মৃণাল ছবিতে ব্রাত্য সাবিত্রী
শেষ আপডেট: 14 May 2025 20:31
আজ মৃণাল সেনের ১০২ তম জন্মদিন। তাঁর ছবির কথা উঠলেই এক ঝাঁক অভিনেত্রীর নাম আমাদের মনে আসে। মাধবী, অপর্ণা, মমতা, শ্রীলা থেকে বম্বের স্মিতা, শাবানা, ডিম্পল। কিন্তু মৃণাল সেনের ছবির আলোচনায় চিরকাল ব্রাত্য রয়ে গেছেন তাঁর প্রথম ছবির নায়িকা। শুধু একটা নয়, মৃণাল সেনের তিনটি ছবির নায়িকা তিনি। অথচ পরিচালকের থেকে প্রাপ্য সম্মান এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী কখনও পাননি। তিনি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। মৃণাল সেনের জন্মদিনের সন্ধ্যেতে দ্য ওয়ালে প্রয়াত পরিচালকের স্মৃতিচারণায় অকপটে মন খুললেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
পরিচালকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেননি বর্ষীয়সী অভিনেত্রী, কিন্তু তাঁর গলায় উঠে এল ভুলতে না পারা দুঃখ। তবু নবাগত পরিচালকদের উপকার আজও করে চলেছেন বাংলা ছবির সত্যি সাবিত্রী।
কেরিয়ারের শুরুতে মৃণাল সেনের জীবন ছিল স্ট্রাগলে ভরা। সংসার চালাবার মতো আয় তাঁর ছিল না। কিন্তু দু চোখে ছিল ছবি বানানোর স্বপ্ন। যে ছবি বদলে দেবে বাংলা ছবির ঘরানা। 'পদাতিক' নিজের তৈরি নতুন পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। পেরেওছিলেন। কিন্ত স্ট্রাগলের দিনগুলোতে পরিচালককে অর্থে বলে সাহায্য করেছিলেন যে নায়িকা তিনি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
মৃণাল সেনের 'রাতভোর', 'অবশেষে', 'প্রতিনিধি' তিনটি ছবির নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী। অথচ নিজের ফিল্মোগ্রাফিতে এই তিনটি ছবিকেই কখনও রাখতে চাননি মৃণাল সেন। মৃণাল সন্ধ্যায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দ্য ওয়ালকে বললেন ' ভাল পরিচালক হবার মতোই মৃণাল বাবুর বিদ্যে বুদ্ধি ছিল। তিনি আগে তখন কোন ছবি বানাননি। মৃণাল সেনের মধ্যে আলো আছে দেখে আমি তাঁর প্রথম ছবি 'রাতভোর' সাইন করি। উত্তমদা (উত্তমকুমার) আর আমি এমন অন্যধারার ছবি করেছিলাম। এরপর উনি 'অবশেষে' ছবিতেও আমাকেই নায়িকা নিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি করে ওঁর সে ভাবে আয় হচ্ছিল না। তাই প্রযোজকও পাচ্ছিলেন না। উনি যে ধরণের ছবি করতেন সেসব ছবি করার কোন প্রোডিউসর উনি পেতেন না। মৃণাল সেন তখন 'প্রতিনিধি' ছবির গল্প চিত্রনাট্য আমায় শুনিয়েছিলেন। গল্প শুনে মনে হয়েছিল এই গল্প নিয়ে ছবি হওয়া উচিত। তখন আমি মৃণাল সেনের 'প্রতিনিধি' ছবিটির জন্য আমার চেনা প্রযোজক জোগাড় করে দিই। শুধু তাই নয়, 'প্রতিনিধি'র নায়িকা চরিত্র করেছিলাম একদম বিনা পারিশ্রমিকে। আমি পারিশ্রমিক নিলে মৃণাল বাবুর ছবিটাই করা সম্ভব হত না। গল্পটা ভীষণ ভাল ছিল, পরিচালনা, প্রোডাকশন খুব ভাল হয়েছিল। ছবিটা প্রাইজ পায় সে বছর। পোস্টারেও ছিল অভিনবত্ব। কিন্তু বক্সঅফিসে একদম চলেনি ছবিটি। আমি বিনে পয়সায় শুধু করিনি, দরকার অদরকারে মৃণাল সেনকে আর্থিক সাহায্যও সে সময় করেছিলাম। মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেনের সঙ্গেও আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। তাঁর বর ভাল পরিচালক তাই তাঁর ছবিতে টাকা দিতেই পারি।'
কিন্তু মৃণাল সেন 'ভুবন সোম' ছবি করে যখন খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন, একের পর এক ছবি করতে লাগলেন, দেশ বিদেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল তখন আর তাঁর প্রথম ছবির নায়িকার কথা মনে পড়েনি। তিনি এমনও বলেছেন 'রাতভোর' ছবিটিকে কেরিয়ার গ্রাফ থেকে মুছে ফেলতে চান। তিনি যেমন ছবি বানাতে চাইতেন প্রথম দিকের ছবিগুলি তা নয়। 'নীল আকাশের নীচে' ছবি সাফল্য পেলেও সেটিকেও মৃণাল সেন রাখতে চাননি ফিল্মোগ্রাফিতে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিরল অভিনেত্রী বাংলা
চলচ্চিত্রের তিন দেব সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিকের পছন্দের তালিকাতেই ছিলেন না। এই বিষয়ে কী বলছেন সাবিত্রী?
বর্ষীয়ান অভিনেত্রীর কথায় 'মৃণাল সেন তাঁর ছবির সব অভিনেত্রীর প্রশংসা বারেবারে করলেও, সারা জীবনে আমার নাম কখনও বলেননি। না বলেছেন না বলেছেন। আমার মনে হয়েছিল তাই তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না। মৃণাল সেনের তিনটে ছবি তাও করেছি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি আমি কখনও করিনি। সত্যজিৎ বাবুকে চিনতাম, উনি আমায় চিনতেন। কিন্তু ডাকেননি কখনও। মৃণাল সেনও যখন বড় মাপের পরিচালক হয়ে গেলেন আমাকে আর কোনও ছবিতে নেননি।'
মৃণাল সেন বেশিরভাগ ভক্তই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই তিনটি ছবি সে অর্থে দেখেননি। অযত্নে আর অবহেলায় মৃণাল সেনের সাবিত্রী অভিনীত তিনটি ছবির আর হদিশ পাওয়া যায় না।'