
সদাহাস্যমুখ গৌতম দে ফুরিয়ে যান ক্যানসারে, আজও তাঁর অভিনয় মনে রেখেছেন দর্শকরা
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যয়
ইন্দর সেন পরিচালিত ‘জন্মভূমি’ সিরিয়ালে নরনারায়ণ চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম লাইমলাইটে আসেন অভিনেতা গৌতম দে (Actor Gautam Dey)। এরপর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভিলেন চরিত্র হলেও ছোট পর্দায় তিনি বিশাল জনপ্রিয়তা পান।
‘জন্মভূমি’র পিসিমা মিতা চট্টোপাধ্যায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় নরনারায়ণ আর তাঁর বৌ স্বর্ণময়ী এসে হাজির ময়নাগড়ে। ছলেবলেকৌশলে ময়নাগড়ের সম্পত্তি গ্রাস করা তাঁদের লক্ষ্য। এভাবেই এগোতে থাকে ভিলেনি চাল আর বাড়তে থাকে নরনারায়ণ আর স্বর্ণময়ীর জনপ্রিয়তা। স্বর্ণময়ী চরিত্রে প্রথম লাইমলাইট পান মঞ্চ থেকে আসা মেয়ে চৈতালী চক্রবর্তী। পরে তো সেই চৈতালী কটকটি রাক্ষসীর রোলে বেশ জনপ্রিয় হন।
তবে ভিলেনের রোল দিয়ে কেরিয়ার শুরু হলেও, সৌম্যকান্তি ও সুদর্শন চেহারার দৌলতে সবধরনের চরিত্রেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন গৌতম দে। কখনও প্রিয় দাদা, কখনও আন্তরিক স্বামী, কখনও স্নেহশীল বাবা– সব রোলেই কাজ করেছেন। ততদিনে থিয়েটার পাড়াতেও তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা।আদতে গৌতম দে চাকরি করতেন স্টেট ব্যাঙ্কে। রাসবিহারী ও জীবনদীপ শাখায় দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। নাটক করার দৌলতে চলে আসা ছোট পর্দায় তারপর বেশ কিছু ফিল্মও করেছিলেন। রাজা সেনের দামু বা অমল রায় ঘটকের ‘দেবর’, ‘উজান’ ছবিতে কাজ করেন তিনি। আরও বহু নামকরা পরিচালকের ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
রবি ঘোষ, মনোজ মিত্র, দুলাল লাহিড়ি, লিলি চক্রবর্তী, শেখর চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন এই অভিনেতা। আবার ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্বর চট্যোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী মিত্র, সুদীপ্তা চক্রবর্তী থেকে শুরু করে একদম হাল প্রজন্মের ঋতাভরী চক্রবর্তী, রুশা চট্টোপাধ্যায়,গাজী আব্দুন নূরদের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। কাজ করেছেন বিষ্ণুপাল চৌধুরী, যীশু দাশগুপ্ত, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, রবি ওঝার মতো ছোট পর্দার তাবড় পরিচালকদের সিরিয়ালে ও টেলিফিল্মেও। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দারুণ দক্ষ ও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।চেতলার ছেলে গৌতম পেশাদার মঞ্চ নাটকে প্রথম সাফল্য পান। রবি ঘোষের নির্দেশনায় ‘শ্রীমতী ভয়ংকরী’ নাটকে তাঁর অভিনয় ভীষণ প্রশংসিত হয়েছিল। মঞ্চে ‘ছদ্মবেশী’ নাটকে গৌরহরির ভূমিকায় অনবদ্য ছিলেন তিনি। সেসময়কার প্রত্যেকটি বড় বড় মঞ্চসফল নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর অভিনীত থিয়েটারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘সাবাস পেটোপাঁচু’, ‘দম্পতি’, ‘বৈশাখী ঝড়’ প্রভৃতি। রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, রংমহল, সারকারিনা, বিজন থিয়েটারের মঞ্চ আলো করেছে তাঁর অভিনয়।

তবে টেলিভিশনে এসেই তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। মীনাক্ষী গোস্বামীর ‘কলকাতার কাছেই’ ধারাবাহিকে নজর কাড়লেও তাঁর সাফল্য আসে মেগা সিরিয়াল ‘জন্মভূমি’ দিয়েই। ঘরেঘরে চেনামুখ হয়ে উঠলেন তিনি। ব্যাঙ্কের চাকরির দায়িত্ব সামলে একের পর এক সিরিয়ালে অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রত্যেকটি সিরিয়ালেই তাঁকে ছাড়া পরিচালক রা ভাবতে পারতেন না। ‘রাজেশ্বরী’ সিরিয়ালে রানি রাসমণির ভূমিকায় অনুরাধা রায় আর মথুরামোহনের ভূমিকায় গৌতম দে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। যারা নাইন্টিজে ‘রাজেশ্বরী’ দেখেছেন, তাঁরা আজও ভোলেননি মথুর বাবু গৌতম দেকে।

এর পর বেসরকারি টিভি চ্যানেলের যুগে ‘প্রতিবিম্ব’ সিরিয়ালে গৌতম দে-রীতা কয়রাল জুটি, ‘লাবণ্যের সংসার’ সিরিয়ালে গৌতম দে-তনিমা সেন জুটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘তিথির অতিথি’, ‘এ কোন সকাল’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘ধ্যাত্তেরিকা’, ‘খুঁজে বেড়াই কাছের মানুষ’, ‘কুসুমদোলা’– ইত্যাদি বিভিন্ন সিরিয়ালে চেনামুখ অভিনেতা ছিলেন তিনি। সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহর সমস্ত সিরিয়াল, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র সবেতেই গৌতম বাবু থাকতেন।

মাঝবয়সে পৌঁছে ক্যানসারে আক্রান্ত হন অভিনেতা। মারণ অসুখের ফলে সুদর্শন চেহারায় মালিন্যের ছাপ পড়েছিল, কিন্তু সদাহাস্যমুখ গৌতম সেই রোগ নিয়েও অভিনয় চালিয়ে গেছেন। শেষ দিকেও কাজ করছিলেন ‘হৃদয়হরণ বি.এ. পাস’ (হৃদয়হরণের বাবা) আর ‘করুণাময়ী রাণি রাসমণি’ (তর্কালঙ্কার পণ্ডিত) মেগা ধারাবাহিকে। দুই যুগের দুই রাসমণিতেই তিনি অভিনয় করেছিলেন।
৬৫ বছর বয়সে মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই করে প্রয়াত হন গৌতম দে। ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর সকাল ৭.৩০ নাগাদ মাইক্রোল্যাপ নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মরদেহ বাড়িতে এনে তারপর রাখা হয় টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে। এরপর কেওড়াতলা মহাশশ্মানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এক মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে তাঁর। মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। নানা রিয়্যালিটি শোতে সস্ত্রীক কয়েকবার এসেছিলেন গৌতম। অসম্ভব প্রাণবন্ত এক মানুষ, সেন্স অফ হিউমারও ছিল অসাধারণ।
রোগভোগ, বার্ধক্য, জরা সবই থাকবে নিয়ম মেনেই, তবু শিল্পীর কাজ রয়ে যাবে। তবে মঞ্চের নাটকগুলির যেহেতু সংরক্ষণ হয়নি, তাই পরের প্রজন্ম আর সে যুগের মহিমা জানবে না। ছোট পর্দার কাজে তবু ইউটিউব দেখে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে।