উত্তরের আড্ডার স্ট্রিট লাইব্রেরি। নিজস্ব চিত্র।
শেষ আপডেট: 22nd October 2024 18:52
সুমন বটব্যাল
রাস্তার পাশে টিনের ছাউনে দেওয়া কাঁচের ব়্যাক। সেখানে থরে থরে সাজানো বই। ওপরে টিনের ছাউনি। কী নেই সেখানে! মহাভারত থেকে গীতবিতান! সোনার কেল্লা থেকে ব্যোমকেশ সমগ্র, নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ট ভূতের গল্প, স্বামী বিবেকানন্দের 'মাই ইন্ডিয়া ইজ ইটারন্যাল', তালিকা দীর্ঘতর।
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের অদূরে দেশবন্ধু পার্কের সামনে 'উত্তরের আড্ডা'য় ঠাসা বই! মোবাইল-মুখো মানুষকে বইমুখো করতে লকডাউন পরবর্তী সময়ে স্ট্রিট লাইব্রেরির অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু মানুষ।
সেটা ২০২২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবসে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণনের জন্মদিনে তাঁর প্রতীকী মূর্তি বসিয়ে পাশে এই স্ট্রিট লাইব্রেরির পথ চলা শুরু।
বর্তমানে কয়েকশো বই রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। একটি বইও অবশ্য কেনা নয়। ক্লাবের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এলাকার মানুষজনই এই বইগুলি দিয়েছেন। বছরভর ২৪ ঘণ্টায় খোলা থাকে এই স্ট্রিট লাইব্রেরি। স্থানীয় কাউন্সিলর মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় নিজে উদ্যোগী হয়ে পুরসভার তরফে লাইব্রেরির সামনে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করেছেন। সন্ধে থেকে ভোর পর্যন্ত জ্বলে সেই আলো।
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কলকাতা পুলিশও। দেশবন্ধু পার্কের সামনের মোড়ের এই স্ট্রিট লাইব্রেরির পাঠকদের সুবিধার জন্য রাস্তার একাংশ ট্রাফিক স্ট্যান্ড দিয়ে ঘেরা। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের গুঁড়ি কেটে গদি বানিয়ে রাস্তার ওই ঘেরা অংশে পাঠকদের বসার ব্যবস্থা করেছেন 'উত্তরের আড্ডা'র জনকরা।
তবে এই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যাওয়া বারণ! আপনি চাইলে যতক্ষণ খুশি এখানে বসে বই পড়তে পারেন। কিন্তু কেউ যদি বই নিয়ে পালিয়ে যায়! এক গাল হেসে ক্লাবের কার্যকরী সদস্য সুভাষ দাস বলেন, "কেউ বই চুরি করে নিয়ে যেতে চাইলে নিক! শিক্ষা চুরি হওয়া তো ভাল! তাতে চোরেরও জ্ঞান বাড়বে!"
১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, "ইচ্ছে আছে লাইব্রেরিটাকে আর একটু লম্বা করে বাড়াব। এবং ঝড়ে পড়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি জোগাড় করে আরও একাধিক টুল বসিয়ে দেব। তাতে আরও বেশি মানুষকে আমরা বইমুখো করতে পারব।"
পেশায় চিকিৎসক, আরজি করের প্রাক্তনী কথায় কথায় ফিরে গিয়েছিলেন স্মৃতিতে। "এখন সবাই অনলাইনে সবকিছু পড়ে! কিন্তু হাতে নিয়ে বই পড়ার সেই স্বাদ, সেই অনুভূতি কি আজকের প্রজন্ম বুঝতে পারবে? সময়ের দাবি মেনে মোবাইল, ল্যাপটপ থাকুক। কিন্তু তার পাশাপাশি যেন টেবিলে কয়েকটা বইও থাকে। সকলের মধ্যে বই পড়ার সেই অভ্যস্ততা ফিরিয়ে আনতেই আমাদের এই উদ্যোগ"- নাগাড়ে বলে গেলেন মীনাক্ষীদেবী।
উত্তরের আড্ডার জন্ম আট বছর আগে। এলাকার বিভিন্ন বয়সের ৩০ জন মিলে গড়ে তোলেন এই আসর। নিয়ম করে সকাল-সন্ধে স্ট্রিট লাইব্রেরিতে এসে মানুষকে বইমুখো করার উৎসাহ জোগান তাঁরা। তবু আক্ষেপ ঝরে উদ্যোক্তাদের কণ্ঠে।
ক্লাবের সম্পাদক তপন বসাক, সদস্য রঞ্জিত মান্না, সুভাষ দাসরা বলছিলেন, "এই উদ্যোগের জন্য প্রচুর মানুষ আমাদের প্রশংসা করেন ঠিকই কিন্তু যে কারণে এই লাইব্রেরির সূচনা করা, মানুষকে বইমুখো করার সেই স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। লাইব্রেরির প্রতি মানুষের, বিশেষত নব প্রজন্মের সেই আকর্ষণটাই যেন আর নেই! সবাই মোবাইলে মগ্ন!"
তবে আশার আলো একটাই, উত্তরের আড্ডার তরফে লাইব্রেরির একাংশে 'ওয়াল ম্য়াগাজিনে'র জন্য মাঝে মধ্যেই অনেকে নিজেদের লেখা, ছবি, কবিতা দিয়ে যান। কিছুদিন অন্তর সেগুলো দিয়ে নতুন করে রঙিন হয়ে ওঠে দেশবন্ধু পার্কের সামনের মোড়়ের 'ওয়াল ম্যাগাজিন'।
আজ না হোক আগামীতে নিশ্চয়ই আবার মানুষ বইমুখো হবে। বিদ্যাকে বহন করার পরিবর্তে মানুষ তাকে গ্রহণ করবে। স্বপ্ন দেখেন শ্যামবাজারের ৩০ জন। স্ট্রিট লাইব্রেরির সামনের আড্ডা থেকে সকাল-সন্ধে ভেসে আসে আর্জি, 'আপনি আপনার বন্ধুদের সব সময় পাশে নাও পেতে পারেন কিন্তু বই নামক বন্ধুকে সব সময় পাশে পাবেন। নিজেকে ভাল রাখার জন্য একটু বইমুখো হন প্লিজ।'