অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ।
শেষ আপডেট: 7th July 2024 17:56
ছবি: অরণ্য'র প্রাচীন প্রবাদ
পরিচালনা: দুলাল দে
শ্রেষ্ঠাংশে: জিতু, সুহোত্র, শিলাজিৎ, মিথিলা
দ্য ওয়াল রেটিং: ৭.৫ / ১০
তপন সিনহার বিখ্যাত ছবি ছিল, 'এক ডক্টর কী মউত'। এই নামের মধ্যেই যেন সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত 'অরণ্যর প্রাচীন প্রবাদ' ছবির কাহিনি লুকিয়ে আছে। দাপুটে ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল দে খেলার মাঠ থেকে চলচ্চিত্র আঙিনায় পা রাখলেন এই ছবি দিয়ে। নবাগত পরিচালক তাঁর প্রথম ছবিতে রীতিমতো দাপট দেখালেন, আগের পেশার মতোই।
এই ছবিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান, খেলার মাঠ আর রহস্যের ত্রিধারাকে এক করেছেন দুলাল দে। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটি, শবর, গোয়েন্দা গিন্নি, মিতিন মাসির পরে টালিগঞ্জ পেল এক নতুন গোয়েন্দা অরণ্য চ্যাটার্জীকে। এই ভূমিকায় জিতু কামাল। অনীক দত্তর 'অপরাজিত'-তে সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র করার পরে বহু দর্শক চেয়েছিলেন জিতুই হোক নতুন ফেলুদা। তা হয়নি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করার পরে গোয়েন্দা চরিত্রেই কামব্যাক করলেন জিতু। এবার তিনি গোয়েন্দা অরণ্য। মাঝে জিতু কিছু ছবি করলেও, আলোচিত লিড রোলে অনেক দিন পরে দেখা গেল তাঁকে।
ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, একই সঙ্গে এক ভাল ক্রিকেটার-- গোয়েন্দা অরণ্য। পানাঘাট এলাকা জুড়ে এগিয়েছে গল্পের প্লট। তরুণ জনদরদী ডাক্তার অমিত রায়ের (সুহোত্র মুখোপাধ্যায়) মৃত্যুরহস্য কিনারায় এক বছর ধরে লড়ে যাচ্ছে পুলিশ। শেষে ডাক পড়েছে সিআইডি-র পদস্থ অফিসার সুদর্শনের (শিলাজিৎ মজুমদার)। সম্পর্কে তিনি অরণ্যর জামাইবাবু। পানাঘাটে সেই জামাইবাবুরই সঙ্গী হয় অরণ্য। পানাঘাট গিয়ে সুদর্শনের সহকারী সন্দীপ ওরফে স্যান্ডি (সায়ন ঘোষ) হয়ে যায় জিতুর সহকারী। জামাইবাবুর সৌজন্যে অমিত রায় হত্যা রহস্যের ফাইল এসে পড়ে অরণ্যের হাতে। সেই ডায়েরি ধরেই পরতে পরতে ফ্ল্যাশব্যাকে খুলতে থাকে রহস্যের জট। আর এই রহস্যের মাঝেই জড়িয়ে থাকেন এক নার্স, যিনি ডাক্তার অমিত রায়ের প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হয়েছিল। সে চরিত্রে মিথিলা। এই নার্স কি জিতুর জীবনেও ছায়া ফেলবে?
