শেষ আপডেট: 9th December 2023 16:39
ছবি- বিজয়ার পরে (২০২৩)
প্রথম প্রদর্শন- কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৩
পরিচালনা- অভিজিৎ শ্রী দাস
প্রযোজনা- সুজিত কুমার রাহা
অভিনয়ে- মমতা শংকর, দীপঙ্কর দে, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, মীর এবং অন্যান্যরা
সংগীত- রণজয় ভট্টাচার্য
বাংলা ছবিতে দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপট চিরকালীন জনপ্রিয় বিষয়। আর তাতে যদি জুড়ে দেওয়া যায় বাড়ির মেয়ের ঘরের ফেরার গল্প, তাহলে তো কথাই নেই! এই দুটি জিনিসই আছে 'বিজয়ার পরে' ছবিতে। কিন্তু এসব ছাড়াও আরও যা আছে, তা ছবিটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। বিজয়ার পরেই ছবির আসল ক্লাইম্যাক্স, বাকি সব পূর্ববর্তী পুজো কেন্দ্রিক ছবিগুলি থেকে 'বিজয়ার পরে' ছবিটিকে স্বতন্ত্র করে দেয়। এবারের ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরমা বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে 'বিজয়ার পরে'। এর কৃতিত্ব অবশ্যই নবাগত পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার অভিজিৎ শ্রী দাসের। প্রথম ছবিতেই রূপোলি পর্দায় তিনি যে চমক সৃষ্টি করলেন, তার ঘোর সহজে কাটে না। ছবিটি দেখলে একদিকে যেমন চোখের জল বাঁধ মানে না, আবার ভয়ের হাড়হিম অনুভূতিও গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে।
জীবনে শেষ বসন্তটুকু পার করছেন 'গুলঞ্চ' বনেদি বাড়ির দম্পতি অলকানন্দা (মমতা শংকর) ও আনন্দ (দীপঙ্কর দে)। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে ক্রমশ নিরুদ্দেশ হতে থাকা মানুষগুলিকে খুঁজে বেড়ানা তাঁরা। এই নিরুদ্দেশ মানুষগুলি তাঁদের ছেলেমেয়ে। বাবা মায়ের শেষ বয়সে তাঁদের সময় দেওয়া তো দূর অস্ত ,একসঙ্গে থাকার ইচ্ছেটুকুও সেই সন্তানদের নেই। কর্মব্যস্ততা আর পরিস্থিতির চাপে যে যার শহরে ব্যস্ত। একা বুড়োবুড়ি পড়ে থাকে এই গুলঞ্চ বাড়িতে। বর্তমান সময়ের এই এক জ্বলন্ত সমস্যাকে ছবিতে তুলে ধরেছেন পরিচালক। খাঁ খাঁ বাড়িতে বুড়োবুড়ি খুঁজে ফেরে আগলানো অতীত। এই তো ছেলেরা ছুটে বেড়াচ্ছে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে, মেয়ে মিনু পুকুর ঘাটে বসে কবিতা বলছে, ঠাকুরদালানে নাচ করছে। শরতের উপহার শিউলি ফুল যেন তাঁদের এসব পুরনো অতীত আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়।
সংসারে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা গিন্নিদের চিরকালই বেশি। কিন্তু কর্তা আনন্দ সন্তানদের থেকে পাওয়া এই অবহেলা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। যদিও মেয়ে মিনুর (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) ক্ষেত্রটা আলাদা। মিনু এখন পরিবারে 'একঘরে'। বাবা ই মেয়েকে ত্যাজ্যকন্যা করেছেন। কিন্তু কেন? সে উত্তর 'বিজয়ার পরে' ছবি দেখলেই বুঝবেন। যদিও বৃদ্ধ বাবা পাড়াতুতো নাতনির মধ্যে মেয়ে মিনুকে আজও দেখতে পান। অভিমানের পাহাড়ের মাঝে বাবা-মেয়ের সুতোটা আলগা হয়েও হয়নি। এমন নিঃসঙ্গ বিষাদের মাঝেই দিনের আলোর মতো এসে পড়ে শারদোৎসব। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ দিয়েই নতুন উদ্যমে শুরু হয় জীবন। সেই উপলক্ষে দূরে থাকা ছেলেমেয়েদের ঘরে ফিরতে বলেন বৃদ্ধ দম্পতি। সেই আমন্ত্রণ থেকে বাদ যায় না মেয়ে মিনুও। কিন্তু পুজোতেও আসার সময় কারওরই হয় না। সবার সময় হয় সেই 'বিজয়ার পরে' আসার। এই আসা কি বড্ড দেরি হয়ে গেল? ছবির ক্লাইম্যাক্স এখানেই। শুধু ক্লাইম্যাক্স নয়, চিত্রনাট্যের বাঁক বদল এত দৃঢ়, যে তা আসন ছেড়ে দর্শককে উঠতে দেয় না।
বাস্তব আর পরাবাস্তব কেমনভাবে মিলেমিশে যায়, দর্শককে তার সাক্ষী রাখে অভিজিৎ শ্রী দাসের এই ছবি। এক অমোঘ সত্যিকে সহজে মেনে নেওয়া যায় না! বলতে পারা যায় না! অথচ তা না বলতে পারার মধ্যেই থাকে যন্ত্রণা, ভয় আর আকস্মিক ঘটনা। গল্পের আসল মোড়টি বলে রহস্য উদঘাটন করব না। কিন্তু 'বিজয়ার পরে' এমন ভাবেই থমকে দেয় যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
নবাগত পরিচালকের ছবি দেখতে বসলে সাধারণত মনে বেশি আশা রাখেন না দর্শক। কিন্তু আশাতীত রকমের উন্নত ছবি বানিয়েছেন নতুন পরিচালক অভিজিৎ শ্রী দাস। অভিজিৎ মূলত বিজ্ঞাপনের ছবি বানান। এই প্রথম ফিচার ফিল্ম বানালেন তিনি। টলিউডের মননশীল ছবির পরিচালকদের তালিকায় অভিজিৎ শ্রী দাসের নাম উঠে আসতে খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। এখন যা যা ছবি হচ্ছে তার মধ্যে হয় অপরাধ আছে, যৌনতা আছে, আর নয়তো তা গোয়েন্দা গল্প! কিন্তু থ্রিলার জঁরের বাইরে বেরিয়ে অভিজিতের চিত্রনাট্য একটা আটপৌরে পরিবারের গল্প বলে। যেখানে রক্ষণশীলতা আর মুক্তমনা- দুই মেরু ক্রমশ মুখোমুখি হতে থাকে।
উত্তরবঙ্গের তরুণ অভিজিৎ শ্রী দাসের ফিল্ম জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা হলেন শর্মিলা ঠাকুর। 'বিজয়ার পরে' ছবিটিতে বৃদ্ধ দম্পতির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর। অপুর সংসার জুটির শেষ ঐতিহাসিক কাজ সেক্ষেত্রে অভিজিতের হাত ধরেই হত। কিন্তু বাধা হল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু। শর্মিলার নায়ক রূপে আর কাউকে ভাবতে পারেননি অভিজিৎ। শেষমেষ দীপঙ্কর দে ও মমতা শংকর লিড কাস্টে এলেন। এই ছবি দীপঙ্কর-মমতা জুটির এ যুগের শ্রেষ্ঠ ছবি হয়ে থাকল।
বাংলা ছবিতে বাড়ির কর্তার চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয়ে গেছিলেন। সেদিক থেকে থেকে বহু যুগ পর দীপঙ্কর দে যে এখনও ফুরিয়ে যাননি তা তিনি প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন। বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে দীপঙ্কর মারাত্মক নির্বাক নিথর অভিনয় করেছেন। তিনি যে কত বড় অভিনেতা তা জীবনের বিজয়া বেলাতে এসে আবারও দেখিয়ে দিলেন। শুভ বিজয়া কথাটা কী মর্মস্পর্শীভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক!
'বিজয়ার পরে' ছবির প্রাণপ্রতিমা মমতা শংকর। ছবির রাশ তিনি যেভাবে সারাটা সময় টেনে রাখলেন তা অনির্বচনীয়। ছবির পরতে পরতে নিজেকে উজাড় করে অভিনয় করেছেন তিনি। একা মানুষরা হঠাৎ বিপদে কতটা অসহায়! আবার বিপদ আর ভয়ের মুখোমুখি হয়েও তাঁরা যে আসলে মানসিকভাবে কতটা শক্তিশালী, তার সঙ্গে দর্শকরা ভীষণভাবেই একাত্ম হতে পারবেন মনে হয়। মমতা শংকরের অভিনয় রবীন্দ্রসদনের প্রতিটি দর্শককে কাঁদিয়ে ছাড়ল। কী সাবলীল অথচ সাংঘাতিক হাড়হিম অভিনয় করেছেন দীপঙ্কর-মমতা জুটি।
আটের দশকের মধ্যভাগে নারায়ণ চক্রবর্তীর 'নিশান্তে' ছবিতে প্রথম একসঙ্গে কাজ করেন দীপঙ্কর-মমতা। তাঁদের জুটিকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যিনি, তিনি সত্যজিৎ রায়। 'গণশত্রু', 'শাখা প্রশাখা' ও 'আগন্তুক' এই জুটির তিন ল্যান্ডমার্ক ছবি। এরপর আর সেভাবে এই জুটি মাইলস্টোন কাজ করার পরিসর পাননি। পরবর্তীকালে বহু ছবিতেই একসাথে কাজ করেছেন বটে দুজনে, তবে সেসব ছবি দর্শকদের মনে দাগ কাটতে পারেনি। ২০১০ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরে মমতা-দীপঙ্কর জুটির ছবি 'আবহমান' নতুন করে মাইলফলক তৈরি করে। তবে সেই ছবিতে রোম্যান্সের থেকেও দ্বন্দ্ব ছিল বেশি। কিন্তু অভিজিৎ শ্রী দাসের 'বিজয়ার শেষে' যেন ১৩ বছর পর এই জুটির সার্থক রূপদান করল পর্দায়। দীর্ঘ দাম্পত্যের দুঃখ- কষ্টের মাঝেও কী অপূর্ব মাধুর্যের রেশ রয়ে যায়!
ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র 'মৃন্ময়ী' ওরফে 'মিনু' স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ছবির শুরুতেই বিসর্জনের প্রতিমার সাজে চালচিত্রের ওপর মানবী রূপী দুর্গার ভূমিকায় স্বস্তিকার লুক ও অভিনয় দুর্দান্ত। প্রথম দৃশ্যেই ছবিটি দর্শকদের মন জয় করে নেয়। যদিও ছবির অনেকখানি পরে স্বস্তিকার অভিনয় পূর্ণতা পায়। তবু এই নতুন পরিচালক তাঁর প্রথম ছবিতে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন,তারকা তা অনবদ্য। কমেডি চরিত্র ছেড়ে মীর এই ছবিতে স্বস্তিকার বিপরীতে মনস্তত্ববিদের সিরিয়াস চরিত্রে রয়েছেন। বিদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনীত বড় বৌ চরিত্রটি বেশ নজর কাড়ল। কিছুটা নেতিবাচক শেড থাকলেও হলেও কোথাও গিয়ে একটা সারল্যও রয়েছে তাঁর চরিত্রে। তিনি সিরিয়ালের পোকা। তাঁর একমাত্র মেয়েও সিরিয়ালের নায়িকা। মেয়ে তারকা, তাই পাড়ার লোক তাকে দেখলে বিদীপ্তার গর্ববোধ হচ্ছে, এই আপাত তুচ্ছ ব্যাপারগুলোর ডিটেলিং বেশ ভাল।
