শেষ আপডেট: 30th August 2023 14:35
বাংলা ছবিতে যখন ক্লিনশেভড হিরোরা পর্দায় রাজ করছেন, তখন দাড়িওয়ালা গালের এক হিরোর আবির্ভাব হল। বয়সে একটু ছোট, তাই বড় দেখাতে গালে দাড়ি রাখা হল। কিন্তু সব হিরোর থেকে এই লুক দিয়েই তিনি নিজের স্বতন্ত্র স্টাইল প্রতিষ্ঠা করলেন। বিদেশ সরকারের 'অপরূপা' ছবিতে অভিষেক ঘটল তাঁর। আটের দশকের নতুন হিরো এলেন
জয় বন্দ্যোপাধ্যায় (Actor Joy Banerjee)। তার পরে কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে। এখন কেমন আছেন জয়? নিজের কেরিয়ার, সাফল্য, প্রস্থান থেকে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলাখুলি আড্ডায় সেই জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের বাড়ি বসেই মন খুললেন তিনি। সাক্ষাৎকার (Exclusive Interview) নিলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
হ্যাঁ, আমরা এক কথায় রিফিউজি। আমাদের দেশ ছিল বরিশালে। ঠাকুর্দা তখন মিলিটারিতে ছিলেন। বাংলাদেশে অত্যাচারের ফলে আমার ঠাকুমা তিন সন্তানকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। বরিশালের সব জমিজমা, বাড়ি, টাকা পয়সা ছেড়ে এসে এখানে আবার শূন্য থেকে আমাদের শুরু করতে হয়েছিল। ঠাকুর্দাও এখানে চলে আসেন। ঠাকুর্দা ছিলেন আদতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নলিনীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। মাইথন বাঁধ, পাঞ্চেত বাঁধ এগুলো যেসব ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করেছিলেন, আমার ঠাকুর্দা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।
ঠাকুর্দাকে দেখেছি, বাবাকে দেখেছি নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে জীবন যাপন করেছেন। সেই জন্যই আজকে আমরা এই জায়গায় এসেছি। আমার বাবা ছিলেন সে যুগের নামকরা পুলিশ অফিসার। বাবা ছিলেন আমার থেকেও নামী ব্যক্তি। আমি নায়ক হওয়ার পর বাবার সঙ্গে আমার কম্পিটিশন হত, কার বেশি নাম!
আমার বাবার সঙ্গে আমার মায়ের খুব অ্যাডভেঞ্চারাস বিয়ে হয়। আমার মায়ের বাড়ি ছিল হাজারিবাগে। ওখানে আমার বাবা গেছিলেন সেন্ট কলোম্বাস কলেজে পড়তে। মাকে দেখে বাবা প্রেমে পড়েন। দু'জনেই দু'জনকে ভালবেসে ফেলেন। আমার মা খুব সুন্দরী, বাবাও ছিলেন হ্যান্ডসাম। জুটিটা দারুণ। আমার বাবার নাম ছিল সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মায়ের নাম মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের বাপের বাড়ির পদবি চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু আমার মা ছিলেন পর্দানসীন। দাদু মাকে নিয়ে যেতেন পর্দা দিয়ে ঢেকে। দাদু প্রথমে চাননি তাঁর মেয়ে আমার বাবাকে বিয়ে করুন। দাদু হুমকি দিলেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন ওই ছেলের সঙ্গে মা বিয়ে করলে। মাকে এইভাবে বিরত করা হয়। বাবাও চলে এসেছিলেন কলকাতায়। ঠিক সেসময় দলাই লামার গুরুর মৃত্যু হয়। আমার বাবার উপর দায়িত্ব পড়ে দলাই লামার গুরুর মরদেহ এসকর্ট করে গয়া অবধি নিয়ে যাওয়ার। গয়ার সব দায়িত্ব সেরে যখন বাবা গাড়ি করে ফিরছেন, তখন বাবা সটান আমার মায়ের বাড়ি গিয়ে হাজির। আমার মামাকে বাবা বললেন, মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। মামা ছিলেন বাবার বয়সি। তিনি বললেন, 'কী কথা বলবি তোদের তো সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।'
বাবা বললেন, 'মঞ্জু এসে একবার বলে দিক, আমায় চায় না, তাহলে আমি চলে যাব। আর কোনওদিন আসব না।'
মামা বললেন, 'সাতটার সময় ছেঁদিতলায় আয়। আমি ওখানে মঞ্জুকে নিয়ে আসব।' বাবা-মায়ের বহুদিন পর দেখা হল। মা বললেন বাবাকে, 'আমি যদি বিয়ে করি তোমাকেই করব।'
তখন মামা সোজা দাদুকে জানালেন, 'এ বিয়ে দিয়ে দাও।' দাদু তখন জামশেদপুরে। দাদুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই বিয়েটা হল। পরবর্তীকালে আমার দাদুর বাড়ির যাঁরা বাবাকে অপছন্দ করেছিলেন, তাঁরাই বলেছিলেন সত্য হল চ্যাটার্জী পরিবারের শ্রেষ্ঠ জামাই।
বাবা-মায়ের বিয়ের পাঁচ বছর পর আমি মায়ের কোলে আসি। সেটাও খুব ঝড়ের মধ্যে দিয়ে। কলকাতার সব ডাক্তার বলেছিলেন মায়ের অ্যাবরশন করিয়ে দিতে, নাহলে মা বাঁচবেন না। তখন আমার দিদিমা আমার বাবাকে বললেন, 'মেয়েকে আমার দায়িত্বে একবার দাও, সুস্থ বাচ্চা হয় কিনা চেষ্টা করে দেখি।' হাজারিবাগের খ্রিস্টান হাসপাতাল মিশন হাসপাতালে মাকে দেখানো হল। ডঃ পৌর মাকে বললেন, 'মঞ্জু তুমি যদি আমার সব কথা শোনো, তাহলে তোমার একটা দারুণ বাচ্চা হবে।' তারপর রামগড়ে ছিন্নমস্তার মন্দিরেও মানত করা হল।
২৫ মে রাত্রি ৯টা ২০-তে মিশন হাসপাতালে আমার জন্ম হল। সে চারদিকে শাঁখ বাজাচ্ছে, উলুধ্বনি হচ্ছে। আমি হয়েছি একজন খ্রিস্টান ডাক্তারের হাতে, আমায় মানুষ করেছেন একজন মুসলিম দাই মা আর আমি নিজে হিন্দু। তাই আমি একজন সেকুলার লোক।
আমার পিসি। যাঁকে আমি আমার দ্বিতীয় মা বলি। লন্ডনে থাকেন। খুব বড় ডাক্তার।
প্রথম আমি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে অ্যাডমিশন নিই। মেধাবী ছেলেরাই একমাত্র ওখানে সুযোগ পেত। আমি ছোটবেলায় ওখানে পরীক্ষা দিই। লেখা পরীক্ষাটা খুব একটা ভাল না হলেও মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেছিলাম। তা আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলাম পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষায় মহারাজ আমাকে প্রশ্ন করলেন, 'ক'টা সিঁড়ি বেয়ে তুমি উপরে উঠেছো?' আমি ফট করে বললাম, '২২টা'। এই যে কনফিডেন্সটা মহারাজ আমার মধ্যে দেখলেন, তাতেই আমাকে উনি ভর্তি করে নিলেন। নরেন্দ্রপুরের শিক্ষাদীক্ষা আমার মধ্যে রচিত হল।
নরেন্দ্রপুরে বড় বড় খেলার মাঠ আছে, নাটক করার থিয়েটার হল আছে। তো নরেন্দ্রপুরে রামায়ণ নাটক মঞ্চস্থ হবে। আমি ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম মাঠে। ২০০০ আসন বিশিষ্ট হলে নাটকটা হবে। চরিত্র সিলেকশন হচ্ছিল। কিন্তু রাম কে করবে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কালচারাল টিচার আমাকে দেখে বললেন, 'জয় এসো তো, এই সংলাপ বলো।' পরদিন যখন আমি ঘুম থেকে উঠেছি, সব বন্ধুরা আমায় কনগ্র্যাচুলেশনস জানাচ্ছে। সবাই বলল, আমি রামের চরিত্রে সিলেক্টেড হয়ে গেছি।
ওখানে হরি মহারাজকে আমি খুব মানতাম। ওঁকে বললাম, 'এটা কী হল! আমি ভাবতাম খেলোয়াড় হবো, কিন্তু আমি রাম হয়ে গেলাম! তাহলে আমার খেলা বন্ধ!' তখন উনি বললেন, 'এটাই তোর পথ।' রামায়ণ নাটক যখন হচ্ছে, তখন দর্শকাসনে আমার বাবা মা-ও বসে। যখন রাম পদ্মের বিনিময়ে নিজের চোখ উপড়ে দান করছে তখন রামের অভিনয় দেখে আমার মা জয় বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। এরপর লোকেশ্বরানন্দজি যখন সবাইকে পুরস্কার দিচ্ছেন, আমি দেখছি আমার কোনও প্রাইজ নেই। বন্ধুদের বললাম, 'দেখলি এইজন্য আমি করতে চাইনি।' কিন্তু সবশেষে লোকেশ্বরানন্দজি আমাকে ডেকে বললেন, 'তোমাকে আজ আমি কোনও পার্থিব পুরস্কার দেব না, তোমার পুরস্কার দর্শকাসন থেকে তোমার মায়ের জয় বলে চিৎকার।'
আমি ফাইনাল দিই মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে। ইলেভেন টুয়েলভ পড়ি সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে। গ্র্যাজুয়েট হই আশুতোষ কলেজ থেকে।
আমি খুব ছোট বয়সে ফিল্মে চলে আসি। প্রথম যৌবনে পা দিয়েই আমি বোহেমিয়ান জীবন বেছে নিয়েছিলাম। আমার রূপ যৌবন ও পারিবারিক আভিজাত্যে ছিলই। ফিল্মে এসে গ্ল্যামার আরও বাড়ল। ডিস্কো, পার্টি এসব ছিল আমার রোজকার জীবনের অঙ্গ। এসব নিয়ে আমি খুব ভালই ছিলাম। হঠাৎ এরকমই এক পার্টিতে পরিচালক বিদেশ সরকারের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। তিনি আমাকে বললেন, 'বাংলা ছবি করবে?' আমি ওঁর কথা খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। তখন উনি বলছেন, 'শোনো না কে কে আছেন এই ছবিতে!' আর ডি বর্মনের মিউজিক, দেবশ্রী রায় এবং মধু কাপুর দু'জনে হিরোইন এবং হংকং-এ ছবির শ্যুটিং। কারণ তখন বাংলা ছবির সব শ্যুটিং হত দিঘা, ডায়মন্ড হারবার, বোলপুর, দার্জিলিং, খুব বেশি হলে কালিম্পং।
'অপরূপা'ই প্রথম বাংলা ছবি, যেটা বিদেশে হংকং-এ শ্যুটিং হয়েছিল। আমি বাংলা ছবির প্রথম হিরো, যে ফরেনে প্রথম শ্যুটিং করি। হংকং-এ শ্যুটিং বলে এই ছবি বেশি চর্চায় ছিল। এরপর আমার অভিনীত 'নাগমতী' ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। আর্ট ফিল্ম আরও করলাম নায়ক হয়ে, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের 'চপার'।
