শেষ আপডেট: 3rd June 2023 06:23
প্রাক্তন বনাম বর্তমান, এক জটিল সমীকরণ! কৌশিকের 'অর্ধাঙ্গিনী'র প্রাণ চূর্ণী-জয়া
প্রসূন চন্দ
সারাংশ: শপিং মলে কেনাকাটার সময় সুমন চ্যাটার্জির (কৌশিক সেন) হঠাৎই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় এবং তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করেন তাঁর বর্তমান স্ত্রী মেঘনা মুস্তাফি (জয়া আহসান)। হাসপাতালে কোমায় চলে যান সুমন। তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন প্রাক্তন স্ত্রী শুভ্রা (চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়)। শুভ্রা এবং মেঘনা দু'জন প্রতিপক্ষ হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। স্বামীর নয়, বরং দুই সতীন একসময় হয়ে দাঁড়ান পরস্পরের 'অর্ধাঙ্গিনী'। এরপর দু'জন শেষ অবধি সুমনকে বাঁচাতে কী করেন, কখনও স্নেহের আদর, কখনও আবার প্রতিহিংসা- এই নিয়েই আবর্তিত হয়েছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছবি 'অর্ধাঙ্গিনী'।

পর্যালোচনা: একটি জটিল সমীকরণকে একেবারে সহজবোধ্য করে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন পরিচালক। মানুষের জীবনের কঠিন, অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে কাজ করে কৌশিক আগেও নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। এবারও তার অন্যথা হয়নি। বরাবরের মতোই এবারও দর্শকদের তিনি বসিয়ে দিয়েছেন বিচারকের আসনে। যেখান থেকে উঠে আসার উপায় নেই। আবার সঠিক বিচার করাও যেন অসাধ্য ব্যাপার। তাঁদের বিচারের দাঁড়িপাল্লা কখনও হেলে যাবে মেঘনার দিকে, আবার কখনও শুভ্রার দিকে। শেষ অবধি কারও দাঁড়িপাল্লা থাকবে সমান সমান, কারও উঁচু-নিচু।

আজকাল সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন পরিচালক রয়েছেন, যাদের নামে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আসে সিনেমা দেখতে। তাঁদের মধ্যে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম। তবে তাঁর পরিচালনা হয়তো বৃথাই যেত, যদি না গল্পের প্রধান দুই চরিত্রে তিনি চূর্ণী বা জয়াকে পেতেন। আসলে এই দু'জনের কাঁধেই দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা ছবিটা। তবে শুরু থেকে শেষ অবধি তাঁদের যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গিয়েছেন কৌশিক সেন, অম্বরিশ ভট্টাচার্য, লিলি চক্রবর্তীরা।
গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্র সুমন, অর্থাৎ কৌশিক সেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই গল্পের যাবতীয় ওঠানামা। কখনও গল্প চলেছে বর্তমানের পথ ধরে, কখনও আবার ডুব দিয়েছে স্মৃতির সাগরে। আর যখনই ফ্ল্যাশব্যাকে গল্প গিয়েছে, ততবারই কৌশিক ছক্কা হাঁকিয়েছেন প্রতিটা বলে। ধূসর চরিত্রে কৌশিকের অভিনয় এর আগেও টলিউড দেখেছে। তবে 'অর্ধাঙ্গিনী'তে অভিনেতাকে দেখার পর রাগ-কষ্ট-ক্ষোভের এক অদ্ভুত তৈরি হতে পারে দর্শকদের মনে।

