Latest News

আরো এক পৃথিবী: লন্ডনে বাঙালিয়ানা! কৌশিক, তাসনিয়াদের নিয়ে জীবনের গল্প বললেন অতনু

চৈতালি দত্ত

পরিচালনা- অতনু ঘোষ
অভিনয়- কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য, অনিন্দিতা বসু, তাসনিয়া ফারিন (বাংলাদেশ)

প্রযোজনা- এসকে মুভিজ
রেটিং- ৮.৫/১০

জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক অতনু ঘোষের (Atanu Ghosh) ছবি ‘আরো এক পৃথিবী’ (Aro Ek Prithibi) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল শুক্রবার। গত শনিবার নন্দন ৩-এ এই ছবির বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। এটি অতনু পরিচালিত দশম ছবি।

নিজের লেখা কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপে ছবি তৈরি করতে পছন্দ করেন অতনু। তাঁর ছবি মানেই ভিন্ন স্বাদের গল্প, থাকে অপূর্ব স্বকীয়তা। পরিচালকের অন্য ছবিগুলির চেয়ে আলাদা ‘আরও এক পৃথিবী’। এতে রয়েছে এক ভিন্ন পারিপার্শ্বিকে গল্প বলার অনবদ্য ভঙ্গি। অতনুর প্রতিটি ছবিই প্রথমে জটিল এবং ভাবগম্ভীর মনে হলেও গল্প যখন স্তরের পর স্তর পেরিয়ে আরও গভীরে এগিয়ে চলে, তখন পরিচালকের সুগভীর মনস্তত্ত্বের পরিচয় মেলে। যা এই ছবির ক্ষেত্রেও ফুটে উঠেছে সুনিপুণ মুন্সিয়ানায়। গল্পের বুনন এতটাই শক্তপোক্ত যে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক।

ছবির প্রতিটি দৃশ্যই এত টানটান যে, পর্দা থেকে চোখ সরানো যায় না। ব্রিটেন, চিন, কোরিয়া, উজবেকিস্তানের মতো বিভিন্ন দেশের নানা ভাষাভাষীর অভিনেতা, অভিনেত্রীরা চরিত্রের ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রেখেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।

ইতিপূর্বে বাংলা ছবিতে এত ভাষাভাষীর অভিনেতাদের যথার্থ অর্থে চরিত্র হয়ে ওঠা চোখে পড়েনি। এই ছবির ভাষা ৬০ শতাংশ বাংলা হলেও বাকি ৪০ শতাংশ ইংরাজি।

ভারতের বাইরে লন্ডনের প্রেক্ষাপটে গল্প আবর্তিত। ১১ বছর বয়স থেকে প্রতীক্ষা একটা স্বপ্নকে বয়ে বেড়ায়। তা হল নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ একটি ঘর। যার শিকড়ের ঠিক নেই তার আশ্রয়ের খোঁজ যেন অলীক কল্পনা মনে হয়। চলার পথে নানা ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত প্রতীক্ষা বিয়ের তিন মাস পর লন্ডনে স্বামীর কাছে পৌঁছয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারে, বেশ কয়েকদিন ধরে তার স্বামী নিরুদ্দেশ। বিদেশ বিভুঁইয়ে অসহায় পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে প্রতীক্ষা।

সাত দিনের গল্পে প্রতীক্ষার এই চলনের সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহে আরও তিনটি চরিত্র জুড়ে যায়। প্রতিটি চরিত্রই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতীক্ষা, শ্রীকান্ত, আয়েশা, অরিত্র- চারজনের জীবন কোথাও একটা সুতোয় ঝুলে থাকে।

Image - আরো এক পৃথিবী: লন্ডনে বাঙালিয়ানা! কৌশিক, তাসনিয়াদের নিয়ে জীবনের গল্প বললেন অতনু

প্রতীক্ষার স্বামী অরিত্র পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তার চরিত্র রহস্যে মোড়া। শ্রীকান্ত মুন্সি লন্ডনের বাসিন্দা। সে পার্কে বেহালা বাজায় আর নৌকায় জীবন কাটায়। আয়েশা স্টুডেন্ট কাউন্সিলর।

চরিত্রগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিস্তর চাওয়া পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা, আলো-আঁধারি। সেই আলো-আঁধারিকে দক্ষতার সঙ্গে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন পরিচালক। নিরন্তর এত বিপদের ঝুঁকি এবং প্রতিকূলতার মাঝে এরা কেউ কিন্তু জীবন থেকে পালিয়ে যায় না। জীবনের কাছে কেউ হার স্বীকার করে না। জীবনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।

বিদেশে শ্যুটিং অতনুর ছবিতে এই প্রথম। ছবির কালার প্যালেট, লোকেশন, শিল্পীদের যথার্থ চরিত্রায়ন, পোশাক, সবমিলিয়ে ছবির নকশা এক কথায় অতুলনীয়।

