শেষ আপডেট: 22nd July 2024 19:18
নায়িকা বেশ মেজাজি। এই হাসিখুশি, কিছুক্ষণ পরেই বেজায় রেগে যান। খুব রগচটা। রেগে গেলে অনেক সময়েই যা মুখে আসে, তা-ই বলে দেন। তখন নাকি গালিগালাজও করে বসেন অনেককে। এতে তাঁর ইমেজ খারাপ হয় সেসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। অল্পবয়সী নায়িকা। মাথা ঠান্ডা হলেই আবার সব ঠিক। রূপটান নেওয়ার পর সে সব ভুলে একেবারে অন্য মানুষ। অভিনয়ে কোনওদিন কোনও খামতি নেই। কিন্তু কাউকে কেয়ার করতেন না। আর ছিল স্বল্প সময়ে পাওয়া বিশাল স্টারডম ও সবসময় একাধিক ছবির অফার। তিনি আর কেউ নন; দর্শকের নয়নের মণি, মহুয়া রায়চৌধুরী।
ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতায় মহুয়া বদমেজাজি হয়ে পড়তেন। নাবালিকা বয়স থেকে স্ট্রাগল শুরু তাঁর। তিনি যেন টাকা রোজগারের যন্ত্র, সোনার ডিম পাড়া হাঁস। পুতুলনাচের পুতুল হয়ে ছোট থেকে নেচে-গেয়ে ফাংশন করতে হত তাঁকে। ফিল্মে আসার পর খ্যাতি হল, যশ হল, কিন্তু টাকার মেশিন হিসেবে তাঁকে খেটে যেতেই হল। আরো উন্নতির নেশা, আরো খ্যাতির নেশা মহুয়াকে বিশ্রাম নিতে দিত না। তবে যতই বদরাগী হন মহুয়া তাঁর ছিল অনেক গুণ। মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা আর অতিরিক্ত পশুপ্রেম। সত্তর আশির দশকে এত পশুসেবার সংস্থা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তখন থেকেই পশুদের প্রতি বিশেষত রাস্তার কুকুর বেড়ালদের প্রতি মহুয়ার ছিল অসম্ভব ভালবাসা। আর এই জন্য মহুয়াকে অনেক সময় নাস্তানাবুদও হতে হয়েছিল।
১৯৭৯ সাল। 'জয় পরাজয়' ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। মহুয়ার বিপরীতে নায়ক সন্তু মুখোপাধ্যায়। তখনও 'দাদার কীর্তি' রিলিজ করেনি। তাই মহুয়ার হাতে অনেক ছবি থাকলেও সেই বিশাল স্টারডম তখনও তিনি পাননি। কখনও পার্শ্বচরিত্রে কখনও বা নায়িকার ভূমিকায় তাঁকে দেখা যাচ্ছে। 'জয় পরাজয়' ছবির শ্যুটিং করতে মহুয়া আউটডোর গেছিলেন বসিরহাটে। সঙ্গে তাঁর ব্যাঙ্ক চাকুরে স্বামী তিলক। মহুয়া আর তিলক উঠেছেন বসিরহাটের সম্ভ্রান্ত এক উকিলবাবুর বাড়িতে।
শ্যুটিং হচ্ছে। খাওয়া-থাকার কোনও অভিযোগ নেই। বেশ চলছিল। কিন্তু গণ্ডগোল বাঁধাল নায়িকার পশুপ্রীতি। জন্তু-জানোয়ার অনেকেই ভালবাসেন, কিন্তু এ ভালবাসা একেবারে মাত্রাছাড়া। যাকে বলে অন্ধপ্রেম। ঝামেলা হল বসিরহাটে।
সারাদিন শ্যুটিং শেষে রাত্রে খেতে যেতে হবে অন্য একটা বাড়িতে। মহুয়া ও তাঁর স্বামী রওনা দিলেন সেই বাড়ির দিকে। কাছেই বাড়ি তবু গ্রামের অন্ধকার রাস্তা। তখন বসিরহাট এত উন্নত হয়নি। গ্রামের ছোঁয়া চারিদিকে। ওঁদের ঠিক পেছন আসছিল উকিলবাবুরই এক ছেলে।
পুকুর পাড়ে দুটি রাস্তার কুকুর মারপিঠ করছিল নিজেদের মধ্যে। ছেলেটি ভাবল কুকুরগুলো যদি নায়িকাকে কামড়ে দেয়! কেননা মহুয়াকে যেতে হবে ঐ পুকুর পাড় দিয়েই। সেই উকিলবাবুর ছেলে তো আর নায়িকার পশুপ্রেমের সংবাদ জানতেন না ।তিনি আধলা ইট তুলে নিয়ে মারলেন কুকুর দুটোকে। গ্রামের ছেলের অব্যর্থ টিপ। কুকুরগুলো আঘাত পেয়ে চিৎকার করে উঠল।
আর সেই চিৎকারে নায়িকার পশুপ্রীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তখনকার সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত। ঠোঁটকাটা ভাষায় লিখতে পারলেই কাগজ বিক্রি হবে বেশি। সেই সময়ের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক লিখেছিলেন, "আর তখনই নায়িকা তাঁর বন্য স্বভাবটা প্রকাশ করে ফেলেন! ভদ্র নায়িকার মুখের এ কী ভাষা!"
