ঋতুপর্ণা-শতাব্দীর বিয়েতে বুদ্ধবাবু।
শেষ আপডেট: 8th August 2024 15:25
বাংলা ছবির দুই এক নম্বর নায়িকার বিয়ে হয়েছিল পরপর। দুটি বিয়েই হেভিওয়েট বিয়ে। তখনও বাংলা ছবির নায়িকারা সাজতেন নিপাট বাঙালি সাজেই। টুকটুকে লাল বেনারসি থেকে চন্দনের বাহারে সাজত মুখ। আয়োজনেও থাকত বাঙালিয়ানা। কোনও সঙ্গীত বা মেহেন্দি নয়, আইবুড়ো ভাত থেকে দ্বিরাগমনেই সারা হত নায়িকাদের বিয়ে। সেই দুই নায়িকা হলেন শতাব্দী রায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। শতাব্দী তখন মধ্যগগনে আর ঋতুপর্ণা তখন সদ্য জিতেছেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার 'দহন' ছবির জন্য। ঋতুপর্ণার বিয়ে হল ১৯৯৯ সালে। আর ২০০০ সালের মে মাসে বিয়ে হল শতাব্দী রায়ের। এই দুই নায়িকার বিবাহ বাসরেই উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরবর্তী কালে জ্যোতিবাবুর পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
ঋতুপর্ণার আইবুড়ো ভাতের রান্না রেঁধেছিলেন ডঃ রঞ্জিত পাঁজার স্ত্রী কৃষ্ণা পাঁজা। নারায়ণের ভোগ-সহ চোদ্দো পদের আহার মেয়েকে খেতে দিলেন মা নন্দিতা সেনগুপ্ত। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত আর ইন্দ্রাণী হালদার যুগ্ম ভাবে জিতেছিলেন 'দহন' ছবির থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার। সিঁদুর দানের সময় ঋতুপর্ণার লজ্জাবস্ত্র ধরেছিলেন ইন্দ্রাণী হালদার। ঋতুপর্ণার বর তখন আমেরিকা ফেরত সঞ্জয় চক্রবর্তী।
সিঁদুর, লাল বেনারসি, লাল ভেল, শাড়ির সোনালি জরির কাজের সঙ্গে মিলিয়ে সোনার গয়না। সম্প্রদান, শুভদৃষ্টি, মালাবদল, কুসুমডিঙে পেরিয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত হয়ে গেলেন চক্রবর্তী বাড়ির বউ।
ঋতুপর্ণার বিয়েতে ডেকরেশন থেকে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আমন্ত্রিত তালিকার মুখ্য আকর্ষণ ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পরিবহণ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী থেকে বাংলার তিন নায়ক তাপস, চিরঞ্জিত ও প্রসেনজিৎ। অপর্ণা সেন থেকে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। জ্যোতি বুদ্ধদেবের সঙ্গেই দেখা মিলেছিল সস্ত্রীক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, যিনি চিরদিনের বামফ্রন্ট মুখ।
জ্যোতি বসু চট করে কারও বিবাহ বাসরে যেতেন না। কিন্তু এসেছিলেন ঋতুপর্ণার বিয়েতে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাসিমুখ ফোটোফ্রেমে ধরা ছিল ঋতুপর্ণা-সঞ্জয়ের সঙ্গে।
অন্যদিকে ঠিক তাঁর কয়েক মাস পর বিয়ে হল শতাব্দী রায়ের। তখন ২০০০ সাল পড়ে গেছে। যেন এক নতুন যুগের সূচনা। বিয়ে হল শতাব্দী রায়ের। তাঁর বরও আমেরিকা থেকে ম্যানেজমেন্ট করে এসেছেন। ঝকঝকে, সুদর্শন মৃগাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়। শতাব্দী তখনও রাজনীতিতে আসেননি। পুরোদস্তুর সিনেমার নায়িকা। কিন্তু শতাব্দীর কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ের পাকাকথা হয়।
পরবর্তীকালে শতাব্দী তৃণমূলের এমপি হন, তখন একবার শতাব্দীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর প্রিয় রং কী? শতাব্দী বলেছিলেন 'লাল'। পরক্ষণেই নায়িকার ব্যাখ্যা ছিল, 'আমার প্রিয় শাড়ির রং লাল, সেটা দিদিও জানেন।' দুই জমানার মুখ্যমন্ত্রীকেই আজও শ্রদ্ধার আসনে বসান শতাব্দী। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সম্পর্কে শতাব্দী বলছেন, 'মানুষ হিসেবেও আমি বুদ্ধবাবুকে চিনি। আমার বিয়েতেও উনি এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। আসলে রাজনীতিতে কিছু ভাল মানুষ যদি থাকেন, তাহলে উনি একজন।'