সুখেনদার জীবন মরণ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে কিশোর কুমারের গাওয়া 'আমার এ কণ্ঠ ভরে' গান আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এরপর সুখেন দাসের 'মিলনতিথি'র হিরো আমি।
আটের-নয়ের দশকে মেয়েরা বালিশের তোলায়, বইয়ের পাতার ভাঁজে আমার ছবি রাখত। আমার রূপ নিয়ে পরিচর্যা খুব করি না। সবটাই ভগবানপ্রদত্ত। আমি গায়ে কিছুই মাখি না, তবু আমার স্কিন এত ফর্সা। কত মেয়ে যে আমার বাড়ির দরজায় দেখা করার জন্য বসে থেকেছে। কত মেয়েদের যে চিঠি পেতাম। কিন্তু মিলনতিথি রিলিজ করার পরে ঘটল এক কাণ্ড। একটা বিদেশি গাড়ি আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। একজন মহিলা গাড়ি থেকে নামলেন। গা থেকে সেন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে বিদেশিনী। আমায় দেখে বললেন, ‘কী সৌভাগ্য আপনাকে পেলাম আজ।’ তারপর বললেন, ‘আপনার কাছে আমি একটা ভিক্ষা চাইতে এসেছি।’
আমি বললাম, কী ভিক্ষা? মহিলা বললেন, ‘আমি আর আমার স্বামী কানাডায় থাকি। আমার মেয়ে আমার মায়ের সঙ্গে পাম অ্যাভিনিউতে থাকে। আমার মেয়ে ১২ বার আপনার ‘মিলন তিথি’ দেখেছে। ওর মনে আপনি ওঁর স্বামী। আপনি ওকে বিয়ে করতে পারবেন? বলুন তাহলে আপনার কী চাই?’
আমি তো অবাক! রোম্যান্টিক হিরোরা বিয়ের পর ছবিতে এলে এক রকম, যেমন উত্তমকুমার এসেছিলেন। কিন্তু কেরিয়ারের মধ্যগগনে বিয়ে হওয়া একরকম বাজার ফেলে দেওয়ার মতোই। আমি বললাম, আমি পারব না। মহিলা চলে গেলেন। তিন চার মাস পর আবার মহিলা এলেন আমার বাড়ি। ভাগ্যক্রমে সেদিনও আমি বাড়ি ছিলাম। উনি বললেন, ‘আজ আমি অন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমি মনোবিদের সঙ্গে কথা বলেছি আমার মেয়েকে নিয়ে। মনোবিদ বলেছেন জয় ব্যানার্জীর (Joy Banerjee) ভাল ইমেজটা আপনার মেয়ের মনে ভেঙে দিতে হবে। জয়বাবু আপনি আমার বাড়ি চলুন, আমার বাড়ির ভিতর বার আছে। ভাড়া করা মেয়ে নিয়ে চলুন ওদের সঙ্গে মদ্যপ হয়ে ফষ্টিনষ্টি করুন। যাতে আমার মেয়ে বোঝে আপনি বাজে লোক।
আমি বললাম, ‘এই রে আপনার মেয়ের জন্য সব মেয়ের কাছে আমার ইমেজ খারাপ করব কীভাবে?’ সেই মহিলা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। জানি না তারপর কী হয়েছে।
অঞ্জন চৌধুরী পরের উপকারটা মনে রাখতেন। আমার বাবার বন্ধু ছিলেন উনি। বাবা ওঁকে অনেক সমস্যায় সাহায্য করেছিলেন। সেই উপকারটা মনে রেখে অঞ্জন চৌধুরী আমাকে ওঁর অভাগিনী, হীরক জয়ন্তী ছবির হিরো করেন। অবশ্যই আমার রেকর্ড হিট ছবি 'হীরক জয়ন্তী'। চুমকি চৌধুরী আমার নায়িকা ছিলেন।
হীরক জয়ন্তীতে হীরুর অভিনয় দেখে ফিল্ম জার্নালিস্টরা লিখেছিলেন, 'জয় ব্যানার্জীর গা দিয়ে মাটির গন্ধ বেরোচ্ছে, এতটাই সে হীরুর চরিত্রে একাত্ম হয়ে গেছে।' আবার অপরূপা, অভাগিনী ছবিতে আমি একদম শহুরে লুকে হিরো।
তাই আমি প্রসেনজিৎকে বলেছিলাম, 'তুমি তো সব একধরনের চরিত্র করে চলেছো, কোনও নতুনত্ব নেই।' তখন প্রসেনজিৎ তাই করত।
মিস ক্যালকাটা নির্বাচনের বিচারকের আসনে আমি ছিলাম। সেখানে অনন্যা প্রতিযোগী ছিল। বেশিরভাগই বুড়ো জাজ থাকে। তাঁরা সবাই সুন্দরী মেয়েদের কার্ড দিচ্ছিলেন। আমি সেখানে তরুণ। আমি ওসব কার্ড দিই না। পাত্তা দিচ্ছিলাম না মেয়েদের। আমি মেয়েদের একটু এড়িয়ে চলি, এইজন্য মেয়েরা আমার প্রতি আকর্ষিত হয় বেশি। তো অনন্যা আমায় এসে বলল, 'আমি আপনার একটা কার্ড পেতে পারি?' আমি বললাম, 'আমার কোনও কার্ড নেই।'
এই বলে আমি বেরিয়ে গেছি। আমার সেদিন তিনটে মেয়ের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল। তিনটে মেয়ের ডেটিং ক্যানসেল করে দিলাম আমার বাবার ভয় দেখিয়ে। কিন্তু মিস ক্যালকাটা অনন্যার প্রেমে পড়লাম সত্যিসত্যি। আমি তখন অনন্যার জন্য পাগল। আমার বাবা আমার মতো দুষ্টু ছেলেকে আটকাতে ছেলের অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবার ব্যবস্থা শুরু করলেন। কিন্তু বাবা যেদিন শুনলেন অনন্যা সুন্দরী, গুণী মেয়ে, তখন চার দিনের মধ্যে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সালটা ২০০০।
আমি ভেবেছিলাম, ইমরান খানের বিয়েটা যেমন শতকের বিয়ে, জয় ব্যানার্জীর বিয়েটা দশকের বিয়ে হবে। কিন্তু আমার আর অনন্যার প্রাইভেট বিয়েতে লোক হল মাত্র ৪০-৫০ জন। ২০১০ সালে অনন্যা তৃণমূল দলের হয়ে রাজনীতিতে যোগ দিল। রাজনীতির পথ আলাদা হয়ে যায় আমাদের। অনন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে থাকে। আমি ২০১৪ সালে মোদীজির ভাষণ শুনে ওঁর দলে যোগ দিই। মোদীজি আমার কাছে লিভিং রামকৃষ্ণ, যে যাই বলুক।
অনন্যা আজ আমার জীবনে প্রাক্তন, তবু ওঁর প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। গুণী মেয়ে।
২০১৯ সালে আমি আরেকটা বিয়ে করলাম। আমার বাবা-মা তখন অসুস্থ, তাঁদের তো দেখতে হবে, যেটা টাকা দিয়ে লোক রাখলে হয় না। আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমার থেকে তিরিশ বছরের ছোট। ওঁর বয়স তিরিশের কোঠায়। একটি ভাল মেয়ে আসানসোলের, নাম অঙ্কিতা। আমি তাঁকে বিয়ে করি। অঙ্কিতা আমার সংসার সুন্দর ও শান্তিতে রেখেছে।
পুলিশের উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার বাবা 'ANAPOL' কোম্পানি করলেন। Army Navy Airforce Police. কোনও এজেন্সি থেকে সিকিউরিটি নেওয়া-- এই কনসেপ্ট পূর্ব ভারতে প্রথম আমার বাবা নিয়ে এসেছিলেন। যেটা এখন ভরে গেছে সবজায়গায়। সঙ্গে ছিল ডিটেক্টিভ এজেন্সি। ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি-- সব জায়গাতেই বাবার সাক্ষাৎকার। সবটাই ব্রেনের কাজ। গোয়েন্দাও ছিলেন বাবা। কোথাও মড়ার খুলি রেখে তদন্ত করছে, কোথাও কাউকে জ্যোতিষী সাজাচ্ছে, সে নানানরকম বুদ্ধির খেলা। বাবা মারার যাওয়ার পর আমার এখনকার স্ত্রী অঙ্কিতা এই ফার্ম চালায়।
