
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের (Abhishek Chatterjee) জীবনে থিতু হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। দিকভ্রষ্ট নাবিকের মতো নিজের জীবন নৌকো নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন অভিষেক।
ইন্ডাস্ট্রিতে এসেই বয়সে বড় অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েন তিনি। জড়ান লিভ ইন সম্পর্কে। যদিও সে সম্পর্ক টেকেনি। পরে আরও দুই নামী অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েন অভিষেক চট্টোপাধ্যায় (Abhishek Chatterjee)। সেখানেও ভাঙন। বারবার ভালবাসার আশ্রয় খুঁজে পেতে চাইতেন তিনি (Tollywood)। কিন্তু কোথাও স্থায়ী নোঙর ফেলে উঠতে পারেননি।

আরও পড়ুন: কেরিয়ারে ধাক্কা, ভুল নারীসঙ্গ, অবসাদ! ভাসান হল টলিউডের কার্তিক ঠাকুরের
চল্লিশ পেরোনো অভিষেক তখনও সুদর্শন পুরুষ। যৌবনে এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। তবু তখনও তিনি অকৃতদার। জীবনে বারবার নারী এলেও সেসব সম্পর্ক সামাজিক বিয়েতে পরিণতি পায়নি। উঠতি অভিনেত্রী জুন মালিয়া থেকে লকেট চট্টোপাধ্যায়, সকলের ফরেভার ক্রাশ ছিলেন অভিষেক (Abhishek Chatterjee)। কিন্তু তিনি যে টলিউডের কার্তিক। নিজেও ভেবেছিলেন আজীবন অকৃতদার রয়ে যাবেন। তাঁর কাছের বন্ধুরা লাবণী সরকার, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শকুন্তলা বড়ুয়া, সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়রা সকলেই চাইতেন অভিষেক সংসারে থিতু হোক। পাক সঠিক মনের মানুষ।

জীবনে শেষমেষ অভিষেক পেলেন সঠিক ভালবাসা। কোনও সম্পর্কেই পরিণতি না পেয়ে বিবাহের সোশ্যাল সাইটে প্রোফাইল খুলেছিলেন তিনি। সেখানেই তাঁর সঙ্গে সংযুক্তার আলাপ। প্রথম আলাপেই ভাললাগা। ভাললাগা থেকে ভালবাসা। প্রেম বিয়েতে পরিণতি পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কয়েক মাসের মধ্যেই চার হাত এক হয়। সংযুক্তা, মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকুরিতা মেয়েকে বিয়ে করেন অভিষেক। পান সুখী সংসার। নানা সম্পর্কে জর্জরিত অভিষেকের ক্ষততে প্রলেপ দেয় সংযুক্তার ভালবাসা। স্বামীর অনিয়ন্ত্রিত বেলাগাম জীবনে রাশ টানেন তিনি।

অভিষেক-সংযুক্তার বিয়ের সময় প্রসেনজিৎ-অভিষেকের (Prasenjit Chatterjee) সম্পর্ক ভাল ছিল। কারণ প্রসেনজিৎ-ই ছিলেন অভিষেকের বিয়ের বরকর্তা। ততদিনে প্রসেনজিৎও জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েছেন। সেরে ফেলেছেন তিনবার সাত পাক ঘোরা। তখন অভিষেক আর প্রসেনজিৎ যেন ‘শোলে’র জয়-বীরু। তাই অভিষেকের বিয়েতে প্রসেনজিৎ ছিলেন বরকর্তা।

একসময় প্রসেনজিতের বোন পল্লবী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেকের নিবিড় প্রেম ছিল। অভিষেক আসার আগেই ততদিনে পল্লবীও এক সন্তানের মা। অভিষেক-পল্লবী সম্পর্কে রাজি ছিলেন না প্রসেনজিৎ। তাই অভিষেককে বিয়ে দিয়ে থিতু করা প্রসেনজিতের কাছে ছিল বোনকে সরিয়ে আনার পন্থাও। অভিষেকের বিয়েতে বরকর্তা হিসেবে প্রসেনজিৎ সমস্ত কাজ সামলেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্ত্রী অর্পিতা পাল চট্টোপাধ্যায়ও। ২০০৮ সালে বিয়ে হয় অভিষেক-সংযুক্তার।

অভিষেকের বিয়ের দিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। গায়ে হলুদ খেলতে আসেন শতাব্দী রায়, লাবণী সরকার, অর্পিতারা। এমনকি সিঁদুরদানের সময় সংযুক্তার লজ্জাবস্ত্র ধরেছিলেন অর্পিতা। অথচ আজ মুখ দেখাদেখি নেই দুই বান্ধবীর!

