ সোনা। ১৯১৪ সালের ৩ জুন ভাগলপুরে কনকের জন্ম। অভিজাত পরিবার। কনকরা দুই ভাই-বোন। কনকবালা গাঙ্গুলি আর ছোট ভাই ললিত মোহন গাঙ্গুলি। প্রাথমিক লেখাপড়ার সঙ্গে চলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিক্ষা। ভাগলপুরেই দামোদর মিশ্রের কাছে ক্লাসিক্যাল গানের তালিম নেন কনক।

গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি, ছায়া দেবীর নিজের ভাইপো শ্রী পলাশ গঙ্গোপাধ্যায় ছায়াদেবীর ভাই ললিতমোহনের পুত্র। তিনি টেলিফোনে বললেন, “পিসিকে নিয়ে অনেক ভুল তথ্য চারদিকে। আমরা শুনি, ছায়া দেবীর নাবালিকা বয়সে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তিনি নাকি খুব দুঃখে ছিলেন। পিসি কোনও দিন দুখিনী ছিলেন না। বরং সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এই আলোচনা পিসিও চাইতেন না তাঁকে নিয়ে হোক। ছায়া দেবী তো একজন লেজেন্ডারি ফিগার। তাঁর কাজ নিয়ে চর্চা হোক। কোকো (পলাশ এই নামে ডাকেন পিসিকে) আনন্দে সারাজীবন কাটিয়েছেন। বিয়েই কারও জীবনের একমাত্র সারসত্য নয়। তাও আবার যে বিয়ে নাবালিকা বয়সে ঘটে খুব অল্প সময়ের জন্য এবং সে নিজেই তার থেকে বেরিয়ে আসেন।”

পলাশ বাবুর কথায় বোঝা যায়, একলা নারী মানেই সে অবলা নয় বা সমাজের করুণার পাত্রী নয়। ছায়া যার নাম, সে অন্যদের যেমন বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিয়েছিলেন, তেমনি নিজেও নিজেকে ছায়া দিয়েছিলেন যথেষ্টা দক্ষতার সঙ্গে। এই সারসত্য অত দিন আগেই প্রমাণ করে গেছেন ছায়া দেবী, আজও যাঁর জীবনকাহিনি অনেক নারীদের কাছে আদর্শ।

কনক কিশোরী বয়সে বাবা মায়ের সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। উত্তর কলকাতার ১০ নম্বর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। পাশের বাড়ি ১১ নম্বর মদন ঘোষ লেন সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের বাড়ি। সেখানেই শুরু হল কনকের সঙ্গীতশিক্ষা। সঙ্গে সহপাঠী মানা অর্থাৎ কিংবদন্তী মান্না দে। মানা আর ছায়া দু’জনেই প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠেন। নৃত্যগুরু শম্ভু মহারাজের কাছেও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের তালিম নিতেন কনক। এই ভাবেই মা সরস্বতীর আর্শীবাদধন্যা কনক আরও খাঁটি সোনা হয়ে উঠলেন চারুবিদ্যায়।

এত দক্ষতার জোরেই রুপোলি পর্দায় সুযোগ পান কনক। বাড়ি থেকে বাধা দেয়নি কেউ। কনকের নাম রাখা হল ছায়া দেবী। নতুন নামেই তাঁকে চিনল জগত। ছায়া দেবীর বাপের বাড়ি গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের সূত্রে দাদামণি অশোক কুমার, কিশোর কুমাররা ছিলেন ছায়া দেবীর আত্মীয়। খুব কাছের সম্পর্ক। তখন অশোক কুমারও তরুণ অভিনেতা। কিশোরী ছায়াও প্রথম দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে, ছবির নাম ‘পথের শেষে’। পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়। ঐ ছবিতেই ছায়াকে দেখে মুগ্ধ হলেন খ্যাতনামা পরিচালক দেবকী কুমার বসু। পরপর তাঁর দুটি ছবিতে মুখ্য চরিত্রে সাইন করালেন ছায়াকে। ‘বিদ্যাপতি’ এবং ‘সোনার সংসার’। দেবকী বসুকে শিক্ষক রূপে পেয়ে ছায়া দেবী অভিনয় ক্ষমতার সেরা পাঠ পেয়ে গেলেন। ‘সোনার সংসার’ ছবিতে রমার চরিত্র। ‘বিদ্যাপতি’তে রানি লক্ষ্মীর চরিত্রে সমগ্র ভারতকে বশ করলেন ছায়া দেবী। তাঁর পারিশ্রমিক এক লাফে পাহাড়ে।

