Latest News

বাংলার অনুপ কুমার দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা! মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন খোদ শাম্মি কাপুর

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার আর এক নাম শাম্মি কাপুর। বলিউডে নতুন ডান্স ফর্মের প্রবর্তক যে মানুষটির প্রতিভা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর অনাবিল আনন্দময় অভিনয় দর্শককে দুলিয়ে দিত, তা আজও কেউ কপি করতে পারেননি। শাম্মি কাপুরকে যেন বলা যায়, ভারতীয় ছবির এলভিস প্রিসলি।

শাম্মির জন্ম মুম্বাইয়ে, ১৯৩১ সালের ২১ অক্টোবর। বাবা স্বনামধন্য অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুর ও মা রামশারনি কাপুর। শাম্মি কাপুরের আসল নাম শমশের রাজ কাপুর। কিন্তু সিনেমার প্রয়োজনেই নাম বদলে হয় শাম্মি কাপুর।

শাম্মি কাপুর বললেই আজও মনে পড়ে যায় একগুচ্ছ হিট সিনেমা আর একগুচ্ছ কালজয়ী সুপারহিট গান। শাম্মি কাপুর আর মহম্মদ রফি ছিলেন এই বিষয়ে এক দারুণ জুটি। শাম্মি কাপুর না এলে বোধহয় রফির গানগুলোও এতটা জনপ্রিয়তা পেত না। আবার উল্টোটাও ঠিক। দুজন দুজনের পরিপূরক। বলিউডের সেরা দশটা ডান্স নাম্বার নির্বাচন করলে এক বা একাধিক জায়গায় শাম্মি কাপুরের ছবির গান আজও আসবে।

‘ব্রহ্মচারী’, জঙলি’, ‘বাত্তামিজ’, ‘ব্লাফমাস্টার’ ‘পাগলা কাহি কা’, ‘তিসরি মঞ্জিল’,’এন ইভনিং ইন প্যারিস’,  ‘কাশ্মীর কি কলি’, ‘রাজকুমার’, ‘জানওয়ার’ — পরপর ছবিতে অনেক নায়িকাই শুরুর সময়ে হিরো হিসেবে পেয়েছেন শাম্মি কাপুরকে। আর কালক্রমে সেই নায়িকারা নিজেদের নিয়ে যেতে পেরেছেন কিংবদন্তি অভিনেত্রীর তকমায়। যেমন সায়রা বানু, আশা পারেখ কিংবা আমাদের শর্মিলা ঠাকুর।

কিন্তু জানেন কি, শাম্মি কাপুর তাঁর বিশাল কেরিয়ারে একটি বাংলা ছবিও করেছিলেন? শুধু তাই নয়, শাম্মি কাপুর সেই বাংলা ছবি করতে এসে আমাদের বাংলার অভিনেতা অনুপ কুমারকে প্রশংসা করে বলেছিলেন, তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা! বাংলা ছবির জগতে এ প্রশংসা বাঁধাই করে রাখার কথা ছিল। কিন্তু অনুপ কুমার যেমন আন্ডার-রেটেড থেকে গেলেন, তাঁর প্রতিভার সদ্ব্যবহার যেমন করাই হল না তেমন করে, এ প্রশংসাও তেমনি চাপা পড়ে গেল সব কিছুর আড়ালে।

সালটা ১৯৯১। বাংলা ছবি পরিচালনা করছেন মুকুল দত্ত। ছবির নাম ‘মহাশয়’। মুকুল দত্তর অনুরোধ বম্বেতে বসে ফেলতে পারেননি শাম্মি কাপুর। নামভূমিকায় মহাশয় হলেন স্বয়ং শাম্মি কাপুর। বাংলা ছবি করার ইচ্ছেও পূরণ হল তাঁর। কারণ শাম্মি কাপুরের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরুই করেছিলেন টালিগঞ্জ স্টুডিওতে। সেই সূত্র থেকে রাজ কাপুর, শাম্মি কাপুররা ছোটবেলা থেকেই বাংলা ছবিকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছেন, এ কথা সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন শাম্মি কাপুর।


‘মহাশয়’ সিনেমার গল্প ছিল, প্রেম সিং একজন ধনী ও উদার মনের ব্যবসায়ী। তিনি অবাঙালি হয়েও বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি খাবার ভালোবাসেন। বাঙালি মহাশয় হতে চান মনেপ্রাণে। সেই চরিত্রে অভিনয় করেন শাম্মি কাপুর। অকৃতদার প্রেম সিং একজন ছেলেকে দত্তক নেন, যে জন্মসূত্রে বাঙালি। কিন্তু তার নাম হয় ইন্দ্রজিৎ সিং। এই চরিত্রটি করেন তাপস পাল। প্রেম সিংয়ে কোম্পানিতে প্রেম সিংয়ের সেক্রেটারি মণিকার ভূমিকায় ছিলেন গ্ল্যামারাস মুনমুন সেন। মুনমুনের প্রেমে পড়ে তাপস। এভাবেই মিষ্টি প্রেম আর পিতা-পুত্রর মজার ঘটনা, দ্বন্দ্ব– এসব দেখানো হয় বিগ বাজেট ‘মহাশয়’ ছবিটিতে।

ছবির বেশিরভাগ শ্যুট হয়েছিল দার্জিলিঙে। দার্জিলিঙের ঝলমলে চমৎকার আবহাওয়ায় শাম্মি কাপুরের মনও আরও ঝলমলে হয়ে উঠেছিল। আর তাতে হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল হয়ে ছিল সদাহাস্যময় অনুপ কুমারের উপস্থিতি। অনুপ কুমার তো শুধু কমেডিয়ান নন, একজন অসামান্য প্রতিভাবান অভিনেতাও। সেটা তাঁর ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘আলোর পিপাসা’ এমনকি অঞ্জন চৌধুরীর ‘মায়া মমতা’ বা ভবেশ কুণ্ডুর ‘বৌরানি’ দেখলেই বুঝতে পারি। অনুপ কুমার, যিনি একইসঙ্গে, একই সময়ে দুটো ছবি করেছেন, যেখানে একটায় তিনি যুবক অন্যটিতে বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। আবার ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’তে ছোট্ট বুম্বা অর্থাৎ প্রসেনজিতের কাকু হয়েছিলেন অনুপ, ‘অহংকার’ ছবিতে নায়ক প্রসেনজিতের বন্ধুর রোল করছেন কত যুগ পরে, সেই একই অনুপ। এই যে চরিত্রের সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেওয়া ছিল অনুপের প্লাস পয়েন্ট।

শাম্মি কাপুর সেবার অনুপকুমারের সঙ্গে শ্যুটিং করার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন “বোম্বাই আর কলকাতার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মিলিয়ে ‘মহাশয়’ ছবিটি হয়। যাদের মধ্যে মুনমুন সেন আর সুস্মিতা মুখার্জীকে আমি আগেই দেখেছি। তাপস পাল নামে বাংলা ছবির এক নায়কের সঙ্গেও আলাপ হল। তবে এই সমস্ত আলাপের মধ্যে যেটা আমার মনে বিশেষ করে দাগ কেটেছিল, তা হল অনুপ কুমারের আন্তরিকতা। যেটা আমি অনুভব করেছিলাম এই মানুষটির মধ্যে একটা অপূর্ব ব্যক্তিত্ব আছে, যা অন্য মানুষদের সহজেই আপন করে নিতে পারে।”

শাম্মি কাপুরের সঙ্গে ‘মহাশয়’ ছবিতে অনুপের অনেক বেশি দৃশ্য ছিল, তাই হৃদ্যতাও বেশি হয়। একটাই বাংলা ছবি সারাজীবনে করেছেন শাম্মি, কিন্তু মনে রেখেছেন অনুপ কুমারের প্রতিভা ও আন্তরিক ব্যবহারকে। শাম্মি কাপুরের কথায়, তিনি ভারতবর্ষের ডাকসাইটে সব অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন কিন্তু অনুপ কুমারের সঙ্গে আগে অভিনয় করেননি। প্রথম সাক্ষাৎ দুজনের এই ‘মহাশয়’ ছবির সূত্রেই। অনুপ কুমার তাঁর চোখে দীর্ঘ অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উঠে আসা বড় মাপের অভিনেতা।

