শেষ আপডেট: 16th September 2023 07:53
বেহালা অঞ্চলে ছোটখাটো মানুষটিকে প্রায়ই সাইকেলে চড়ে, মাথায় ক্যাচ টুপি পরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। বাজার করতে বড্ড ভালবাসতেন। তাই বেহালা ছোটবাজার হোক বা পুরাতন বাজার, হামেশাই দেখা মিলত তাঁর। মুখে সবসময় লেগে থাকত হাসি। হাসানোই ছিল তাঁর কাজ। বাংলা চলচ্চিত্রের কমেডিয়ান অভিনেতা তিনি (Actor Samir Mukherjee)। উচ্চতায় ছোটখাটো হলেও তিনি কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদারের মতো বড় মাপের পরিচালকদের ছবিতে। আবার সিরিয়াস চরিত্রে বা মিচকে ভিলেন চরিত্রেও দেখা যেত তাঁকে। একসময়ের দূরদর্শনের ভীষণ চেনা মুখ এই শিল্পী। অথচ সেই নিয়ে কখনও বিন্দুমাত্র অহংকার করতে দেখা যায়নি তাঁকে। কেতাদুরস্ত গাড়ি নয়, বরং নিজের সাইকেল চড়েই কাটিয়ে দিয়েছেন চিরটাকাল। স্বর্ণযুগ থেকে বর্তমান যুগ, মঞ্চ-চলচ্চিত্র-দূরদর্শন খ্যাত কমেডিয়ান (Comedian) ছিলেন অভিনেতা সমীর মুখোপাধ্যায়। ইন্ডাস্ট্রি থেকে পাড়ায়, সর্বত্র সমুদা বা সমুকাকু বলেই পরিচিত ছিলেন তিনি।
অভিনয়ের প্রতি টান ছিল ছোট থেকেই। ছোটখাটো নাট্যদলে অভিনয় করার পর সুযোগ পান 'চেতনা' নাট্যগোষ্ঠীতে অভিনয় করার। ষাটের দশকের শুরুতে উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার' নাটকে তাঁর অভিনয় দেখতে এসে স্বয়ং উত্তমকুমার বলেছিলেন 'আপনি নাটকে এত ভাল অভিনয় করেন' ফিল্মে আসছেন না কেন?'
তাঁর অভিনয় জগতে পথ চলা শুরু হয় তরুণ মজুমদারের (Tarun Majumdar) 'সংসার সীমান্তে' ছবিতে অভিনয় করে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তরুণ মজুমদারই ছিলেন তাঁর গুরু। শুরুর দিকে অভিনয় করতেন শখে। সমীর মুখোপাধ্যায় তারাতলায় 'ইন্ডিয়ান অক্সিজেন লিমিটেড'-এ চাকরি করতেন। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটত অভিনয় জগতেই। নাটক, ছায়াছবি, সিরিয়াল বা যাত্রা সবেতেই তিনি কমেডি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করতেন।
তরুণ মজুমদারের একের পর এক ছবিতে তিনি ছিলেন চেনা মুখ। ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, মেঘমুক্তি বা আলো- ছোট্ট উপস্থিতিতেই মাত করতেন অভিনেতা। তরুণবাবুর সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল রীতিমতো। সমীরবাবুর স্ত্রী মীরা মুখোপাধ্যায়ের হাতে রাঁধা আলুপোস্ত খেতে দারুণ ভালবাসতেন তরুণ মজুমদার। তরুণবাবু কচু শাক ভালবাসেন জানতে পেরেই সমীরবাবু সোজা চললেন বাজারে। সেখান থেকে নিজের হাতে বেছে কিনে নিয়ে গেলেন একদম সেরা কচুর শাক। স্ত্রীকে দিয়ে রাঁধিয়ে তা পৌঁছে দিলেন গুরুর (Tarun Majumdar) কাছে। এমনই ছিল দু'জনের সম্পর্ক।
সমীর মুখোপাধ্যায়ের সবথেকে উল্লেখযোগ্য অভিনয় সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে' ছবিতে শিল্পমন্ত্রী-র চরিত্রে। এটি তাঁর অভিনয় জীবনের মাইলফলক বলা যায়। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে ৫০-৬০ বার তাঁর লুক টেস্ট হয়েছিল শিল্পমন্ত্রীর সাজে। কমেডি চরিত্রে (Comedian) অভিনয় করার সময় কীরকম মুখভঙ্গি তাঁকে করতে হবে, সমীরবাবুকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দিয়েছিলেন পারফেকশনিস্ট সত্যজিৎ রায় নিজেই।