বিদ্যাপতি বুকলেট

ছায়া দেবীর সাফল্য অনেকেরই চক্ষুশূল হল স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু ছায়ার রাজত্ব আটকানো গেলনা। এর পর অহীন্দ্র চৌধুরী-ছায়া দেবী অভিনীত সুশীল মজুমদারের যুগান্তকারী ছবি ‘রিক্তা’ বড় হিট করল। এই ছবিতে অহীন্দ্রের স্ত্রী করুণার ভূমিকায় অভিনয় করেন ছায়া। রিক্তাতে ছায়া দেবী প্লেব্যাক গানও করেন। গানও হিট হয় এ ছবির। এই ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’ র চুণীবালা দেবী। তখন চুণীবালাকে কেউ চিনত না।

রিক্তা ছবিতে অহীন্দ্র চৌধুরি ও ছায়া দেবী, নায়ক নায়িকা। ছবি সৌজন্যে: জ্যোতিপ্রকাশ গুহ।

১৯৬০ সালে ‘বীণা চিত্রম’ সংস্থা নতুন করে কপিরাইট কিনে প্রিন্ট করিয়েছিল ‘রিক্তা’। ১৯৬০ সালে রি-রিলিজ হয় ‘রিক্তা’ তখন ছায়া দেবীর স্বকন্ঠে গানগুলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্লে ব্যাক করেন। তাই এখন ‘রিক্তা’ দেখলে দেখা যাবে ছায়া দেবীর লিপে সন্ধ্যা মুখার্জ্জী গাইছেন। এ সময়ে কিছু দিন বেতার জগতেও ছায়া দেবীকে প্রথিতযশা গায়িকা হিসেবে পাওয়া যায়।

পরবর্তী অধ্যায়ে ফের সিনেমায় ফেরা, সুশীল মজুমদারের ‘অভয়ের বিয়ে’তে নায়িকা হয়ে। বন্দিতা, ধাত্রীদেবতা, বার্মার পথে। এই সময় থেকেই বদলাতে থাকল চলচ্চিত্র মহল, এল নতুন যুগ নতুন নির্মান পদ্ধতি। বায়োস্কোপ যুগ থেকে ফিল্ম যুগ। ছায়া দেবী তখন চরিত্রাভিনেত্রী। কিন্তু তাঁর দাপট ম্লান হয়নি কোনও নতুন নায়ক-নায়িকার উপস্থিতিতে। নায়িকা হয়ে এলেন মঞ্জু দে, অনুভা গুপ্ত, ভারতী দেবী, সন্ধ্যারানীরা। এর পর এল উত্তম-সুচিত্রা যুগ। যে যুগ থেকে ছায়াছবির আইকনিক মা হয়ে ওঠেন ছায়া দেবী।

এই সময়ে ছবি বিশ্বাস আর ছায়া দেবী জুটি ছিল অকৃত্রিম। যাঁরা একসময় নায়ক-নায়িকা ছিলেন, তাঁরাই পরে উত্তম-সুচিত্রার বাবা-মা র চরিত্রে বাঁধা ধরা হয়ে গেলেন এই সময় থেকে। সঙ্গে পাহাড়ী সান্যালও।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির পাশাপাশি সুচিত্রা-ছায়া, অর্থাৎ মা-মেয়ে জুটিও অনবদ্য। ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন, রিনার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচয় তো আসলে ‘আই’-এর গর্ভে জন্মের ইতিহাস। আই মানে মারাঠীতে মা। স্বদেশী গর্ভে ঔপনিবেশিক সত্তার বীজ। সেই কাহিনির ‘আই’ চরিত্রে ছায়া দেবী। কী নিরুচ্চার অভিনয়! কোনদিন যে সাহেব স্বামী তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি, তবু তাঁর সংসারে পরিচারিকা হয়ে নিজের সন্তান রিনাকে মানুষ করে গেছেন। শেষ অবধি স্বামীর বন্দুকের গুলি থেকে মেয়েকে বাঁচাতে নিজেই বুক চিতিয়ে দেন, তখন মেয়ে জানতে পারে তার এতদিনকার জানা আই আসলে তার নিজের মা। ততক্ষণে সব শেষ। তবু মেয়ের কোলে মরতে পারে সেই বঞ্চিতা মা।

