শেষ আপডেট: 31st August 2023 13:01
'আমি বন্ধুর প্রেম আগুনে পোড়া
সই গো, আমি মরলে পোড়াসনে তোরা
সই গো সই, বন্ধু যে দিন ছেড়ে গেছে
সে দিন পোড়া দিয়ে গেছে
সে পোড়াতে হয়েছি অঙ্গেরা
শোন বলি শোন, প্রাণসখী
পুড়িবার কি আছে বাকি?
পোড়া জিনিস কি পোড়াবি তোরা?
সই গো, আমি মরলে পোড়াসনে তোরা'...
যে সময় নামী জনপ্রিয় শিল্পীরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিতে পারেন না নবাগতদের, ঠিক সেসময় এক ঐতিহাসিক কাজ (Bengali Drama NirajaSundari) করে দেখালেন অভিনেতা-নাট্যকার অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী খেয়ালী দস্তিদার (Arindam and Kheyali)। তাঁদের 'খেয়ালী অরিন্দম অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ' লেজেন্ড নাট্যকার জোছন দস্তিদারের 'চার্বাক'-এর পরিবেশনায় মঞ্চে নিয়ে এল 'নীরজাসুন্দরী' নাটক (Bengali Drama NirajaSundari)। নতুন মুখদের সামনে রেখেও যে দুর্দান্ত নাটক উপস্থাপন করা যায়, তা প্রমাণ করল অরিন্দম-খেয়ালী তারকা জুটি। নিজেদের স্টারডমে তাঁরা মঞ্চে বেশিক্ষণ থাকতেই পারতেন, কিন্তু নতুনদেরই বেশি জায়গা করে দিলেন তাঁরা।
নীরজাসুন্দরীর গল্প এক নারী, এক রাধার বেদনকথা। কিন্তু মঞ্চে নাচে গানে ঝলমলিয়ে উঠেছে নীরজাসুন্দরীর প্রেমকাব্য। যে নটী সারা জীবন ধরে খুঁজে চলেছেন তাঁর নদের চাঁদ তাঁর চিরপ্রেমিককে। নাচে-গানে আলোর মেলায় ভরপুর এক আশ্চর্য কাহিনি নাটক 'নীরজাসুন্দরী'।
মৈমনসিংহ গীতিকা-র নির্যাস নিয়ে নাট্যকার অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় রচনা করেছেন 'নীরজাসুন্দরী' নাটক। তবে শুধু নাটক রচনা নয়, এই নীরজাসুন্দরী নাটকে পরিচালনা, অভিনয়, গীত, সঙ্গীত পরিচালনা এবং কোরিওগ্রাফি একাধারে করেছেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় নিজে। প্রযোজনায় 'খেয়ালী অরিন্দম অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ'।
নাটকের শুরুতেই লোকসংস্কৃতি গবেষক অন্নপূর্ণা দেবীর চরিত্রে খেয়ালী দস্তিদারের মঞ্চে প্রবেশ। খেয়ালী এই নাটকের সূত্রধর। নীরজাসুন্দরীর গল্প তাঁর মুখ দিয়েই শুরু হচ্ছে। অন্নপূর্ণা দেবী লোকসংস্কৃতির ওপর গবেষণার জন্য সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বিস্ময়কর ভাবে বললেন, তাঁর এই গবেষণার মূল অনুপ্রেরণা একটি খ্যামটার দল। উন্মোচিত হল তারাপদ দলুইয়ের প্রাচীন খ্যামটার দলের বর্তমান নবোদয় ব্যান্ডে উত্তরণের কাহিনি।
খ্যামটার দলের প্রধান নটী নীরজাসুন্দরী। নীরজা মানিকগঞ্জে পালা করতে এসে প্রেমে পড়ে গেল ওই গ্রামেরই অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে সুখেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বেহুলা-লখিন্দর নাটক করতে গিয়েই নীরজা-সুখেন্দুর প্রণয়কাব্য শুরু হয়। সুখেন্দুর গান মুগ্ধ করল নীরজাসুন্দরীকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সুখেন্দু, নীরজার নদের চাঁদের, নীরজাসুন্দরীর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। ভাঙা ঘরে দু'দিনের খেলাঘর ভেঙে গেল। কারণ মহুয়াসুন্দরী পালা করর সময় মানিকগঞ্জেই একটি খুনের বদনামে জড়িয়ে পড়লেন নীরজাসুন্দরী। খ্যামটা দলের নটীর সঙ্গে প্রেম করার কারণে সুখেন্দু হলেন গ্রামছাড়া।
বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে আবার তারাপদ দলুই তাঁর খ্যামটার দল নিয়ে মানিকগঞ্জে এসে হাজির হল নীরজাসুন্দরীর অভিনীত সেই 'মহুয়াসুন্দরী' পালা করতে। আবার মানিকগঞ্জে নীরজা হাজির, অথচ তাঁর মাথায় অপরাধীর খাঁড়া ঝুলছে। খুনের বদনাম। অন্যদিকে নীরজাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে চলে গেছে সুখেন্দু। নীরজাসুন্দরী কি খুঁজে পাবেন তাঁর নদের চাঁদ সুখেন্দুকে? খুনের বদনাম কি নীরজাসুন্দরীর ঘুচল? এই সবের উত্তর পেতে দেখতে হবে 'নীরজাসুন্দরী' নাটক।
মূলত সিরিয়ালের নতুন মুখ ছেলেমেয়েরাই অভিনয় শিখতে অরিন্দম-খেয়ালী ওয়ার্কশপে আসেন। কিন্তু তাঁদের নতুন স্বপ্ন দেখিয়ে একেবারে মঞ্চে আলোকবৃত্তের সামনে হাজির করেছেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। এত দুর্দান্ত তালিম দিয়েছেন যে নবাগতদের অভিনয় হয়ে উঠেছে চূড়ান্ত বাস্তব। নাটকের মূল চরিত্র নীরজাসুন্দরীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিল্পা মণ্ডল। নীরজাসুন্দরীর প্রেম, পূর্বরাগ, বিরহ সবটা অভিনয় ও শরীরী আবেদনে দুরন্ত পরিবেশন করেছেন শিল্পা। লিড চরিত্রে এক নতুন অভিনেত্রীর দর্শক ধরে রাখার ক্ষমতা মুগ্ধ করার মতোই।
অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে তাঁর মঞ্চপ্রতিমা নীরজাসুন্দরীকে তিলেতিলে তৈরি করেছেন, তা সত্যি প্রশংসাযোগ্য। নীরজার দু'বেলার চরিত্র একাই করেছেন শিল্পা। যখন নীরজা প্রথম যৌবনে নদের চাঁদের বাহুলগ্না, তখন শিল্পার উচ্ছল অভিনয়, আবার যখন নীরজার বেলা ফুরিয়ে আসছে, তখন ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায় নেশাতুর শিল্পার অভিনয় মন কাঁদায়। মঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করলেন তারাপদ দলুইয়ের ভূমিকায় গৌতম ঘটক। তারাপদকে ভিলেন মনে হলেও সে এক ব্যর্থ প্রেমিক। তাই সে বলে, 'আমি তো মোটবাহক, মোট কি তার কখনও নিজের হতে পারে?'
শেষ দৃশ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধ তারাপদর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মনে দাগ কেটে যায়। মন্দিরা তনিমা গাঙ্গুলি আর শশী তপতী ভট্টাচার্য, দুই সহনারী মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করলেন। ধীমান চরিত্রে তারকনাথ ভট্টাচার্য, বংশী শুভম, আশা ব্রততী ব্যানার্জী, মণীন্দ্র সৌদীপ বসু, রমেণ শিবাংশু জোয়ারদার বেশ সপ্রতিভ। নীরজাসুন্দরীর সখীর দলও দারুণ জমিয়ে দিয়েছে।
আর যে চরিত্র এই নীরজাসুন্দরী নাটকের শো স্টপার, তিনি নদের চাঁদ সুখেন্দুর চরিত্রে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি মঞ্চে প্রবেশ করতেই যেন আলো ঝলমল করে উঠল চারিদিক। গ্ল্যামার থেকে গান, প্রতিভার আর এক নাম অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়।
'হঠাৎ করে লখিন্দরের চরিত্র করতে গিয়ে যে কিশোরী মেয়েটাকে ভালবেসেছিলাম, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, মরে যাওয়া লখিন্দরকে বেহুলা প্রেমের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে নতুন জীবন দিয়েছে।'-- সুখেন্দু অরিন্দমের মুখের সংলাপ মনে রাখার মতো। মনসামঙ্গল কাব্যকে নতুন আঙ্গিকে এক প্রেমকাব্যে মঞ্চে আনলেন অরিন্দম।
নীরজাসুন্দরী নাটক দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মেলোডি-বেসড বাংলা গানের উপর। লোকগান আর আধুনিক গানকে একসঙ্গে মিশ্রণ করেছেন সঙ্গীত পরিচালক অরিন্দম। তিনি গায়ক হিসেবেও রয়েছেন এই নাটকে। খালি গলায় মঞ্চে শ্বেতশুভ্র পোশাকে যখন অরিন্দম গান গাইছেন, তখন অ্যাকাডেমির দর্শকরা যেন মন্ত্রমুগ্ধ!
