না ফাইনাল জিতে তিনি লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো জার্সি খুলে ওড়াননি। দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে অশ্রু সংবরণ করেছেন। তিনি তোম্বা বাভুমা। যাকে এখন বলা হচ্ছে প্রোটিয়া ক্রিকেটার নেলসন ম্যান্ডেলা।
তেম্বা বাভুমা
শেষ আপডেট: 14 June 2025 13:15
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ছোটখাটো উচ্চতার একটু নাদুশনুদুশ চেহারার ছেলেটিকে দেখলে মনে হবে পাশের বাড়ির একটি নিরীহ ভাল ছেলে। কারও সাতে পাঁচে নেই। তিনি আদতে একজন ক্রিকেটার। মিডল অর্ডারে ডান হাতে ব্যাট করেন। গলির ক্রিকেট খেলতে খেলতে একদিন পৌঁছে গেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সমালোচকরা নাক কুঁচকালেন।
এই ছেলে কৃষ্ণাঙ্গ না হলে কি আর দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে (South Africa National Team) সুযোগ পেতেন? ছেলেটি হয়তো মনে মনে কষ্ট পেতেন। কিন্তু তখনই হয়তো মনে একটা সংকল্প স্থির করে ফেলেছিলেন, “জবাব দেব বাইশ গজেই।”
প্রচার বিমুখ সেই ছেলেটি বাইশ গজেই মোক্ষম জবাব দিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরে এল বিশ্বখেতাব, তাও আবার প্রথমবারের মতো। ছেলেটি এখন প্রোটিয়াদের টেস্ট দলের অধিনায়ক। চোট নিয়েও দুরন্ত ব্যাট করে দলকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খাদের কিনারা থেকে তুলে ধরলেন, পাশাপাশি দুরন্ত নেতৃত্ব দিয়ে দলকে করলেন চ্যাম্পিয়ন।
না ফাইনাল জিতে তিনি লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো জার্সি খুলে ওড়াননি। দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে অশ্রু সংবরণ করেছেন। তিনি তেম্বা বাভুমা (Temba Bavuma)। যাকে এখন বলা হচ্ছে প্রোটিয়া ক্রিকেটার নেলসন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela)।
বাভুমাই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ক্রিকেটার যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন এবং জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছেন। বাভুমা হলেন তিনজন দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারের একজন যিনি ওডিআই অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন (সেপ্টেম্বর ২০১৬-এ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৩ রান)।
আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার সঙ্গে বাস্তব জীবনে অনেক মিল রয়েছে তেম্বার। হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতির বিপক্ষে লড়াই করেছেন এই দুই জনই।
ম্যান্ডেলার কাছে ২৭ বছর জেলে কাটানো ছিল দুঃসহ স্মৃতি। এর বাইরেও নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে। তবু লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি ম্যান্ডেলা। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের এই অবিসংবাদিত নেতা। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে সুযোগ পেতে শুরু করেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটাররা। যাঁরা এর আগে পর্যন্ত জাতীয় দলে ব্রাত্য ছিলেন। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাকে এই জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছিল। ম্যান্ডেলা না থাকলে বাভুমা তো বটেই, কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডিরাও বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলতে পারতেন না।
তবে ম্যান্ডেলার তুলনায় বাভুমার সংগ্রাম অনেকটাই সহজ ছিল। যদিও আজ তিনি যে ইতিহাস গড়ছেন, তাতে ম্যান্ডেলার মতোই পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক করেছেন তিনি।
ক্রিকেট-বিশ্বে বরাবরই শক্তিশালী দল হিসাবে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকা। কত বড়বড় ক্রিকেটার উঠে এসেছেন এই দেশ থেকে। কিন্তু বড় মঞ্চে নামলেই প্রোটিয়াদের চিরকালীন ব্যর্থতা প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রেম পোলক, ব্যারি রিচার্ডস, ক্লাইভ রাইসদের কথা ছেড়েই দিন, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স, হাশিম আমলা কতশত ক্রিকেটার! কিন্তু আইসিসির মেগা ইভেন্টে সাফল্য অধরা ছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার দীর্ঘ ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯৯৮ সালে ক্রোনিয়ের নেতৃত্বে জেতা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিই ছিল একমাত্র সাফল্য। এরপর একের পর এক আইসিসির টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেও সেমিফাইনাল গণ্ডি পার হতে না পারার সেই দীর্ঘশ্বাস। একটা সময় তাই তাদের গায়ে জুড়ে গেল ‘চোকার্স’ তকমা।
দীর্ঘ ২৭ বছরের সেই দুঃসহ দহনজ্বাল এবার ঘুচল প্রোটিয়াদের। এ যেন সেই চার দেওয়ালের ছোট্ট কুঠুরিতে কাটানো ম্যান্ডেলার সেই ২৭ বছরের মুক্তির স্বাদের মতোই। ভাঙা হৃদয়ের টুকরাগুলিকে এক এক করে এবার জোড়া লাগানোর নায়কও ম্যান্ডেলার মতোই এক কৃষ্ণাঙ্গ- বাভুমা। পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, বাভুমার নেতৃত্বে টেস্টে এখনও হারের মুখ দেখেনি দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই বাভুমাই ফ্যাফ ডু প্লেসিসের বদলে অধিনায়ক হওয়ার পর ক্রমাগত ট্রোলের শিকার হয়ে আসছেন। তাঁর উচ্চতা, বর্ণ সবই ছিল বিদ্রুপের বিষয়। সঙ্গে কোটা দিয়ে দলে খেলার খোটা তো ছিলই। তবে সব বিদ্রুপের বিপক্ষে মাথা উঁচু করে লড়াই চালিয়ে আসছেন প্রোটিয়াদের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। সেই ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির বাভুমার ছোট্ট কাঁধে ভর করেই এবার অধরা মাধুরীর স্বাদ পেল দক্ষিণ আফ্রিকা।