
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
নানা রকমের চরিত্রে নানা ঘরানার ছায়াছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। নায়ক বা ভিলেন কোনও চরিত্রেই খুব বড় ভূমিকায় তাঁকে মনে না রাখলেও, বাঙালির রান্নায় যেমন হলুদগুঁড়োর ব্যবহার, তেমনই অনস্বীকার্য বাংলা চলচ্চিত্রে অনুপ কুমার নামের এক অনিবার্য অভিনেতার। ১৯৩০ সালের আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন। জীবিত থাকলে আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিন হতো।
অনুপ কুমারের মনে রাখার মতো সিনেমা বলতে প্রথমেই নাম আসে ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘দাদার কীর্তি’। এসব ছবিতে তিনি সহজেই খাপ খেয়েছিলেন কমিক রিলিফ হিসেবে। আবার ‘নূরজাহান’ বা ‘কী বিভ্রাট’ নাটকে তাঁর চরিত্রাভিনয় দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, ইনিই সেই মানুষ! এমনই বহুমুখী অভিনেতাদের মধ্যে অনুপ কুমার একজন। পুরস্কারের নিরিখে না হলেও, দর্শকের ভালোবাসায় চিরকালই রঞ্জিত তিনি। যদিও ইন্ডাস্ট্রি তাঁর মূল্য দিতে পারেনি বলেই আজও মনে করেন অনেকে।
উত্তম কুমারের জমানার আগে থেকেই অনুপ কাজ করেছেন বাংলা ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রার সঙ্গেও কাজ করেছেন। আবার উত্তম-প্রয়াণের পরেও তাপস পাল থেকে প্রসেনজিৎদের বন্ধুর রোলেও অনুপ কুমার নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এই যে অভিনয়ের অভিযোজন, এ কিন্তু সহজ কথা নয়। ইন্ডাস্ট্রির এই যুগবদলে অনেকেই হারিয়ে যান, কাজ কমে যায়। অনুপ কুমার সব যুগেই ছিলেন সদর্পে।
ছোট থেকেই অভাবের সংসারে বড় হওয়া। অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ঘাড়ে। তাই টাকার জন্যই অভিনয় জগতে পেশাগত ভাবে আসা। প্রথমদিকে ছবি সাইন করায় কোনও পছন্দের অবকাশ ছিল না তাঁর কাছে। যা ছবি আসত সবেতেই কাজ করতে হতো। নায়ক হওয়ার সুযোগ এলেও, তা ধরে রাখতে পারেননি, কমেডিয়ানের রোলেই ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে।
কমেডিয়ান হিসেবেই বিখ্যাত হলেও, কিন্তু তরুণ মজুমদার পলাতক ছবিতে তাঁকে দিলেন আংটি চাটুজ্জ্যের ভাইয়ের লিড রোল। পলাতক, ঠগিনী, নিমন্ত্রণ– তিনটি ছবিতেই কি অনবদ্য নায়ক অনুপ কুমার। এমনকি উত্তম-সৌমিত্রকেও ওই সব ছবিতে নেননি তরুণ মজুমদার। সেই অনুপ কুমারকে ব্যবহার করল না আর কেউ।
সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ডাক দিয়ে যাই’ কিংবা অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ও উত্তম-সুচিত্রা জুটির সময়েই অনুপ কুমার-সন্ধ্যা রায় জুটি নিয়ে বানালেন ‘নতুন জীবন’। কি বিশাল জনপ্রিয়, মনের কাছাকাছি সে ছবি। সব গান হিট। ঠগিনী, নিমন্ত্রণ, নতুন জীবনের মতো হিট ছবি করেও অবশ্য সন্ধ্যা-অনুপ জুটি বেশি দূর এগোল না। হয়তো অনুপ ভাল চরিত্রের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারতেন না। সব অফার নিয়ে নিতেন। কারণ তাঁর কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব ছিল। পরোপকার স্বভাব ছিল তাঁর।
অনুপের বাবা, আকাশবাণীর সদস্য ধীরেন দাসের অকালে চাকরি চলে যায়। শিশু অভিনেতা হিসেবে টালিগঞ্জ পাড়ায় কাজ শুরু করেন অনুপ কুমার দাস। পরে স্টার থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্ত ও নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির শিষ্যত্ব নিয়ে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি চলে চলচ্চিত্রে কাজ। প্রায়ই একঘেয়ে রোল করে গেছেন, কারণ সাত ভাই পাঁচ বোনের বেঁচে থাকার ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য এক সাংস্কৃতিক কর্মী প্রাণপাত করেছেন। ভাই-বোনরাও কিন্তু আজীবন মনে রেখেছেন মেজদা অনুপকে। তাঁদের ছেলে মেয়েরা মনে রেখেছে মেজজ্যাঠা বা মেজমামার ঋণ।