ঠিক তার উল্টো আবার ‘সাত পাকে বাঁধা’। মেয়ে অর্চনার সংসার গুছিয়ে দিতে গিয়ে আরও তার ক্ষতি ডেকে আনেন মা। এ ঘটনা তো আজও ঘটে। বহু মা আজও অনধিকার চর্চা করেন মেয়ের সংসারে। অর্চনার মাও তাই করেছেন। মেয়ে জামাইয়ের নামে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা থেকে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে টেলিফোন বসানো পর্যন্ত। শেষ অবধি ভাঙন। আবার যদি দেখি ‘বিপাশা’, উত্তম-সুচিত্রা জুটির অন্যতম সেরা সিনেমা, তার শেষ দৃশ্যে সুচিত্রার শাশুড়ি মা, যিনি স্বামী বঞ্চনায় অসতী অবৈধ মাতৃত্বের অপরাধে নিরুদ্দেশ ছিলেন, তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সাধিকা রূপে। কী স্নিগ্ধ সেই ছায়া দেবী!

‘মেঘ কালো’ বা ‘হার মানা হার’-এ আবার ছায়া দেবী অত্যাচারিনী। নিজের আখের গোছানো জেঠিমা তিনি। সুচিত্রাকে ভেন্ন করে রেখে ভাসুরঝির সম্পত্তির সব হাতিয়ে নেন। ভাসুরঝির ভালোবাসার মানুষটিকেও নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। শেষে নিজের ভুল বুঝে ফেরেন এক অনুতপ্তা ছায়া দেবী। সে আবার আর এক অভিনয়।

নীহাররঞ্জন গুপ্তর কলমে ‘উত্তর ফাল্গুনী’। জীবনের দুর্বিপাকে দেবযানীকে হতে হয়েছিল পান্নাবাঈ। কিন্তু কন্যা সুপর্ণার গায়ে কলঙ্কের আঁচ সে লাগতে দেয়নি। মেয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল‚ যাতে প্রেমিক মণীশের স্নেহচ্ছায়ায় সে সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। যাতে জীবনের আকাশে সুপর্ণা জ্বলজ্বল করতে পারে উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের মতো। সেই দেবযানীকে আত্মহত্যার থেকে বাঁচিয়ে জীবনের আলো দেখান যে বাঈজী, সেই দাপুটে চরিত্রে ছায়া দেবী অসাধারণ। নাচ-গানের তালিম দিয়ে দেবযানীকে করে তোলেন পান্নাবাঈ। ‘মমতা’তেও হিন্দি-উর্দু নিখুঁত উচ্চারণে ছায়া দেবী সাবলীল।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে পান্না বাঈয়ের নাচগুলো সুচিত্রাকে তুলিয়েছিলেন খোদ ছায়া দেবী। তখন বাংলা ছবিতে আলাদা করে কোরিওগ্রাফার থাকত না। সুচিত্রা সেনকে পরিচালক অসিত সেনই বলেন ‘আপনাকে বাঈজি নাচ একমাত্র শেখাতে পারেন ছায়াদি। ওঁকেই ধরুন।’ তার পরে বাকিটা পর্দায়। পান্না বাঈয়ের অত সুন্দর নাচের মুদ্রাগুলিতে ছায়া দেবীর অবদান কম নয়। সুচিত্রার শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ও ছায়া দেবীর সাথে মা মেয়ের ভূমিকায়। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছায়া দেবীর শেষ দিন অবধি যোগাযোগ ছিল।

গল্প হলেও সত্যির মুখরা বড় বউ, আপনজনের ঠাকুমা আনন্দময়ী, হারমোনিয়ামের ছায়া দেবীর স্বকন্ঠে গান ও মুজরো নাচের দাপট, কিংবা নির্জন সৈকতের সেই পুরী ভ্রমণের বিধবারা। অসাধারণ সব চরিত্র ছায়া দেবীকে দিয়েছিলেন তপন সিনহা। আবার তপন সিনহার স্ত্রী অরুন্ধতী দেবীর ‘পদীপিসির বর্মীবাক্স’তেও নামভূমিকায় ছিলেন ছায়া দেবী।

শোনা যায়, উত্তম কুমার মারা যেতে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছায়াদি। যেন পুত্রহারা হলেন। তৎকালীন সংবাদ মাধ্যমগুলি কেউ নিতে পারেনি ছায়া দেবীর বাইট। তিনি যেতেও পারেননি উত্তমের শেষযাত্রায়। ঘর থেকেই বেরোননি। পরে বলেছিলেন আপনজনদের কাছে, “রাজা চলে গেল।”

ছায়া দেবীর নিজের কোনও সন্তান ছিল না। কারণ বিয়েতে আর এগোননি কোনও দিন। ইচ্ছেও ছিলনা। ছায়া দেবীর মা ছায়া দেবীর সঙ্গেই তাঁর শেষ দিন অবধি থাকতেন ঐ মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। ছায়া দেবী শ্যুটিং এ বেরোনোর সময় রোজ বলে বেরোতেন ‘মা আসছি।’ এক ভাইঝি ঝুমুর গাঙ্গুলি ছায়া দেবীর দেখাশোনা করতেন। আর দিল্লিতে ভাই ললিতমোহন গাঙ্গুলির কাছে গেলে ভাই-ভাইপোরা মাথায় করে রাখতেন।

ছায়া দেবী পেয়েছিলেন আরও দুই আপনজনকে, যাঁরা ছায়া দেবীর মানসকন্যা। তনুশ্রী রায় আর দেবশ্রী রায়। ওঁদের কাছে ছায়া দেবী আবার সেই কনক হয়ে গেলেন। তনুশ্রী রায় ভট্টাচার্য ওরফে ঝুমকি রায় অকপট ভাবে বলে গেলেন তাঁদের আদরের কনককে নিয়ে একের পর এক গল্প।

“আমি যখন কনকের কথা ভাবি, এখন নিজের মনে বসে বসে হাসি। কনক এমন সব কাণ্ড করত, এমন ভাবে কথা বলত, খুব হাসতাম। মিস করি খুব কনককে। কনককে শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ বার করে দেয়নি। স্বামীও বেরিয়ে যাননি। কনক নিজেই চলে আসেন। একটা ন’বছরের মেয়ে কী বোঝে বিয়ের মানে? সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কনক নিজের ছন্দে নিজের শর্তে সারাজীবন কাটিয়েছে। খুব আনন্দ করে আমাদের সবার সঙ্গে থেকেছে। কনকের সঙ্গে তাঁর মা থাকতেন। কনকের মা মারা যাওয়ার পরে কনক কিছু মাস করে দিল্লিতেও থাকত ভাই-ভাইপোদের কাছে। ললিত মামা বড় বিজনেস ম্যান ছিলেন। কলকাতা এলে গ্র্যান্ডে উঠতেন কখনও। কনকও যেতেন। দিদির বাড়িও আসতেন ওঁরা। কনকের ভাইঝি ঝুমুর এখানে এসেও দেখত কনককে।”– বলছিলেন তনুশ্রী।

আপনজন ছবির জন্য দিল্লিতে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড নিতে গিয়ে।

তিনিই জানালেন, কনকদের প্রতিষ্ঠিত মা কালী ছিল। এখনও আছে। ঠাকুরমশাই দু’বেলা আসতেন, কনক নিজেও বাড়িতে বড় করে কালী পুজোর অনুষ্ঠান করতেন। সব লোকজন খাওয়াতে ভালোবাসতেন। আবার রোজকার রান্নাও করতেন প্রায় নিজে। অল্প অল্প করে অনেক আইটেম করতেন। কাউকে হাত লাগাতে দিতেন না। পায়ের ব্যথায় হয়তো রান্নাঘরে যেতে পারছেন না, বারান্দাতেই সব নিয়ে এসে বসে পড়তেন। ওখানেই লোকদের বলতেন উনুন বসাতে। ভীষণ জেদও ছিল, কিন্তু মনটা বড় ছিল।

আরও অনেক গল্প আছে তনুশ্রীর ভাণ্ডারে।

“কনক একবার দিল্লি যাবে ভাইয়ের বাড়ি। আমারও দিল্লিতে কাজ ছিল, তাই আমিও গেছিলাম কনকের সাথে। ওঁদের বাংলো টাইপের বাড়ি ছিল। একদিন ভোরবেলা কোথাও আর কনককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে নেই কনক। পাগলের মতো পুরো দিল্লি গাড়ি নিয়ে ঘোরা হচ্ছে। সে দুপুর গড়িয়ে, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল কনক ফিরছে না। শেষে পুলিশে খবর দেওয়া হল। সে আমরা দিল্লি পুলিশে গেলাম ছবি নিয়ে, নাম লেখালাম, বললাম কলকাতার একজন বিখ্যাত বর্ষীয়ান অভিনেত্রী ছায়া দেবী। এটাও বললাম মেহেন্দি করা লাল চুল, যাতে চিনতে সুবিধে হয়।

তারপর আমরা ফিরে এলাম। রাত এগারোটার সময় বাড়ির সামনে দেখি একটা অটো এসে থামল। তারপর সেই অটো থেকে নামল কনক। একটা দাপট ছিল তো, কেউ কথা বলছে না চুপ করে আছে সবাই। সবাই আমাকে বলছে, জিজ্ঞেস করতে। পরে আমি বললাম ‘কী ব্যাপার, তোমার জন্য আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি সারাদিন। কোথায়, কেন গেছিলে? না বললে আমি কিন্তু কাল চলে যাব।’

তাঁর নাকি খুব রাগ হয়েছিল সবার ওপর, তাই কাউকে কিছু না বলে চলে গেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিলেন দিনভর। আমি তো শুনে কী বলব বুঝতে পারছি না! তার পরে সকালে ভাই গিয়ে আদর করে ভাবটাব করল, তার পরে দেখি ভাই-বোনে অভিমান মিটল।”

তনুশ্রীর বোন দেবশ্রী রায়ের শিশু বয়সে প্রথম ছবির হাতেখড়ি ছায়া দেবীর সঙ্গেই। তখন চুমকি ওরফে দেবশ্রীর বয়স মাত্র এগারো মাস। ছায়া দেবী নিজের মেয়ে ভেবেই কোলে তুলে নেন চুমকিকে। চুমকির সব থেকে বহুচর্চিত শিশুবেলার ছবি ‘কুহেলী’। বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায়ের মেয়ের ভূমিকায় চুমকির সেই নাচ আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘মেঘের কোলে রোদ উঠেছে’র সঙ্গে আজও আইকনিক চাইল্ড ড্যান্স। কুহেলীর বেশীর ভাগ দৃশ্যেই ছায়া দেবীর সঙ্গেই কোলে চড়ে চুমকি। ঐ সময় কনকই চুমকিকে অভিনয়, নাচ করা– সব শিখিয়ে দেখিয়ে দিত। শ্যুটিংর ফাঁকে ঘুমও পাড়িয়ে দিত।

ছায়া দেবীর কোলে ছোট্ট দেবশ্রী।

এরপর চুমকি ফিরলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘নদী থেকে সাগরে’ ছবিতে নায়িকা হয়ে। প্রথম যৌবনে তখন নাম রুমকি রায়। সেই ছবিতেও ছায়া দেবী ছিলেন। এরপর তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’তে নতুন নামকরণ হল, দেবশ্রী রায়।

তাঁর কনক, ছায়া দেবীর জন্মদিনে দেবশ্রী রায় বললেন, “মনে পড়ছে কনকের সাথে হেদুয়ায় গিয়ে কনকের বটুয়া থেকে পয়সা বার করে সিঙাড়া খাওয়ানো আর মজার মজার গল্প। কনক থাকবে আমার অন্তরে চিরদিন। আমার প্রথম ছবি কনকের সঙ্গে আর কনকের শেষ ছবি আমার সঙ্গেই। আমি গর্বিত এমন একজন লেজেন্ডারি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী স্টারের সঙ্গে কাজ করতে পেরে। একজন ভাল আত্মার, ভাল মনের মানুষ কনক। প্রণাম জানাই এই জাতশিল্পীকে। আমরা অমূল্য রতন হারিয়েছি।”

সঞ্জয় ভট্টাচার্য (তনুশ্রীর স্বামী), ছায়া দেবী, দেবশ্রী রায়, তনুশ্রী রায় ভট্টাচার্য। তনুশ্রীর জন্মদিনে তোলা ছবি।

অশোক কুমারদের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার ছিল ছায়া দেবীর বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়। আবার ছায়া দেবীর সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল মুম্বাইয়ের শশধর মুখোপাধ্যায় পরিবারের। সেই মুখোপাধ্যায় পরিবারে রাম মুখার্জীর সঙ্গে বিয়ে হল তনুশ্রী-দেবশ্রীর মেজদি কৃষ্ণা রায়ের। কৃষ্ণা তখন বেশ নামকরা গায়িকা। পরে তিনিই পরিচিত হলেন রানি মুখার্জীর জননী হিসেবে।