নাগমতী ছবি রজত কমল পায়। চপারের জন্য আমি বিদেশের পুরস্কার নিয়ে এসেছি রাজ কাপুর, অমিতাভ বচ্চনের উপস্থিতিতে। কমার্শিয়াল হিটও করেছি। কিশোর কুমার চলে যেতে আমি ছবির জগত থেকে সরে আসি। ২০০২ সালে যাত্রা করে ফেরার সময় আমার বড় অ্যাক্সিডেন্ট হল। ১৮ দিন আইসিইউ-তে ছিলাম। যমে-মানুষে টানাটানি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমায় স্টেরয়েড খেতে হত। যার ফলে আমি মোটা হয়ে গেলাম।
আমার মতো রোম্যান্টিক হিরোরা খুব ক্ষণজন্মা হন। ঋষি কাপুর, রাজেশ খান্নার মতো। আমার ওই রোম্যান্টিক চেহারাটাই চলে গেল। এরপর ভোটে দাঁড়িয়ে প্রচুর মার খেয়েছি। তারপর করোনা হল। হাসপাতালে আবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কোনওমতে ভাল আছি। আমার বাবা চলে যাওয়ার শোকেও ঘরবন্দি হয়েছিলাম। তখন রামকৃষ্ণ আশ্রমের সুবীরানন্দ মহারাজ আমাকে আবার কাজের জগতে ফেরান। কলকাতা এয়ারপোর্টে জে পি নাড্ডার সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন বিজেপি তোমাকে ছাড়বে না। তাই এখন ফিল্মে আর না ফিরে রাজনীতিতে মন দিয়েছি।
তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার, যে পরিচালকদের ছবিতে আমার হিট, তাঁরা একে একে মারা গেলেন। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস মারা গেলেন। অঞ্জন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যার ফলে ওঁদের ছবিতে আমাকে আর দেখা গেল না। পরে অঞ্জন চৌধুরীর মামা-ভাগ্নে সিরিয়ালে কাজ করেছিলাম। ওই একটিমাত্র সিরিয়াল করেছি। ওখানে সব সিনেমার স্টাররাই কাজ করেছিলেন। অঞ্জন চৌধুরীর বাইরে আমি আর কারও থেকে ডাক পেলাম না। তখন অঞ্জন চৌধুরী ভার্সেস ইন্ডাস্ট্রি ছিল। আমাকে বলা হত অঞ্জন চৌধুরীর আর্টিস্ট।
আমার সঙ্গে কেউ পলিটিক্স করেনি। আমার নাম জয়। আমার মনটা পরিষ্কার। আগামী দিনে আমার শেষ ইচ্ছে, মোদীজির হাত ধরে সোনার বাংলা তৈরি করতে চাই।
আমার বাবা পুলিশ ছিলেন। আমি এখনও পর্যন্ত একটাও পুলিশের চরিত্র করতে পারিনি। অঞ্জন চৌধুরী তাঁর বিগ হিট 'শত্রু'র পরের পার্ট সিক্যুয়েল ছবি শুরু করেছিলেন 'অজাতশত্রু'। সেখানে আমি পুলিশের উর্দি পরে শ্যুটিং করেছিলাম। আমি মহরতও করেছিলাম। কিন্তু অঞ্জন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছবিটার শ্যুটিং সবটা আর উনি করতে পারেননি। তাই ভবিষ্যতে আমি একটা পুলিশের রোল করতে চাই।
কিশোরকুমারের গানেই আমার ছবি হিট! উনি মারা গেলেন, আমিও অভিনয় ছেড়ে দিলাম: জয়