নীরজাসুন্দরী দেখলে মনে আসবেই তরুণ মজুমদারের ছবির ঘরানা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সব মেলোডি গান। অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ছোটবেলার সময়কালটাকে যেন ফিরিয়ে এনেছেন এ যুগে। যতই যন্ত্রযুক্ত গানের দামামা বাজুক চারিদিকে, আজও দর্শক-শ্রোতারা মেলোডি গানে মুগ্ধ হন। তবে শুধু গান নয়, নাটকের আর একটি প্রধান অঙ্গ নাচ। এত দুর্দান্ত কোরিওগ্রাফি করেছেন অরিন্দম, যা তুলনাতীত। নারীচরিত্রগুলি ব্যবহার করে মঞ্চে গাছের অবয়ব তৈরি করা বা দরজার পর্দা ঝুলছে দেখানো-- বেশ অভিনব। গানের সঙ্গে নাচের উপস্থাপনা পরিপূর্ণ। অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের বহুমুখীপ্রতিভাকে প্রণাম জানাই।
নীরজাসুন্দরী আরও জমে গেছে অসামান্য আলোর জাদুর জন্য। মঞ্চে আলো করেছেন অরিন্দম-খেয়ালীর ছেলে আদিত্য সেনগুপ্ত। আদিত্য নিজেও একজন ভাল অভিনেতা কিন্তু এই নাটকে তিনি নেপথ্যে আলোর কারিগর। মঞ্চে ট্রেন যাওয়ার আলোর কাজ বা বিদ্যুতের চমক সৃষ্টি দেখার মতোই। রূপসজ্জায় সুরজিৎ ভাল কাজ করেছেন। খেয়ালীর পোশাক পরিকল্পনাও অপূর্ব।
গবেষক অন্নপূর্ণা দেবীর ব্যক্তিত্ব অসাধারণ ফুটিয়ে তুলেছেন খেয়ালী দস্তিদার। তিনি ছোট্ট চরিত্রেও শুরু ও শেষাংশে নিজের জাত চেনালেন।
তবে নীরজাসুন্দরী নাটকটি শুধু প্রেমকাব্যতেই শেষ হয়নি। পরতে পরতে হয়েছে আরও রহস্য উন্মোচন। কেন নীরজাসুন্দরীর খুনি অপবাদ জুটল? নাটকের শেষে প্রমাণ হয় নীরজা এক অপাপবিদ্ধা নটী। সমাজের ছিছিক্কারের তোয়াক্কা না করে নিজের জীবন সে বাজি রেখেছে কন্যাসমা এক বালিকাকে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে। যেখানে মেয়েটির বাবা নিজেই রক্ষক না হয়ে ভক্ষক। নীরজা সেই ভক্ষকের হাত থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে এবং মেয়েটি পরবর্তীকালে একজন সাংবাদিক হয় নীরজার আনুকল্যেই। এক নটী সে যেমন শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দেয়, তেমনি সে তাঁর প্রেমিক সুখেন্দুর গান পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়েও দেয়। নীরজা-সুখেন্দু বেঁচে থাকবে গানেগানে সুরেসুরে। খ্যামটার কলঙ্ক নয়, বরং সমাজের ঘোমটা খুলে দেয় এই নাটক।
নতুন অভিনেতাদের কণ্ঠস্বর মঞ্চের সবদিকে আরও একটু বেশি পৌঁছতে পারলে ভাল হত। সুখেন্দু যখন নীরজার জীবনে ফিরে আসছে, তখন নীরজাসুন্দরীর এক্সপ্রেশন আরও একটু দরকার ছিল। তবে নতুনরা যেভাবে মঞ্চ মাতিয়ে দিচ্ছে, তাতে এটুকু ভুলচুক মাপ করে দেওয়াই যায়। অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের তুলনাতীত অভিনয় ও উপস্থিতি আবিষ্ট করে রাখে। কর্মব্যস্ত দিনেও অ্যাকাডেমিতে যে বিপুল দর্শক সমাগম হয়েছে তা প্রমাণ করে, ঐতিহ্যকে ঠিক মতো উপস্থাপনা করলে আজও মানুষ গ্রহণ করে।
সবশেষে একটাই কথা বলার, নতুনদের একটু সুযোগ দিলে তাঁরাও দেখিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু নামী মুখ শিল্পীরাই নিজেদেরই সবসময় পাদপ্রদীপের আলোর তলায় রাখতে চান। ব্যতিক্রম অরিন্দম গাঙ্গুলি ও খেয়ালী দস্তিদার। তাঁরা পেছনে থেকে সামনে যেভাবে নতুনদের আলোকিত করে তুললেন, সেই অপত্যস্নেহ তুলনাতীত। নীরজাসুন্দরীর গল্প মন কেমন করাবেই। বাঙালির হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরে পেতে এই নাটক অবশ্যই দেখুন। মন ভরবেই।
ছবি: সন্দীপ কুমার