পরিবার থেকে ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মী, সাধারণ মানুষ– সকলের পাশেই তিনি দাঁড়াতেন। এই ভালোমানুষিতার সুযোগও অনেকে নিত। তবু একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হয়েও বারবার রাস্তায় নামতেন অনুপ। যখনই খরা, বন্যা বা মহামারীতে বাংলা বিপর্যস্ত, অনুপ কুমার সবার আগে ঝাঁপিয়েছেন। সংগঠন কেমন করে গড়তে হয়, কেমন করে চালাতে হয়, সেটা যেন ওঁর কাছে ছিল জলভাত। উনি বিশ্বাস করতেন শিল্পকর্মী হিসেবে উনি মানুষের কাছে, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।
অভিনেত্রী সংঘের যে সংগ্রামী ইতিহাস, ন্যুনতম মজুরির দাবিতে টেকনিশিয়ানদের ধর্মঘট– সেই আন্দোলনের মূল কাণ্ডারী হয়ে টেকনিশিয়ানদের পাশে দাঁড়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর অনুপ কুমার। অনুপ কুমার শেষদিকে রাজনীতিতেও আসেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর বামপন্থী চেতনা ছিল চিরভাস্বর। কিন্তু জীবনের উপান্তে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে আসতেই ওঁর নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
অনুপ কুমার তরুণ জীবনে সব ভাই বোনদের বিয়ে দেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সবার শেষে নিজে অভিনেত্রী অলকা গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেছিলেন। যদিও পারিবারিক দায়িত্ববোধ আজীবন তাঁর পিছু ছাড়েনি। শুধু পরিবার কেন, গোটা ইন্ডাস্ট্রি চিনত পরোপকারী অনুপকে।
শোনা যায়, অভিনেত্রী গীতা দে এক সময় চরম বিপদে পড়েন ওঁর স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ায়। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে অথৈ জলে তরুণী মা। তাঁর পাশেও দাঁড়ান অনুপ। গীতা দে পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “একবার আমার মেয়ের অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা চরমে ওঠে। তখন আমার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল, একদম একা। এদিকে মেয়ের ব্যথায় মরোমরো অবস্থা, অপারেশন করার টাকাও নেই। দিশাহীন আমি। সে সেসময় অনুপবাবুই আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। টাকা দিলেন অনুপবাবু। পরে আমি সে টাকা শোধ করে দিই, কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে সেই পাশে দাঁড়ানোর ঋণ যে টাকায় মেটে না, তা যে বিপদে পড়েছে সেই জানে।”
বড় হলে মেয়ের বিয়ে দেন গীতা, নিমন্ত্রিত ছিলেন অনুপ বাবু।
আবার মৃণাল সেন গীতা সেনের সংসারের প্রথম জীবনটা প্রায় পুরোটাই চালিয়েছেন অনুপকুমার। গীতা সেন ছিলেন অনুপ কুমারের মামাতো বোন। বদলির চাকরি ভাল লাগছিল না মৃণালের। তাই চাকরিবাকরি ছেড়ে বেকার হয়ে গেলেন। দিন কাটছিল চরম দারিদ্র্যে ,অন্যদিকে সিনেমা তৈরির খিদে। এরকমই এক মার্চ মাসে বিয়ে করে ফেললেন গীতা সেনকে। অনুপ কুমারের আদি বাড়ি পাইকপাড়ায় কিন্তু টালিগঞ্জে কাজ করার সুবাদে থেকে যেতেন বোন গীতার সংসারেই। তখন মৃণাল-গীতার সংসার মনোহরপুকুর রোডে একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে। অনুপ কুমারের হাতে তখন অনেক ছবি। তাঁর সাহায্যেই তখন মৃণাল সেনের সংসার চলেছে অনেকটা সময়।
এহেন মানুষ এবং উচ্চমানের অভিনেতা যথাযথ সম্মান পেলেন না। সেই বাঁধা গতে বারবার নায়কের বন্ধু বা কমেডিয়ান ঘেরাটোপেই বন্দি রইলেন অনুপ। কিন্তু তিনি আজীবন একজন শিল্পীশ্রমিক ও ভাল মানুষ হিসেবে নিজের সেরাটা দিয়ে গেছেন। কত ছবিতেই দেখা গেছে নায়ক নায়িকার অভিনয়ের খামতি ভরাট করেছেন অনুপ কুমার। কিন্তু তাঁর প্রতিভার অপচয় ঘটিয়েছে ইন্ডাস্ট্রি। তবুও অনুপ কুমার আমাদের উজাড় করে দিয়েছেন। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা।