Latest News

একুশজুড়ে অন্যরকম বাংলা ছবি! বক্সঅফিসে কারা সেরা, কারাই বা নম্বর পেল ক্রিটিকের কলমে

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

নিউনর্মাল নতুন পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশ সিটিং নিয়ে খুলেছিল প্রেক্ষাগৃহ। ধীরেধীরে সিনেমাহলে বাড়ানো হয়েছে আরও দর্শক সংখ্যা। এমনকি হাউসফুল হচ্ছে বাংলা ছবি। করোনা আবহের মধ্যেও নতুন দিশা দেখছে বাংলা ছবি।

২০২১ সালে কোন কোন ছবি বক্সঅফিসে এগিয়ে রইল, আবার কোন কোন ছবি প্রশংসিত হল সমালোচক মহলে। বছর শেষে বর্ষসেরা বাংলা ছবি গুলির মার্কশিট রইল।

বক্সঅফিস হিট ছবি

টনিক

করোনায় নয় প্যানিক, বরং সঙ্গে রাখুন ‘টনিক’।

বছর শেষে সবথেকে বক্সঅফিসে লক্ষ্মী আনল ‘টনিক’ ছবি। দুই জেনারেশানের মধ্যে যেন সেতুবন্ধন করেছে এই ছবির ভাবনা। আর তাতেই হল উপচে ভরছে দর্শক। বড়দিনের আনন্দ, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমাটি অভিনয় ও দেবের আকর্ষণীয় স্ক্রিনপ্রেজেন্স সুপারহিট করে দিল ছবি। আট থেকে আশি সবার মন ভরিয়েছে ‘টনিক’। প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী ফ্যামিলি ড্রামায় সিদ্ধহস্ত আর পরিচালক অভিজিৎ সেন তেমন সুন্দর বুননে বুনেছেন গল্প। মন ভরিয়েছে জিৎ গাঙ্গুলির মিউজিক। অনেকদিন পর বড় পর্দায় দেব-অতনুর আনুকল্যে কাজ করলেন শকুন্তলা বড়ুয়া। পরিছন্ন, নির্মল আনন্দ পেতে ও সুন্দর সময় কাটানোর জন্য অবশ্যই ‘টনিক’-এর স্বাদ নেওয়া যেতেই পারে। হলিউের স্পাইডারম্যানকে বা বলিউড ছবির ’83’ কেও বক্সঅফিসে হারিয়ে দিয়েছে দেব-পরাণ জুটির ‘টনিক’। ‘টনিক’কে দেখে মনে হয় এ যেন ‘গল্প হলেও সত্যি’র রবি ঘোষ।

ম্যাজিক

অঙ্কুশ হাজরা ও ঐন্দ্রিলা সেনের ‘ম্যাজিক’ বক্সঅফিসে ভালই ম্যাজিক দেখিয়েছে। ছবির বিষয়বস্তু অন্য ছবি গুলির থেকে এগিয়ে। যদিও নির্মাণ আরও ভাল হতে পারত। বড় পর্দায় ঐন্দ্রিলার অভিনয় বিশেষ করে মন ছুঁয়েছে দর্শকদের। এ ছবির চাবিকাঠি অঙ্কুশ। ইন্দ্রজিতের চরিত্রে অনেক পরত যোগ করার চেষ্টা করেছেন অভিনেতা। বিদীপ্তা চক্রবর্তী ছবির অন্যতম প্রাপ্তি। ডিগ্ল্যাম লুকে, শরীরী ভাষায় অসুস্থ মানুষকে যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা প্রশংসনীয়। ভাবনার দিক থেকে  রাজা চন্দর ‘ম্যাজিক’ ছবিকে এগিয়ে রাখতেই হবে। রাজার নতুন আঙ্গিকে গল্প বলার প্রচেষ্টা সাধুবাদযোগ্য। বাংলা ছবির গল্প এখন পাল্টাচ্ছে। বদলাচ্ছে গল্প বলার ধরন।

বনি

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি ‘বনি’ ছবি পরিচালনা করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়ে পরমব্রত নিজেই। সঙ্গে কোয়েল মল্লিক। এইরকম একটা কনসেপ্ট নিয়ে বাংলায় কাজ করতে গেলে অনেকটা সাহসের প্রয়োজন। বাংলা সিনেমার দর্শকদের আবার হলমুখী করার জন্য খুব দরকারি একটা পদক্ষেপ।

যাঁরা শীর্ষেন্দুর লেখার ভক্ত, তাঁদের অনেকের কাছে ‘বনি’র গল্প জানা। কিন্তু যাঁদের জানা নয়, তাঁদেরও কোনও অসুবিধা হবে না এ ছবি দেখতে। মিলানবাসী এক বাঙালি দম্পতি সফ্টওয়্যার প্রযুক্তিবিদ সব্যসাচী এবং জৈব-রসায়নবিদ প্রতিভা এবং তাঁদের নবজাত সন্তান। জন্মের পর থেকেই কথা বলা বা নড়াচড়া করতে অপারগ শিশুটি হঠাৎই কিছু অলৌকিক ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। এর পর থেকেই সব্যসাচী-প্রতিভার জীবনে নানা রকম বিপদ নেমে আসে। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে কলকাতার ছাপোষা শখের বিজ্ঞানী রামমোহন। সে হঠাৎই এক দোকান থেকে একটি পড়ে থাকা খারাপ রোবট কিনে বাড়ি নিয়ে আসে। ঠিক তারপর থেকেই তার বাড়িতে নানা রকম অদ্ভুত কাণ্ড শুরু হয়।

ছবির শেষ ভাগে রয়েছেন এক বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী যিনি আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন যার ফলে তাঁকে আমেরিকা ছেড়ে পালাতে হয়। ছবির এই তিন দিগন্ত কী ভাবে একে অপরের সঙ্গে এক সুতোয় জুড়ে যায়, তাই নিয়েই গল্প ছবির। পুজোর সময় ছবিটি হলমুখী করেছিল দর্শকদের। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে শুভ প্রচেষ্টা বাংলা ছবিতে।

গোলন্দাজ

ফুটবল মাঠে বিপ্লব এনেছিলেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। ইতিহাসের পাতায় তিনি পরিচিত ‘ফাদার অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল’ হিসেবে। সময়টা ১৮৭৭ সাল। কিন্তু তিনি চলে গেছিলেন বিস্মৃতির আড়ালে। মেনস্ট্রিমে তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন দেব অধিকারী ও পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। গোলন্দাজ নিঃসন্দেহে দেবের কেরিয়ারের মাইল ফলক। মনপ্রাণ দিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে বিস্মৃত চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন দেব। নজর কেড়েছেন ঈশা সাহা ও ইন্দ্রাশীষ রায়। ছোট্ট উপস্থিতিতে ও কন্ঠ মাধুর্যে অনির্বাণ ভট্টাচার্য অতুলনীয়। তবে এই ধরনের প্লটে গল্প ‘লগান’ দর্শক আগেই দেখেছে এবং অত্যাধিক ধারাবিবরণী ছবিটিকে শ্লথ করেছে। তবুও এই পরীক্ষামূলক ছবি দিয়ে যে হাউসফুল হয়েছে বাংলা ছবি তা কুর্ণিশযোগ্য। ছবিতে গানের প্রয়োগ,চিত্রগ্রহণ মন ভরিয়েছে।

মুখোশ

ছকভাঙা চিত্রনাট্য ও হলভরা দর্শক দেখিয়েছে বিরসা দাশগুপ্তর ‘মুখোশ’। মুখোশ’ ছবিতে শুধু পুলিশের মুখোশ খোলেনি, সমাজের আরও কিছু প্রতিষ্ঠিত মানুষের মুখোশ খোলা প্রকৃত মুখ দেখা গেছে। মুখোশের আড়ালে অন্ধকার না অন্ধকারের আড়ালে কোনও মুখোশ? ধীরে ধীরে সামনে আসে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ও সত্যি। অসামান্য অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য,টোটা রায়চৌধুরী এবং চান্দ্রেয়ী ঘোষ। অন্যধারার ছবিটির বক্সঅফিসেও এ বছর ভাল সাড়া মিলেছে।

বছরের প্রশংসনীয় ছবি

হীরালাল

ইতিহাসবিস্মৃত যুগে দাঁড়িয়ে এই ছবি অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল হিসেবে থেকে যাবে। যার জন্য পরিচালক অরুণ সেনকে ধন্যবাদ।দেশের প্রথম যুগের চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনকে নিয়ে এই ছবি। পরিচালক অভিনয়ের ক্ষেত্রে বড় স্টার বড় নামের দিকে না ঝোঁকার সাহস দেখিয়েছেন। হীরালালের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ ছবির তুরুপের তাস। সাবেকিয়ানার সঙ্গে আধুনিক প্যাশনের স্পর্শ যেন মিলেছে কিঞ্জলের পৌরুষে। ম্যাডানের চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা এনেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। মনের মতো অনুষ্কা চক্রবর্তীকেও। অর্ণ মুখোপাধ্যায় মন ভরিয়েছেন অভিনয়ে। পিরিয়ড ছবিকে ধরতে আরও বাজেটের প্রয়োজন তবু এমন অভিনব ভাবনা আগে ভাবেনি টলিউড।

অভিযাত্রিক

শুভ্রজিৎ মিত্রের পরিচালনায় এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অর্জুন চক্রবর্তী। সঙ্গে দিতিপ্রিয়া রায়। অর্জুনের কেরিয়ারের অন্যতম ছবি ‘অভিযাত্রিক’। রাসমণি খোলস থেকে বেরিয়ে দিতিপ্রিয়ার সার্থক চরিত্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শেষাংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি। সত্যজিৎ রায় যেখানে অপু ট্রিলজি শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই এই ছবির চিত্রনাট্য শুরু করেছেন পরিচালক শুভ্রজিৎ। ‘অপু ট্রিলজি’র শেষ ছবি ‘অপুর সংসার’ এ অপু ও তাঁর পুত্র কাজলের মিলনে শেষ হয় গল্প। তারপর কী হল তাদের। সেই গল্পই বলেছে ‘অভিযাত্রিক’। শ্রীলেখা মিত্র ও অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র দুটি ছবিতে উপরি পাওনা। সব্যসাচী চক্রবর্তী ও অর্জুন চক্রবর্তী পিতাপুত্র একসাথে এই ছবিতে চমকপ্রদ বৈকী। ছবি দেখতে ভাল লাগবে কারণ অভিযাত্রিক এর আরেকনাম সাদা-কালোর নস্ট্যালজিয়া।

‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’

রূপকথার মোড়কে রাজনৈতিক স্যাটায়ার, পুজোয় ছোটপর্দা জমিয়ে দিয়েছিল হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্র। ছবিটির টেলিভিশন রিলিজ হয় পুজোর সময়। অনেকেই এ ছবি দেখে ভাবতে পারেন বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার চোখে আঙুল দিতেই এই ছবি বানানো হয়েছে। তা কিন্তু নয়, ছবিটা দেখলেই বোঝা যায় যুগে যুগে এই ছবি প্রাসঙ্গিক। আজ থেকে কুড়ি বছর পরও এই ছবির রাজনৈতিক বার্তা প্রাসঙ্গিক থাকবে। তখনও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই ছবিটিকে সার্থক স্যাটায়ার ছবি মনে হবে। ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’র সার্থকতা এখানেই। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’ দেখতে দেখতে খুব মনে পড়বে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশ’-এর কথা। এ ছবি দেব এন্টারটেনমেন্টসের সাহসি পদক্ষেপ। নায়ক ‘দেব’ বা রাজনৈতিক মুখ ‘দেব’ সবার প্রিয়। কিন্তু প্রযোজক দেব ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’ ছবিতে যে কাস্টিং রেখেছেন তা আরও একবার প্রমাণ করল দেবের শুভবুদ্ধি। হবুচন্দ্র রাজার ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় চরিত্রের মান রেখেছেন। একদম পারফেক্ট। যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়।

বিনি সুতোয়

কথায় আছে বিনি সুতোর মালা ভাবলেই আছে, না ভাবলেই নেই। তেমনি সমাজের ভিন্ন দুই অবস্থান থেকে উঠে আসা দুটি মানুষ বিনি সুতোর মতো জুড়ে যায় দু’জন দু’জনের সাথে, অথচ জড়িয়ে যায় না। সমান্তরাল দুই জীবন ক্ষণিকের জন্য কোনও বিন্দুতে মিলিত হলে খুলে যায় হয়তো নতুন দিগন্ত, সেখান থেকে তৈরি হয় নতুন গল্প! এই ধারণাকে প্রেক্ষাপট করেই অতনু ঘোষের ছবি ‘বিনি সুতোয়’ এগিয়ে চলে। ‘কে পাবে ৫০ লাখ’ শীর্ষক এক রিয়্যালিটি শোয়ের অডিশনে দেখা হয়ে যায় শ্রাবণী বড়ুয়া (জয়া আহসান) ও কাজল সরকারের (ঋত্বিক চক্রবর্তী)। সারাদিনটা তাঁরা একসঙ্গে কাটায় এবং দিনের শেষে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু বাড়ি ফেরে নতুন রূপে। এমন এক গল্প বুনেছেন অতনু ঘোষ। নন্দনে এই ছবি দেখতে উইকেন্ডে হাউসফুল হয়েছিল কোভিড আবহেও। যা মন ভাল করা ছবি ছিল অনেকদিন পর ইন্ডাস্ট্রির জন্য। ঋত্বিক-জয়ার যুগলবন্দি অভিনয় এ ছবির সম্পদ। ‘বিনি সুতোয়’ ভাবাবে, সিনেমাহল থেকে বেরোনোর পরও রেশ রয়ে যাবে। অনেকটা ছোট গল্প পড়ার মতোই রেশ পাওয়া যায় এ ছবিতে।

অন্তর্ধান

অরিন্দম ভট্টাচার্যর সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ছবি ‘অন্তর্ধান’। কাসৌলির পাহাড়ি খাদে যেন ঘনীভূত হয়েছে রহস্যে ঘেরা এই গল্প। ক্লাস এইটের টিনএজ মেয়ে জিনিয়াকে ঘিরে ছবির প্রেক্ষাপট। এই চরিত্রে অভিনয় করেছে নবাগতা মোহর চৌধুরি। মা-বাবার সঙ্গে হিমাচলে থাকে জিনিয়া। মা-বাবার চরিত্রে রয়েছেন পরমব্রত এবং তনুশ্রী চক্রবর্তী। সুখী পরিবারে আচমকাই নেমে আসে একটা বিপর্যয়। হঠাৎই কিডন্যাপ হয়ে যায় মেয়ে জিনিয়া। আর জিনিয়ার এই ‘অন্তর্ধান’ রহস্যকে ঘিরেই এগিয়েছে ছবির গল্প। এক একা মহিলার চরিত্রে রয়েছেন মমতা শংকর। লুক থেকে অভিনয় আঙ্গিক, সবেতেই চমকপ্রদ মমতা শংকরের চরিত্রটি। অরিন্দমের সব ছবিতেই মমতা শংকরকে নতুন ভাবে পাওয়া যায়। শ্রীমতী রায় ওরফে মমতা শংকর যখন তন্ত্রসাধনায় মগ্ন হন তখন ছবির পরিমণ্ডলটাই যেন আরও বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। পরম ও তনুশ্রী স্বাভাবিক অভিনয়ে ছবির দুই কাণ্ডারী। রজতাভ দত্ত নজরকাড়া। তবে ছবির ভরকেন্দ্র চিত্রনাট্য।

এই ছবির শেষটাতেই চমক। যা বাংলা ছবির প্লটে নিঃসন্দেহে এক নতুন ঘরানার পরিচয় করায়।

You might also like