আর একজন অভিনেতার কথা না বললেই নয়। তিনি অম্বরিশ ভট্টাচার্য। সুমনের ছোটভাই হিসাবে দাদার জন্য কর্তব্য পালন, আবার মায়ের বাধ্য ছেলে, কখনও প্রাক্তন বৌদির মায়ের মতো মেনে চলা, আবার নতুন বৌদির সঙ্গেও দাদাকে বাঁচানোর লড়াই, সঙ্গে গল্পের সিরিয়াস মুহূর্তগুলোতেও অল্পস্বল্প হাসির খোরাক জোগান - চরিত্রের প্রতিটি স্তর যেভাবে ছুঁয়ে গিয়েছেন অম্বরিশ, তাতে তাঁকে জাত অভিনেতা না বললে কৃপণতা করা হবে।
ভাল লাগে সুমনের মায়ের চরিত্রে লিলি চক্রবর্তীর প্রয়োজনে কঠোরতা, আবার সময় বিশেষে নরম হওয়া। আরও একজন অভিনেত্রী স্বল্প সময়েও ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তিনি দামিনী বেনি বসু। এই ছোট ছোট চরিত্রগুলিই যেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'অর্ধাঙ্গিনী' প্রাণ। বাদবাকি বিষয়গুলো তো রয়েছেই, তবে শুধুমাত্র এদের অভিনয়েই ছবিটি অনায়াসে লেটার মার্কস পাওয়ার দাবি রাখে।
ছবিতে গান রয়েছে মাত্র তিনটি। এরমধ্যে একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত, অপর দু'টি অনুপম রায়ের লেখা এবং সুর করা। তারমধ্যে ইমান চক্রবর্তীর গাওয়া 'আলাদা আলাদা' সিনেমার গল্পের পাশাপাশি দর্শকের মনেও ছাপ রেখে যাবে। তবে অমিত চট্টোপাধ্যায়ের আবহ সঙ্গীত এই ছবির বড় পাওনা।

ভাল লাগে গোপী ভগতের ক্যামেরার কাজও। ক্লোজ শটে যেভাবে জয়া, চূর্ণীর বিশেষ মুহূর্তগুলিকে লেন্সবন্দি করেছেন, তা তারিফযোগ্য। ছবি শুরুর মিনিট দশেকের পর থেকেই ধীরে ধীরে গতি বাড়াতে থাকে। কখনও সুমনের দ্বিতীয় বিয়ের আসর থেকে গল্প চলে যায় হাসপাতালে বেডে, আবার পরমুহূর্তেই চলে আসে তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার মুহূর্তে। পরিচালক যেভাবে দৃশ্যগুলো দেখাতে চেয়েছেন, তা যথাযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন ছবির সম্পাদক বা এডিটর শুভজিৎ সিংহ। মাঝেমধ্যেই ছবির গল্প বর্তমান থেকে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়েছে। কিন্তু শুভজিতের সম্পাদনার দৌলতে তা দর্শকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আলোচনার শেষে আসি ছবির সংলাপের বিষয়ে। 'অর্ধাঙ্গিনী'র বেশিরভাগ অংশই সংলাপ নির্ভর। শুধুমাত্র সংলাপে ভর করে চার দেওয়ালের মধ্যে দর্শকের মনে একঘেয়েমি না এনেও কীভাবে গল্প বলা যায়, তা ঋতুপর্ণ ঘোষ, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকরা দেখিয়েছেন আগেও। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যেন সেই পথেরই পথিক। মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কৌশিক কাজ করতে গিয়ে কোনও গম্ভীর সংলাপে নয়, বরং সহজ-সরল কথার মাধ্যমেই চরিত্রদের মনের ভাব প্রকাশ করিয়েছেন পর্দায়।
অর্ধাঙ্গিনী মানে যিনি অর্ধেক অঙ্গের অধিকারিণী। মূলত স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেই অর্ধাঙ্গিনী শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে ছবিটির জন্য কোনও একজন বা দু'জনকে এই তকমা দেওয়া যাবে না। ছবিকে সফলতার আলো দেখাতে যেভাবে সবাই নিজের কাজটুকু করেছেন, তাতে সবাইকেই সিনেমার 'অর্ধাঙ্গিনী' বললে ভুল হবে না।
অভিনয়ে: চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, জয়া আহসান, কৌশিক সেন, অম্বরিশ ভট্টাচার্য, লিলি চক্রবর্তী, দামিনী বেনি বসু, প্রমুখ।
পরিচালক: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
প্রযোজনা: সুরিন্দর ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড