তাঁর সঙ্গে কাজ করাটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। মনে হয়েছিল আরতির চরিত্রে স্বাতীদি ছাড়া আর কেউ করতে পারবেন না।
বাংলা ছবির ইতিহাসে 'বেলা শেষে' আজও মাইলফলক।
শেষ আপডেট: 23 May 2025 13:20
বাংলা নাটকে পাশ্চাত্য সভ্যতার হাওয়া এনেছিলেন যে অভিনেত্রী তিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত (Swatilekha Sengupta)। শুধু বাংলার নয়, তিনি সর্বভারতীয় নাট্যভূমির অসামান্যা অভিনেত্রী। বাংলা থিয়েটার জগতের নাট্যসম্রাজ্ঞী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর আজ জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে দ্য ওয়ালে স্বনামধন্য পরিচালক ও জনপ্রিয় অভিনেতা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shiboprasad Mukherjee) স্মৃতিতর্পণ করলেন তাঁর স্বাতীদির।
স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর অভিনয় জীবন শুরু এলাহাবাদে মাত্র ৫ বছর বয়সে মন্মথ রায়ের 'কারাগার' নাটকে। যেহেতু এলাহাবাদে বড় হওয়া, তাই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে চারপাশের মানুষ সবাই হিন্দিভাষী। সেই কারণে হিন্দি, ইংরাজি, বাংলা তিন ভাষার নাটকেই পারদর্শিনী ছিলেন স্বাতীলেখা। ১৯৭৮-এ এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় চলে আসেন এবং 'নান্দীকার' নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হন। স্বাতীলেখার প্রথম নাটক নান্দীকারে 'খড়ির গণ্ডি'। এরপর 'আন্তিগোনে' এবং তারপর তো ইতিহাস। একদিকে যিনি 'আন্তিগোনে' করেন মঞ্চে দাপিয়ে, তিনিই আবার 'বেলাশেষে'তে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন। দুটো কত আলাদা অথচ এক অভিনেত্রী। এখানেই স্বাতীলেখা শ্রেষ্ঠা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের 'ঘরে-বাইরে'র বিমলা হলেও, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত 'বেলা শেষে'র আরতি রূপে সর্বস্তরের সর্বশ্রেণীর দর্শকদের কাছে ভীষণ প্রিয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।
আরতি চরিত্রের স্রষ্টা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অকপট সাক্ষাৎকারে দ্য ওয়াল-এ বললেন 'আমার জীবনে সবকিছুর পেছনে তো থিয়েটারই ছিল। আমি কিন্তু প্রথমে থিয়েটারই করতে চেয়েছিলাম। ১৯৯৩ সালে আমার অভিনয় জীবন শুরু হয় 'নান্দীকার' নাট্যদলে। আমি তখন শিক্ষানবিশ ছিলাম। তখন স্বাতীদি আমার শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। স্বাতীদি অসাধারণ নাটক করতেন শুধু নয়, নাটক পড়তেন, বোঝাতেন, ব্যাখা করতেন। স্বাতীদির নাটক পড়ে বোঝানোর ক্লাসের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম। ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার, ওথেলো, জুলিয়াস সিজার, রোমিও জুলিয়েট এইসব নাটকগুলো স্বাতীদি আমাদের পড়ে শোনাতেন। আমার খুব প্রিয় ক্লাস ছিল সেগুলো। বিশ্বনাট্যের একটা অসাধারণ দিক আমি স্বাতীদির কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ওই পিরিয়ডটা আমার জীবনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এত সুন্দর ভাবে উনি পাঠ্যকে বাস্তব অভিনয় করে পড়াতেন যা ভোলার মতো নয়।
নিয়মানুবর্তিতা ঐ সময় আমি স্বাতীদির কাছ থেকে শিখেছিলাম। তখন 'নান্দীকার'-এর মধ্যমণি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। আমাদের রিহার্সাল শুরু হত সন্ধ্যে ৬.৩০টায়, কিন্তু স্বাতীদি বিকেল ৫টার ভিতরে 'নান্দীকার'-এ চলে আসতেন। স্বাতীদির শেখানোর ভিতর আমি কিন্তু ওই দূরত্বটা বোধ করিনি। আমাদের ভীষণ আপন করে নিয়েছিলেন। ঐ সময় থেকেই একটা আত্মিক যোগ তৈরি হয়েছিল।'
'ঘরে-বাইরে'-র বিমলার ৩০ বছর পর 'বেলা শেষে' আরতি রূপে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে বড় পর্দায় ফেরালেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। বাংলা ছবির ইতিহাসে 'বেলা শেষে' আজও মাইলফলক। সে কারণেই আবার একই চরিত্র চিত্রণে 'বেলা শুরু' করেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি।
শিবপ্রসাদ দ্য ওয়ালকে বললেন 'আমার জীবনে এটা একটা অদ্ভুত সময় আসে যখন আমি স্বাতীদিকে ডিরেক্ট করছি। সেটা একটা অন্যরকম পাওয়া। আমার আর নন্দিতা রায়ের মনে হয়েছিল 'ঘরে-বাইরে'র সন্দীপ-বিমলা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর জুটিটাকে এক্সপ্লোর করা হয়নি। আমাদের মনে হয়েছিল ৩০ বছর পর এই জুটিকে ফেরানো উচিত। মঞ্চের স্বাতীদি আমার ভীষণ প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করাটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। মনে হয়েছিল আরতির চরিত্রে স্বাতীদি ছাড়া আর কেউ করতে পারবেন না। আর বিশ্বনাথ একজনই করার মতো আছেন তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই অভিনেত্রী স্বাতীদিকে পাওয়া, অন্যরকম প্রাপ্তি। এতদিন বাদে যখন স্বাতীদি ক্যামেরা ফেস করছেন তখন অনেকটা নার্ভাস ছিলেন। অনেক কুন্ঠা ছিল ওঁর মতো দাপুটে অভিনেত্রীর। বারবার আমাকে বলতেন পারবেন কিনা! যে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে আমি শিক্ষয়িত্রী রূপে পেয়েছিলাম, তিনিই আমাকে বলছেন ঠিক মতো ক্যামেরা ফেস করতে পারব কিনা, এটাও আমার কাছে একটা নতুন দেখা। 'বেলা শেষে' ছবির শেষদিকে যখন স্বাতীদি দীর্ঘ দাম্পত্যে প্রেম আর অভ্যাসের সংলাপ গুলো বলেছিলেন, সেই দৃশ্যের শেষে সবাই হাততালি দিয়ে উঠেছিল, সারা ইউনিট কেঁদেছিল। এটা একজন অভিনেত্রীর কাছেও তো বিরাট বড় প্রাপ্য ছিল।
আমি খুব ভাগ্যে বিশ্বাস করি। আমার সবসময় মনে হয় তোমার প্রাপ্যটা ভগবান একদিন ঠিক তোমাকে দিয়ে দেবেন। 'বেলা শেষে' আর 'বেলা শুরু' ছবি থেকে দর্শকের ভালবাসা, সম্মান, শুভেচ্ছা স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর প্রাপ্য ছিল, দুটো ছবিতেই উনি তা পেয়েছেন। 'বেলা শেষে'র বক্সঅফিস রেকর্ড ছোঁওয়াটা তো অসম্ভব। 'বেলা শুরু'তে স্মৃতিভ্রংশতার শিকার এক মায়ের চরিত্রে স্বাতীদি অনন্য। দর্শক যেভাবে ছবি দুটো দেখেছিলেন সেই ভালবাসার জায়গাটাও ছোঁওয়াটা কঠিন। এটা নিয়তির জায়গায় ছিল, সেটাই স্বাতীদি পেয়েছেন।'
পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এমন এক বিরল মানুষ, যিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আজ তাঁর স্বাতীদির জন্মদিনে এই সোনালি স্মৃতিতেই যাপন করতে চান। জন্মদিন মানেই তাঁর কাছে সেলিব্রেশন। মৃত্যু তাকে কখনও ফিকে করতে পারে না।