আইবুড়ো ভাতের দিন ঠাকুরকে নিবেদন করা ভোগ, প্রসাদী মিষ্টি ও ফল দিয়েই শুরু হল শতাব্দীর আইবুড়ো ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠান। কাঁসার থালার ওপর সাজিয়ে দেওয়া ১৩ বাটিতে ১৩ পদ। সঙ্গে নিজের মায়ের হতে তৈরি বাঁধাকপির ঘন্ট আর আলুর দম। ছোটমাসির রাঁধা ফ্রায়েড রাইস আর ফুলকপির তরকারি। মজার কথা, শতাব্দীর বিয়েতে একদিকে আসছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় অন্যদিকে আসছেন জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
৫ মে রিসেপশনে থাকতে পারবেন না তাই বিয়ের আগের রাতেই চলে এলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে। সেদিন আবার রবিবার পড়েছিল। সোনার দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু দোকান খোলাতে না পারলে আর বিধায়ক কীসের! এই বলে শোভন, সুব্রতকে তাতিয়ে দোকান খুলিয়ে শতাব্দীকে উপহার দিয়ে গেলেন ছিমছাম নেকলেস। সবুজ ক্রিস্টালের পুঁতিতে গাঁথা ৫টি মিনে করা সোনার বুন্দি।
শুভদৃষ্টি, মালা বদল, বিয়ের আসর জমজমাট। শতাব্দী রায়ের বিয়ের আসর বসেছিল শরৎ বোস রোডের ত্যাগরাজ হলে। শতাব্দী একেই ফর্সা, গায়ে হলুদ মেখে আরও সুন্দরী হয়ে উঠলেন। শতাব্দী আর ঋতুপর্ণা দুজনকেই সাজিয়েছিলেন মেক আপ আর্টিস্ট গৌরী বসু। শতাব্দীর সাজে লাল বেনারসী, ঠাসা জরির কাজ, সবুজ জরি পাড়, দুর্দান্ত নীল আঁচল আর গোলাপী সুতোর কাজ। সঙ্গে হাতে রতনচূড়, চুড়ি, কঙ্কন, খিলেন দেওয়া বাউটি। গলায় চিক, নেকলেস, সীতাহার। কানে টানা ফুল, সঙ্গে ঝোলা দুল। দুল আর নেকলেসে মুখোমুখি জোড়া ময়ূর। কোমরে রুপোর কোমর বন্ধ। পায়ে ভারী পায়জোর।
শতাব্দী রায় জানাচ্ছেন, 'সেইসময়কার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কারও বিয়েতে খুব একটা যেতেন না। কিন্তু উনি আমাদের বিয়েতে এসেছিলেন। জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দুজনেই এসেছিলেন, যেটা আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মমতা ব্যানার্জীও বিয়ের আগের দিন এসেছিলেন। যদিও আমি সেই সময় পলিটিক্সে ছিলাম না। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমার বিয়েতে এসে আমাকে আশীর্বাদ করে গেছিলেন। উনি খুবই কমই কারও বিয়েতে যেতেন। শ্রদ্ধেয় সিনিয়র মানুষদের আশীর্বাদ ছিল বলেই আমার বিয়ের ২৫ বছর কাটছে।'
শুধু তাই নয়, নয়ের দশকে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কলকাতার শতাব্দী রায় আর বাংলাদেশের চম্পা হয়েছিলেন থালি গার্ল। মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, পাশে ছিলেন তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বিরোধী দলনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। যে ছবিও আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিন মন্ত্রীই আজ পরলোকে।
আজকাল রাজনীতিতে ব্যক্তির অহং বড় হয়ে ওঠে। ২৫ বছর আগে কিন্তু সব দলের লোকেরাই উৎসবে অনুষ্ঠানে ভীষণ আন্তরিক ভাবেই মিশতেন। কোনও শিল্পীকেই রাজনীতির রঙে রাঙিয়ে বিচার করা হত না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে পঁচিশ বছর আগের ছবি দেখে আজ চোখ ছলছল দুই নায়িকা ঋতুপর্ণা আর শতাব্দীর।