কী বলেছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী? রেগে গেলে তাঁর মাথার ঠিক থাকত না। কে আশেপাশে আছে দেখার দরকার নেই। তিনি মুখে যা আসবে বলবেন। বাংলা ছবির জনপ্রিয় নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরী বসিরহাটে যে উকিলের বাড়িতে উঠেছেন তাঁর ছেলেকেই বলে উঠলেন "এই কুকুরের বাচ্চা, তুই কুকুরটাকে মারলি কেন রে! ও তোর কী ক্ষতি করেছিল?"
ছেলেটি অবাক! বলল "আমি তো রাস্তার কুকুর যাতে আপনাকে না কামড়ায় তাই ইঁট মারলাম। আপনাকে বাঁচাতে! আর আপনি আমায় গালাগাল দিলেন!"
দিকে দিকে এই বার্তা রটে গেল। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল মহুয়ার কাছে। তাঁদের দাবী হিরোইনকে ক্ষমা চাইতে হবে। সেটা এ যুগ নয়। এ যুগে হলে পশুপ্রেমের জন্য মহুয়ার পক্ষেই সবাই দাঁড়াতেন। কুকুর নিয়ে ভাইরাল হওয়ার যুগ তো সেটা ছিল না। কুকুরের জন্য আইন অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি কেউ ভাবতেই পারত না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মহুয়া কোথাও একটা প্রতিবাদ তো করেছিলেন। আবার ছেলেটিও মহুয়ার বিপদ যাতে না হয় সেটা ভেবেই কুকুরদের আঘাত করেছিল।নাহলে যে গ্রামের বদনাম হবে। যাকে বলে উভয় সংকট।
কিন্তু মহুয়া এতটুকু দমলেন না। সাংবাদিকরা লিখলেন "মহুয়ার ভাবখানা এমন 'আমি কেন গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাইব! কভি নেহি"
যাই হোক রাতটা কোনও রকমে কাটল। পরদিন সকালে মহুয়া ঘোষণা করলেন "পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া অভিনয় করব না।" এবং করলেন না।
'জয় পরাজয়' ছবির শ্যুটিং বসিরহাটে আর হল না। পুলিশ সাহায্যের আশ্বাস দিতে পারল না। কারণ গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত। জনরোষের হাত থেকে বাঁচার জন্য শেষ পর্যন্ত মহুয়া পালিয়ে এলেন কলকাতায়।
মহুয়া-সন্তু অভিনীত 'জয় পরাজয়' ছবিটি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছিলেন ঠাকুর দাস হাজরা।
শ্রী দুর্গা চিত্রমের নিবেদিত 'জয় পরাজয়' সত্তর আশির দশকে আর রিলিজ করেনি। চাপা পড়ে গেছিল ছবিটি। মহুয়ার মৃত্যুর বহু পরে নব্বই দশকের শুরুতে এই ছবিটি মুক্তি পায়। ছবির নাম বদলে হয়ে যায় 'জাগরণ'।
মহুয়া-সন্তু ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, নন্দিনী মালিয়া, বোধিসত্ত্ব মজুমদার, পদ্মা দেবী। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে দুটি অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল ছবিতে। 'গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ' এবং 'আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে'। ছবি রিলিজ মহুয়া দেখে যেতে পারেননি।