অভিষেকের বিয়ের মতোই রিসেপশনও ছিল তারকাখচিত। লাল পাঞ্জাবিতে অভিষেকের পৌরুষ যেন ফেটে পড়ছিল। লাল বেনারসীতেই সেজেছিলেন সংযুক্তা। উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ অভিনেতাদের মধ্যে প্রায় সকলেই। রঞ্জিত মল্লিক, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, রমেন রায়চৌধুরী অনেকেই ছিলেন অভিষেকের রিসেপশনে।

রাত পার্টিতে হাজির ছিলেন তাপস পালের স্ত্রী নন্দিনী পাল ও মেয়ে সোহিনী পাল, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্রের মতো তারকারা। তবে দেখা মেলেনি ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর।


টলিপাড়ার ইতিহাসে অভিষেক-সংযুক্তার রিসেপশন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল অন্য এক কারণে। নব বিবাহিত দম্পতিদের থেকেও বেশি মিডিয়ার চোখ টানল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ও তৃতীয় স্ত্রীর সম্পর্কের রসায়ন।

কেউই ভাবতে পারেননি যে বিয়ের বরকর্তা প্রসেনজিৎ সেই বিয়েতে হাজির হবেন দেবশ্রী রায়। দেবশ্রী এসেছিলেন ভালবাসার, স্নেহের বন্ধু মিঠুর জন্য। মিঠু ওরফে অভিষেক এতদিন পর সংসার পেল যা মন থেকে ইন্ডাস্ট্রির সকলেই চেয়েছিলেন। দেবশ্রী অভিষেকের রিসেপশনে উপস্থিত হলেন নিজের মা আরতি রায়কে সঙ্গে নিয়ে। বরের প্রথম পক্ষের স্ত্রী আর শাশুড়ি মাকে আপ্যায়ন করতে ছুটে এলেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। না দেবশ্রী সেদিন অর্পিতাকে নিরাশ করেননি। বরং দিদির মতোই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। নিমেষে মিডিয়ার সমস্ত ক্যামেরা অভিষেক-সংযুক্তার দিক থেকে ঘুরে গিয়েছিল দুই সতীনের দিকে। নব বিবাহিত দম্পতির কাছে দেবশ্রীকে হাত ধরে নিয়ে গেছিলেন অর্পিতাই। আসলে অর্পিতার ইন্ডাস্ট্রিতে পথ চলা শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে দেবশ্রী রায় নামটা। অর্পিতা তখন অর্পিতা পাল। ‘সানন্দা’ তিলোত্তমা হয়েছিলেন তিনি। সেদিন অর্পিতাকে জয়ের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন বিচারকের আসনে থাকা দেবশ্রী রায়।

সেসব দিন ঐতিহাসিক বটে। সংযুক্তাকে বিয়ে করার পর আর কখনও পরনারী সম্পর্কে বা পরকীয়ায় জড়াননি অভিষেক। দীর্ঘ চোদ্দ বছর স্ত্রী সংযুক্তা, আদরের ‘মৌ’কেই ভালবেসে গেছেন অভিষেক। চাকুরিরতা বউ বলে সংসারের সব দিকে খেয়াল রাখতেন অভিষেক নিজেই। এমনকি আলু-পটলের হিসেবও তাঁকেই রাখতে হত। বৌয়ের জন্য কতদিন রান্না করেও রাখতেন। মাত্র চোদ্দ বছরেই সেরা স্বামী ও সেরা বাবা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন অভিষেক সংযুক্তা ও মেয়ে ডলের কাছে।

একটা সময় অভিষেকের হাতে কোনও কাজ ছিল না। সেসময় অভিষেক শুধু ঠাকুর পুজো করতেন আর তাঁর পাশে ছিল সংযুক্তা। তখন থেকেই ভেঙে গেল প্রসেনজিৎ-অভিষেক বন্ধুত্ব। যে বন্ধুর হাত ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন অভিষেক সেই বন্ধুই হয়ে গেল তাঁর চরম শত্রু। নিজেদের টানাপড়েনের কথা দুই স্টারই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু অভিষেকের হঠাৎ মৃত্যু প্রসেনজিতের সফল কেরিয়ারে কালো দাগ রেখে গেল বৈ কী।