শহরকেন্দ্রিক গল্প হলেও তা বাঙালিয়ানায় মোড়া। ছবিতে অতীত এবং বর্তমান সময়ের যুগলবন্দি অপূর্ব মুন্সিয়ানায় পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। তিনি যে বাহ্যিক অভিনয়ে বিশ্বাসী নন, তা শিল্পীদের কাজ থেকে সহজেই অনুমেয়।

সবচেয়ে প্রশংসনীয় এ গল্পের বুনন। তা অত্যন্ত জোরালো। ছবির গতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে বুনন। ছবিতে প্রলোভন, আতঙ্ক ও ভয়াবহতা থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে মুগ্ধতা, মায়া, সহমর্মিতা।

ছবির চরিত্রেরা প্রত্যেকেই সপ্রতিভ। প্রতীক্ষার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের ‘কারাগার’ এবং ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ খ্যাত তাসনিয়া ফারিন। ইতিপূর্বে এই সিরিজের মাধ্যমে তাঁর অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। তাসনিয়া অভিনীত এটি প্রথম ছবি হলেও তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় মনে দাগ কাটে। নৈহাটি থেকে শুরু করে লন্ডন পর্যন্ত বিরাট জার্নি তাসনিয়ার সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে উত্তীর্ণ।

Image - আরো এক পৃথিবী: লন্ডনে বাঙালিয়ানা! কৌশিক, তাসনিয়াদের নিয়ে জীবনের গল্প বললেন অতনু

এই ছবির বড় প্রাপ্তি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। শ্রীকান্ত মুন্সি চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। হেমিংসের কথায় বিশ্বাসী শ্রীকান্তর মুখে, ‘এ ম্যান ক্যান বি ডেসট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড’ ছাড়াও বহু সংলাপ জীবন্ত হয়ে ওঠে। শ্রীকান্তর যে গভীর জীবনবোধ এবং জীবন দর্শন, কৌশিক তাঁর অভিনয় দক্ষতা এবং সংলাপের মাধ্যমে তা নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কৌশিকের দুরন্ত অভিনয় হৃদয়কে স্পর্শ করে।

আয়েশার চরিত্রে সংকট আছে। কিন্তু সে নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করে। এই চরিত্র যতটাই স্মার্ট, পর্দায় ফুটিয়ে তোলা ততটাই কঠিন। যা অনিন্দিতা বসু তাঁর পরিণত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।

অরিত্রের ভূমিকায় সাহেব ভট্টাচার্যের স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অরিত্রের অসহায়তা সাহেব তাঁর পরিশীলিত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।

Image - আরো এক পৃথিবী: লন্ডনে বাঙালিয়ানা! কৌশিক, তাসনিয়াদের নিয়ে জীবনের গল্প বললেন অতনু

এ ছাড়াও প্রতীক্ষার বাবা-মায়ের চরিত্রে সৌমিত্র চক্রবর্তী, স্বাতী মুখোপাধ্যায়ের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়শৈলী সহজেই মনকে ছুঁয়ে যায়। ভবিষ্যতে বাংলার দক্ষ পরিচালকেরা এই জুটিকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হবেন।

ছবির সংলাপও দুরন্ত। প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে সংলাপ এতটা তাৎপর্যপূর্ণ, যে তা মননকে স্পর্শ করে। আপ্পু প্রভাকরের দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি ছবির আর এক প্রাপ্তি। লন্ডনের লোকেশন তাঁর ক্যামেরায় এতটাই প্রাণবন্ত, যা প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। সুজয় দত্ত রায়ের সম্পাদনাও যথেষ্ট প্রশংসনীয়। দেবজ্যোতি মিশ্রের সুরারোপিত গান প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে মর্মস্পর্শী। ‘যতটা জীবন দুটো হাতে ধরে’ গান দৃশ্যের সঙ্গে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

এই ছবি কোনও অপরাধের কথা বলে না। কিন্তু এক মুহূর্তের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে মানুষের সব কিছু নিমেষে শেষ হয়ে যেতে পারে, সেই বার্তা দেয় ‘আরও এক পৃথিবী’। ভবিষ্যতে এই ধরনের সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, ছবিতে কি তারই ইঙ্গিত দিলেন পরিচালক?

সংবেদনশীল এই ছবি দর্শকের মনে আশা জোগাবে। এই ছবি অবশ্যই সিনেমা হলে দেখা উচিত।

ইতিপূর্বে আওরঙ্গবাদ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবি দর্শক সমালোচকদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। এক সপ্তাহ পরে এই ছবি আমেরিকায় মুক্তি পাবে। ছবির প্রযোজক অশোক ধানুকা, হিমাংশু ধানুকা।

‘পাঠান’ দেখতে ভারতযাত্রা, বাংলাদেশের শাহরুখ-ভক্তের কীর্তি ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়

You might also like