রাম মুখার্জীকে ছায়া দেবী রামু বলে ডাকতেন। ছায়া দেবীর শেষ অভিনয়ও রামুর ছবিতেই। ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’। নায়িকা দেবশ্রী রায়। ঝুমকি তনুশ্রী রায় বললেন “কনক তখন পায়ে ব্যথায় দাঁড়াতে পারছে না, তবু রামুর ছবি বলে করতে রাজী হয়ে গেল।”

জানা গেল, কনকের প্রিয় খাবার দাবার ছিল উত্তর কলকাতার কচুরি, সিঙাড়া, জিলিপি, আলুর চপ আর কালাকান্দ মিষ্টি। আর ছায়া দেবী নাকি খুব খৈনিও খেতেন! ভাগলপুরের মানুষ, খৈনি তো পছন্দের হবেই। কেউ সিগারেট খায়, মদ খায়– সেসব নিয়ে লজ্জা নেই, আর খৈনি খেলেই লজ্জা! কিছু বললে আবার বকেও দিতেন। “আমাকে কনক বলেছিল, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তুই আমার নিজের মেয়ে হয়েই জন্মাস। মাঝেমধ্যেই লোক দিয়ে ফোন করিয়ে ডেকে পাঠাত, আমার খুব শরীর খারাপ এক্ষুনি আয়। ধড়মড়িয়ে গিয়ে দেখি সুস্থ মানুষ খৈনf খাচ্ছে। বললাম কী ব্যাপার, তোমার তো শরীর খারাপ নয়! কনক বলত, তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই এভাবে ডাকলাম।”– বললেন তনুশ্রী।

তনুশ্রীর জন্মদিনে হার পরিয়ে দিচ্ছেন কনক।

ছায়া দেবীর অভিনয় জীবনের পঞ্চাশ বছর উদযাপন করবে বলে ইন্টারভিউ নিতে ক্যামেরা নিয়ে অনেকে এসেছিলেন ছায়া দেবীর কাছে। দেখাই করেননি ছায়া দেবী। মিডিয়া পছন্দই করতেন না। কোন আগ্রহও ছিল না নিজের প্রচারে। তাই বলে তিনি ঘরবন্দি ছিলেন, তা নয়। তনুশ্রীর কথায়, “পাবলিক অনুষ্ঠানে যেত না কনক। শুধু একবার যেতে নিজে থেকে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিল, যখন কনককে ডি-লিট দেয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। জোড়াসাঁকোতে অনুষ্ঠানটা ছিল। আমি তো জানতাম না। আমায় ফোন করে বলল, তুই একবার আসবি? আমি গেলাম। কিছুতেই বলছে না। শেষে অনেক কষ্টে জানতে পারলাম। সব ঠিকও হল।”

কিন্তু সেই ডি-লিট উপাধি নিতে কনকের আর যাওয়া হল না। তার আগেই কনক মারা গেলেন।

তনুশ্রী ও ছায়াদেবীর ভাইঝি সাত দিন পরে ডি-লিট পুরস্কারটা কনকের হয়ে নিতে আসেন। সেরিব্রাল এট্যাক হয়েছিল কনকের। শ্যামবাজারের ড্রিমল্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ছিলেন পাঁচ দিন। চুমকি তখন ‘শিল্পান্তর’-এর শ্যুটিংয়ে আউটডোরে ছিলেন। চলে আসেন কলকাতায়, কনককে শেষ দেখা দেখতে। ভোর ৩.৩০ ২৬ এপ্রিল, ২০০১, কনক চিরতরে চলে গেলেন।

যমুনা’তে যাই গো আমি, যাই গো যমুনায়, আহা! ছল করে জল আনতে আমি…

ছায়া দেবীর জীবন কাহিনি যেন এক সেলিব্রেশন! ব্যক্তিগত জীবনে মা হতে না পারলেও, ছায়া দেবীকে বাংলা ছবির মায়ের আসন থেকে সরাবে কার সে সাধ্যি? বাংলা ছবিতে চিরকাল ছায়া-মায়ের ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজবেই।

ছবি সৌজন্যে: তনুশ্রী রায় ভট্টাচার্য

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী পরিণীতা

You might also like