বিদীপ্তার মেয়ের চরিত্রে খেয়া চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় আবারও মন ভরাল। খেয়াকে কমললতা রূপে পর্দায় যতবার এনেছেন পরিচালক ততবার মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে। বড় ছেলে হিসেবে পদ্মনাভ যথাযথ। মেজো ছেলে অনিমেষ ভাদুড়ি চরিত্র অনুযায়ী পারফেক্ট। মেজো বৌ মিশকা হালিম আবার বড় বৌয়ের থেকে নিজেকে বেশি উঁচু স্টেটাসের ভাবে। তবে দুই জায়ের এই রেষারেষির ছাপ পড়েনি তাঁদের ছেলেমেয়েদের উপর। মেজো নাতির চরিত্রে ঋতব্রত ভট্টাচার্য দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। পরিচারিকার চরিত্রে সাবলীল অভিনয়ে ভীষণভাবে নজর কাড়লেন তনিকা বসু। দুধওয়ালা বিমল গিরি- পরিচারিকা তনিকার প্রেম 'বাড়িওয়ালি'র নারায়ণ- মালতীকে মনে করাচ্ছিল।
'বিজয়ার পরে' ছবির সংগীত পরিচালক রণজয় ভট্টাচার্য। রণজয় প্রতিটি গানে তাঁর সুরুচির ছাপ রাখলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক, সব গানেই অপূর্ব সংগীত আয়োজন করেছেন রণজয়ম, যা কান আর চোখ দুটিকেই আরাম দেয়। মমতা শংকর এই ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর অপূর্ব কোরিওগ্রাফিও করেছেন। নিজে না নাচলেও তাঁর ছোট পুত্রবধূ সহ সব শিল্পীরা অপূর্ব নাচ করেছেন। প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেক আপ প্রশংসনীয়, বিশেষত টেনশনের মধ্যে মমতা শংকরের সিঁদুরখেলার পর মেক আপ। পোশাকেও দারুণ অভিষেক রায় ও সন্দীপ জয়সোয়াল।
ছবিটি দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা, যা কিছুটা হলেও ছন্দপতন ঘটাতে পারে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের। যদিও কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির আনকাট ভার্সন প্রথম দেখানো হল। কিছু গানের দৃশ্যায়ন বা সন্তানদের সংলাপ দৃশ্য বড় বাড়তি মনে হয়, বিশেষ করে যে সময় দর্শক ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি ও পরিচালক পাবলিক রিলিজের সময় আরেকটু ছোট করতে পারেন ছবিটিকে। তবে আগেই বলেছি, সব কটি গান কানকে আরাম দেয়। তবু চিত্রনাট্যর বুনোট আর দর্শকের উৎকণ্ঠা ধরে রাখাই শেষ কথা।
অভিজিৎ শ্রী দাস বিজ্ঞাপন জগত থেকে এসে প্রথম ফিচার ফিল্ম করলেন। যে ছবি আবার মাল্টিস্টারার ছবি। কিন্তু অতি আঁতলামো বা অযথা যৌনদৃশ্য এনে তিনি চিরাচরিত বাজার ধরতে চাননি। প্রথম ছবিতেই পরিচালক বুঝিয়ে দিলেন তিনি লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। দীপঙ্কর-মমতা জুটির এখনও পর্যন্ত শেষ শ্রেষ্ঠ কাজ 'বিজয়ার পরে'। সত্যজিৎ-ঋতুপর্ণর পর অভিজিতের মতো পরিচালকের কাঁধে ভর করে দীপঙ্কর দে- মমতা শংকর তাঁদের রসায়ন জমিয়ে দিলেন। ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও 'বিজয়ার পরে' ছবিটি নির্বাচিত হয়েছে। কিছুদিন পরেই ছবিটির পাবলিক রিলিজ। দর্শকরা এ ছবি না দেখলে বড় মিস করবেন। নবাগত পরিচালক ও তাঁর টিমের জন্য অনেক শুভেচ্ছা। আগামী শুভ হোক।