শাম্মি কাপুর বলেছিলেন “অনুপ কুমারের কাছে অভিনয়টা কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। আমি নাকি সুপারস্টার বম্বের, কিন্তু অনুপ কুমার আমার থেকে অনেক বড় অভিনেতা। অনুপ কুমার ইচ্ছে করলে ও সুযোগ পেলে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠতে পারতেন। শুনলাম পঞ্চাশ বছরের বেশি বাংলা ছবিতে অভিনয় জীবন ওঁর। আশ্চর্য ! কত বয়স ওঁর? চেহারা দেখে তো বোঝার উপায় নেই। চেহারাটা ওঁর বড় সম্পদ, যা দিয়ে অনায়াসে যুবক বা বৃদ্ধ– যে কোনও রোলে মানিয়ে যান। আর তিনি যে সিরিও-কমিক অভিনয় করেন, সেই ধারার অভিনেতাও ভারতবর্ষে খুব কম আছেন। নিজস্ব কিছু মুদ্রাদোষকেও তিনি চরিত্রের সঙ্গে অনায়াসে মিলিয়ে দিতে পারেন। যা কিন্তু সহজ নয়। প্রতিভা, অভিজ্ঞতা আর অনুশীলনের মেলবন্ধন হলেন অনুপ কুমার।”


‘মহাশয়’ ছবির কিছু শ্যুটিং কলকাতার স্টুডিওতেও হয়েছিল। তাই সেবার কলকাতায় এসেছেন শাম্মি কাপুর। চারিদিকে সাংবাদিক, ক্যামেরা। এসবের মধ্যেই শ্যুট চলছে। একটা দৃশ্যের কম্পোজিশন ঠিক করলেন পরিচালক মুকুল দত্ত। টেক শুরু হবে। মুনমুন সেন, তাপস পাল, শাম্মি কাপুর আর অনুপ কুমার রয়েছেন সিনে।

হঠাৎ টেকনিশিয়ানদের কেউ একজন বলে উঠলেন, “অনুদা…।” তাতেই অনুপ যা বোঝার বুঝে গেলেন। লাইটটা ঠিক নেওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে অনুপ বললেন, “ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। আমি নিয়ে নেব।” অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ছিল অনুপ কুমারের সঙ্গে টেকনিশিয়ানদের। এক সময় কত লড়াইতে, আন্দোলনে টেকনিশিয়ানদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন তাঁদের অনুদা অর্থাৎ অনুপ কুমার।

আবার যে যার মতো পজিশন নিল। ক্যামেরা যাবে। হঠাৎ শাম্মি কাপুর থেমে গেলেন। একটু বোধহয় রাগই দেখালেন। বললেন, “আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। ব্যাপারটা কী হল? অনুপবাবু লাইট নিতে পারছেন না! উনি যেদিন লাইট নিতে পারবেন না, আমি সেদিন ফিল্ম করা ছেড়ে দেব।” অনুপ কুমারের উপর এতটাই আস্থা, এতটাই বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ছিল শাম্মি কাপুরের। সেদিন টলিউড দেখেছিল একজন টলিউডের বর্ষীয়ান অভিনেতার প্রতি বলিউড সুপারস্টার নায়কের অনন্য সম্মান প্রদর্শন।

শাম্মি কাপুর সেবার আরও বলেছিলেন “জানি না ভবিষ্যতে আমি আর কখনও বাংলা ছবি করব কিনা। তবে কখনও যদি সময় সুযোগ আসে, তাহলেও চাইব সেখানে যেন সহ-অভিনেতা হিসেবে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অনুপ কুমারকেই পাই।” না আর সুযোগ পাননি শাম্মি কাপুর। কারণ অনুপ তার কয়েক বছর পরেই ১৯৯৮ সালে ৩ সেপ্টেম্বর চলে যান চিরঘুমে।

এর পরে ২০১১ সালের আজকের দিনেই অর্থাৎ ১৪ আগস্ট শাম্মি কাপুরও প্রয়াত হন। বাংলা ছবি আর পায়নি তাঁকে। কিন্তু ভারতের চিরসবুজ নায়ক তিনি। তাঁর স্মৃতির পাতায় আলাদা গৌরব নিয়ে থেকে গেছেন বাংলার অভিনেতা অনুপ কুমার।

You might also like