শেষ আপডেট: 18th February 2024 18:26
ষাটের দশকে দমকা হাওয়ার মতো টালিগঞ্জ পাড়ায় এসেছিলেন যে নায়িকা তিনি অঞ্জনা ভৌমিক। সুচিত্রা সুপ্রিয়া সাবিত্রীর পরের দশকে অঞ্জনা ডানা কাটা সুন্দরী ছিলেন না। কিন্তু ষাটের দশকে স্মার্ট নায়িকা হিসেবে অঞ্জনা ভৌমিক শিরোনামে উঠে আসেন। মাত্র ১৬ টি বাংলা ছবি করেছেন অঞ্জনা তার মধ্যে ৭ টি ছবিতে অঞ্জনার বিপরীতে উত্তমকুমার। যা অঞ্জনাকে প্রথম সারির নায়িকা করে তোলে। কিন্তু বিয়ের পর অঞ্জনা ক্রমশ বাংলা ছবির জগতকে বিদায় জানান। ১৯৮৭ তে অবশ্যি অঞ্জনার শেষ ছবি 'নিশিবাসর' রিলিজ করে। তারপর একেবারেই নিজেকে গ্ল্যামার জগত থেকে আড়ালে নিয়ে যান। অঞ্জনা নৌবাহিনীর কর্মকর্তা অনিল কুমার শর্মাকে বিয়ে করেছিলেন। সুখী দাম্পত্য। অনিল-অঞ্জনার দুই কন্যা নীলাঞ্জনা ও চন্দনা। মেয়েদের মানুষ করতে নিজের সবটা দিয়ে দেন অঞ্জনা। উত্তমকুমারের নায়িকা হয়েও একটা সময়ের পর অঞ্জনা ভৌমিক ছেড়ে দেন গ্ল্যামার জগতের মোহ। আর কখনও খবরেই আসেননি তিনি। দূরদরর্শনের পর্দাতেই শুধু পুরনো বাংলা ছবিতে ভেসে উঠত তাঁর মুখ। অঞ্জনা ফ্যানেরা বরাবর তাঁদের প্রিয় নায়িকাকে মনে রেখেছিল।
অঞ্জনা ছবির জগত থেকে সরে গেলেও তাঁর কন্যারা গ্ল্যামার জগতেই এসেছিল নায়িকা হতে। অঞ্জনা ভৌমিক আবার শিরোনামে এলেন তাঁর মেয়েদের যৌবনে। ২০০১ সাল। না তখন আর অঞ্জনা অভিনয়ে ফেরেননি। নীলাঞ্জনা শর্মা বাংলা ছবিতে ডেবিউ করলেন। 'মায়ের মেয়ে' এই পরিচয়েই নীলাঞ্জনা টালিগঞ্জ পাড়ায় পা রেখেছিলেন। তখন সুব্রত সেন বিখ্যাত অভিনেত্রী মায়েদের মেয়েদের নিয়ে ছবি করছিলেন। অপর্ণা সেন কন্যা কঙ্কনা সেনশর্মা প্রথম ছবি করেন সুব্রত সেনের 'এক যে আছে কন্যা'। ঠিক তারপর অঞ্জনা ভৌমিকের বড় মেয়ে নীলাঞ্জনা সুব্রত সেনের দ্বিতীয় ছবি 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা' র নায়িকা হন। নীলাঞ্জনার বিপরীতে ছিলেন সুব্রত দত্ত ও বাংলাদেশের ফেরদৌস। ২০০২ সালে রিলিজ করে 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা'। মেয়ের জন্য ছবির প্রচারে মাঝেমধ্যেই দেখা গেছিল মা অঞ্জনাকে। প্রৌঢ়া অঞ্জনা তখনও বেশ স্মার্ট ও গ্ল্যামারাস। লাল শাড়িতে এসে দাঁড়াতেন মেয়ের সঙ্গে। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আলোচিত হলেও ফ্লপ হল। বিএফজে পুরস্কারে সেরা ছবি হয়েছিল এবং নীলাঞ্জনা সেরা উদীয়মান অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।
এরপর শ্রীলেখা মিত্র, কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলাঞ্জনা তিন কন্যা মিলে করলেন 'তিন এক্কে তিন'। নন্দনে বেশ চলেছিল ছবিটি। তখনকার এসব ছবি আলোড়ন না ফেললেও বেশ নতুন ধারার কাজ হত। ২০০৭ এ 'আমরা' ছবিতেও দেখা মেলে নীলাঞ্জনার। টলিউডে ক্যারিয়ার না জমাতে পেরে নীলাঞ্জনা চলে যান বম্বে। তথাকথিত ঘরোয়া বাঙালি মেয়েদের মতো নীলাঞ্জনার চেহারা ছিল না। অনেকটাই লম্বা ছিলেন তিনি। যে কারণে বাংলার নায়কদের সঙ্গে মিসফিট হয়ে পড়ছিলেন। বম্বেতে হিন্দি অনেক সিরিয়াল করেছেন তিনি হিপ হিপ হুর রে, স্যাটারডে সাসপেন্স, জানেমন জানেমন, রিস্তে। বাংলা ছবিতে নীলাঞ্জনা ফ্লপ অভিনেত্রী হলেও বাংলা টেলিভিশনে নীলাঞ্জনা কিন্তু সফল প্রযোজক। যীশুর সেনগুপ্তর পছন্দ ছিল লম্বা মেয়ে। তাই নীলাঞ্জনার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধেন যীশু। যীশু নীলাঞ্জনার প্রযোজনা সংস্থা বানিয়েছিল হিট সিরিয়াল 'তোমায় আমায় মিলে', 'অপরাজিত', 'ভালবাসা ভালবাসা', 'হরগৌরী পাইস হোটেল'। বা এখনকার 'লাভ বিয়ে আজকাল' ধারাবাহিক। তবে যীশু নীলাঞ্জনা প্রযোজনায় ক্লাসিক শো ঋতুপর্ণ ঘোষের 'ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি'। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের টক শো 'সঙ্গে সৃজিত' ও সাময়িক সময়ের জন্য শিরোনামে ছিল। প্রযোজক, স্ত্রী এবং মা হিসেবে নীলাঞ্জনা দশে বারো পাবেন।
দিদি নীলাঞ্জনার থেকেও বাংলা ছবিতে বেশি সফল ছিলেন ছোট বোন চন্দনা শর্মা। চন্দনা বিজ্ঞাপনে ছিলেন জনপ্রিয় মডেল। বম্বেতে হিন্দি সিরিয়ালে সফল ছিলেন চন্দনা। প্রথম বাংলা ছবি করতে এসেও সুপারহিট দেন চন্দনা। ২০০৪ সালে রবি কিনাগির পরিচালনায় ‘প্রেমী’ ছবিতে টলিউড সুপারস্টার জিৎ এবং জামাইবাবু যীশু সেনগুপ্তের বিপরীতে নায়িকা হন চন্দনা। সাথী ছবির পর প্রেমী ছিল জিতের ক্যারিয়ারে বড় হিট। চন্দনাও নায়িকা হিসেবে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি ‘মনে রেখো আমার এ গান’ গানটিতে তার অভিনয় আজও জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার দর্শকদের মধ্যে। তবে এরপরে আর তাঁকে বিশেষ বাংলা সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা যায়নি। চন্দনা যদি বাংলা ছবিতে থাকতেন চন্দনা-জিৎ ভাল জুটি হতে পারতেন ভেবেছিল তাঁদের ফ্যানেরা। বক্সঅফিস হিট ছবি করেও চন্দনা কেন বাংলার পরিচালকদের ডাক পেলেন না, সেটাই বড় প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
নীলাঞ্জনা যেমন বাংলার অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তকে বিয়ে করছেন, তেমন চন্দনার স্বামীও বম্বের অভিনেতা পরিচালক রামানদীপ আর্য। অঞ্জনার মেয়েরা মায়ের মতো অভিনয় জগতে প্রতিযোগিতার দৌড়ে নাম লেখাননি। ভাল লেগেছে, অফার এসেছে, ছবি করছেন, ব্যস! এটুকুই। পারিবারিক জীবনে মা মেয়েদের বন্ধন চিরদিন অটুট ছিল। অঞ্জনা ভৌমিক শেষ জীবনে অসুস্থতার শিকার হলেও পারিবারিক দিকে মেয়ে জামাই নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ সুখীই ছিলেন।