দুলাল দে-র গল্পে মূলত দুই হিরো। জিতু কামাল এবং সুহোত্র মুখোপাধ্যায়। একজন অতীত, আরেকজন বর্তমান। কিন্তু অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন দুর্দান্ত করেছেন নবাগত পরিচালক। দুলাল দে-র প্রথম পরিচালনায় এখানেই কৃতিত্ব, যে তিনি দুই সময়ের পরিস্থিতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন বারবার। ফোন কলের শব্দ বা কথার পিঠের কথা বসিয়ে অতীত আর বর্তমান দৃশ্যকে মিলিয়েছেন তিনি। দুলাল তুখোড় ক্রিকেট সাংবাদিক। তাই খেলা বাদ দিয়ে তাঁর চিত্রনাট্য তৈরি হয়নি। খেলা আর সিনেমার প্লটকে সংলাপে দুরন্ত ভাবে মিলিয়েছেন তিনি। প্রথম পরিচালনার কিছু জায়গা হয়তো আলগা, কিন্তু রহস্য গল্প এত সিরিয়াস ছন্দে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যা প্রশংসনীয়। নবাগত হিসেবে তিনি আশা বাড়িয়েছেন।
অন্যদিকে গোয়েন্দা রূপেও জিতু প্রথম এই অবতারে। ডাক্তারির ছাত্র অরণ্য হঠাৎই কৌতূহলে গোয়েন্দা হয়ে ওঠে। খুব সাবলীল ভাবেই সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন জিতু। এই নতুন গোয়েন্দার প্রেমে অনেকেই পড়বেন। তবে এ ছবি কেবল জিতুময় নয়। সহ-অভিনেতা হলেও সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় দাগ কাটে দর্শকের মনে। অঞ্জন চৌধুরীর 'জীবন নিয়ে খেলা'র রঞ্জিত মল্লিক যেন সুহোত্র। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে খুন হয় সে। মৃত চরিত্রের অভিনয় করেও তিনি ছবি জুড়ে কী সজীব!
ওটিটি সিরিজেই বেশি কাজ করলেও ছবিতে তাক লাগিয়ে দিলেন সুহোত্র। রোম্যান্স থেকে অন্তর্দ্বন্দ্ব-- তাঁর চোখেমুখে খেলেছে বেশ। ছবির রাশ অনেকখানি তিনি ধরে রেখেছেন। টলিউডে ভবিষ্যতের সাবলীল অভিনেতা রূপে সুহোত্র অনেকের মণিকোঠায় থাকবেন। রাফিয়াত রশিদ মিথিলা 'ও অভাগী'র পরে কলকাতার ছবিতে আবার ছাপ রাখলেন। মিথিলার সবথেকে বড় গুণ, ওঁর উচ্চারণে বাঙাল ভাষার টান নেই সেভাবে। জিতু বা সুহোত্রর বিপরীতে মিথিলা এ ছবিতে থাকলেও, বাস্তবে তিনি দুই অভিনেতার থেকেই বয়সে বড় কিছুটা। মেক আপ আর অভিনয়ে মিথিলা সেটা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। অভিনেতাদের সঙ্গে তাঁর রসায়নও ভাল হয়েছে, যা বয়সের ফারাক ঢেকে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কুড়ির কোঠার ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র হিসেবে জিতুর চেহারা পর্দায় একটু বেশি বড় লেগেছে। তবু জিতুর জিমচর্চিত সৌষ্ঠবে অনেকেই কাত হবেন।
শিলাজিৎ ফর্মাল পোশাকে বেশ সুন্দর অভিনয় করলেন। 'অযোগ্য'র পর আবারও শিলাজিতের অভিনয়ে মুগ্ধ হবেন দর্শকরা। সায়ন ঘোষ সহকারীর চরিত্রে কমিক টাইমিং জমিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে 'নাটা' বলে ব্যঙ্গ ক'জন করতে পারে, যা সায়নের গুণ বৈকী! পার্শ্বচরিত্রে লোকনাথ দে স্বাভাবিক ছন্দেই ভাল অভিনয় করেছেন। তাঁর স্ত্রীর চরিত্রে অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় বা স্পষ্ট সংলাপ বলার থেকেও রূপ দেখিয়েছেন বেশি। ধূসর চরিত্রে বরাবরের মতো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জমিয়ে দিয়েছেন। ততটাই নজর কেড়েছেন নীলাদ্রি মৈত্র।
শুভদীপ মিত্রর সংগীতায়োজন ভাল লাগে। আবহ সঙ্গীত ছবির গতি বাড়াতে সাহায্য করে। ক্যামেরায় প্রতীপ মুখোপাধ্যায় যথাযথ।
'অরণ্য'র প্রাচীন প্রবাদ' ছবিতে সংলাপ থেকে প্লটে বারবার ক্রিকেটের স্পর্শ এনেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল দে, যা বেশ অভিনব কায়দায় মন ভরায়। সামগ্রিক দিক দেখলে কিছু খুঁত চোখে পড়বে, তবু টানটান চিত্রনাট্যের এ ছবি নবাগত পরিচালকের স্বপ্নপূরণ। দুলাল দে দর্শকদের নিরাশ করেননি। একথা বলাই যায়, যে নতুন পরিচালক পেল টলিউড।