তপন সিনহার বহু আলোচিত ছবি 'আদালত ও একটি মেয়ে'তে সমীর মুখোপাধ্যায় ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তনুজার সঙ্গে। আটের দশকের সবথেকে বিতর্কিত ছবি ছিল এটি। ছবির গল্পে ছিল, পুরীতে ঘুরতে গিয়ে তনুজা ধর্ষণের শিকার হবেন। সমুদ্রের ধার থেকে তনুজাকে উদ্ধার করবেন সমীর মুখোপাধ্যায়, যিনি একজন বাঙালি পর্যটক। তাঁর মুখে সংলাপ ছিল 'কী হয়েছে মা, তুমি এভাবে শুয়ে আছ যে?' তারপর তিনি দেখবেন তনুজার মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা, সারা শরীর রক্তাক্ত।
বাংলা ছবিতে সেই সময় এমন সাহসী বিষয় দেখিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তপন সিনহা। ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দহন' রিলিজ হবার দু'দশক আগেই এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল বাংলায়। সমুদ্রতটে শ্যুটিংয়ের সময় একটা দৃশ্য ছিল, সমীরবাবু তনুজাকে কোলে তুলে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। যদিও সেই দৃশ্য ছবিতে বাদ পড়ে। তনুজা বম্বের তারকা অভিনেত্রী হয়েও সমীরবাবুকে বলেছিলেন 'আমাকে বেশি তোলার দরকার নেই, তাতে আপনার লেগে যেতে পারে। অল্প তুলে ছেড়ে দিন।' ছোটখাটো চেহারার মানুষ বলেই হয়তো সমীরবাবুকে মানবিক দিক থেকে এমন কথা বলেন তনুজা। ছোট রোল করেও তনুজা বা তপন সিনহার মতো তারকাদের এমন অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন, সেটা ছিল সমীরবাবুর জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি ।
সমীর মুখোপাধ্যায়ের (Actor Samir Mukherjee) পুত্র কুন্তল মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নাটক -সিনেমা-যাত্রা সব করেও চুটিয়ে সংসারও করেছেন সমীরবাবু। 'তবে বাবা অফিসে কম যেতেন, বেশিরভাগ সময়ই বাবাকে আমরা থিয়েটার, সিনেমা করতে দেখতাম। সকালে বাজার করে খেয়েদেয়ে সিনেমার শ্যুটিং করতে যেতেন, আর রাতে চলে যেতেন যাত্রা করতে। রাত তিনটেয় বাড়ি ফিরতেন। আবার ভোর হতেই শ্যুটিংয়ে চলে যেতেন। তাই বাবাকে আমরা কমই পেতাম। অভিনয়ের জন্য বাবা প্রাণপাত করতেন। বাবা বাড়িতে এই আছেন, এই নেই। ধরে রাখা মুশকিল ছিল। তবে বাবা আমাদের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেননি। যা চেয়েছি তার বেশি দিয়েছেন।
বরং সবসময় চারগুণ বেশি দিয়েছেন আমাদের দুই ভাইবোনকে। আমরা বেহালার খুব পুরনো বাসিন্দা। আমাদের একশো বছরের পুরনো বাড়ি। চুন-সুরকির দেওয়াল, কড়ি-বরগার ছাদ। ঐতিহ্য নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে। বাবাকে চলচ্চিত্র জগতে এনেছিলেন তরুণ মজুমদার। বাবাদের ইন্ডিয়ান অক্সিজেন লিমিটেডের অফিসে তরুণ মজুমদার 'সংসার সীমান্তে' ছবির শ্যুটও করেছিলেন। শেষদিকে স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছিল বাবার। বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় আর পারতেন না। শেষ ক'দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে বাবা চলে গেলেন ৮৭ বছর বয়সে।' (Samir Mukherjee death)
স্ত্রী মীরাদেবী, পুত্র কুন্তল, কন্যা অর্পিতা ও পুত্রবধূ অন্তরা রয়েছেন তাঁর পরিবারে। প্রিয় সমুদার প্রয়াণে (Samir Mukherjee death) পাড়ার লোকজনও শোকাহত। প্রতিবেশী হারাধন গোস্বামী ও তনুশ্রী গোস্বামী জানালেন 'পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ লোক ও মজার মানুষ সমীরদাকে হারালাম। আমাদের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। ছোটদের ভীষণ ভালবাসতেন। আমাদের গর্ব ছিলেন উনি।'
টালিগঞ্জ পাড়ার দুর্নাম আছে, একবার আড়ালে চলে গেলে শিল্পীদের খুব একটা আর মনে রাখে না সেখানকার কেউ। নতুনদের আলোয় ঢাকা পড়ে যান পুরনোরা। সেই কথাই উঠে এল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীর ফেসবুক পোস্টে। তিনি সমীর মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখলেন, 'আমরা বেশ ভুলে যেতে পারি। বড়দের, পুরনোদের, যাঁরা আমাদের হাঁটার রাস্তাটা তৈরি করে দিয়ে গেলেন তাঁদের, যাঁরা এখন বাতিল বা ব্রাত্য তাঁদের- সবাইকে ভুলে মেরে দিয়ে নিজেরা সেই রাস্তায় দিব্যি হাঁটতে পারি সঙ্গে আট/দশজন বাউন্সার নিয়ে (বেশির ভাগ সময়েই অকারণে)।
সমীর কাকুকেও ভুলে গেছি আমরা। সত্যজিৎ রায়ের বহু ছবি চললেই তাঁর দেখা পাই, অগুনতি সাদা কালো বা রঙিন পুরনো বাংলা সিনেমায় ছোট থেকে বড় নানা চরিত্রে অভিনয় করে মানুষকে কখনও হাসিয়েছেন, কখনও রাগিয়েছেন সমীরকাকু। গাড়ি চড়ে স্টুডিওয় ঢুকতে আমি অন্তত কোনওদিন দেখিনি। অন্যরা দেখেছেন কিনা জানি না। বেহালায় নিজের অঞ্চলে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে সব্জি বাজার করতে দেখেছি বহুদিন। সাদামাটা জীবন যাপন করলেন বলেই কি আমরা ভুলে গেলাম? নাকি instagram reel বানান না বলে? কী জানি!!
তবে ভুলে যে আমরা গেছি, সে বিষয়ে নিশ্চিত। যাই হোক, আর তো দেখা হবে না। ক্ষমা চাওয়ার অপশনটাও রইল না।
Rest in peace Sameer kaku.'
আর্টিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে প্রয়াত অভিনেতাকে।
বহুসময় তাঁকে ছবিতে অকিঞ্চিতকর ছোট চরিত্র করতে হয়েছে। কিন্তু অভিনয়টাই তাঁর কাছে ছিল সব, রোল কত বড় সেটা ছিল গুরুত্বহীন। চলচ্চিত্র জগতের মহীরুহদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। একদিকে যেমন সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে', তরুণ মজুমদারের 'আগমন', 'ফুলেশ্বরী', বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর 'লাল দরজা' ছবি করেছেন, তেমনই হরনাথ চক্রবর্তীর 'রাজা রানি বাদশা' ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ছোট চরিত্র করলেও প্রায় ৩৫০ ছবিতে অভিনয় করেছেন সমীর মুখোপাধ্যায়। আজও টেলিভিশনে তাঁর মুখ দেখা যায় পুরনো বাংলা ছবিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেঁচে থাকতে প্রাপ্য সম্মান বা কদর, কোনওটাই তিনি পেলেন না।
আবার ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, পদ্ম ঝি অনন্যা, হাজারি ঠাকুর বাংলাদেশের মোশাররফ করিম