সন্ধ্যা, মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করে জানলেন তাঁর নাম রাখী মজুমদার। সেই মেয়েকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন সন্ধ্যা রায়।
সন্ধ্যার বাড়িতেই থাকতেন রাখী
শেষ আপডেট: 18 May 2025 17:14
শহরে রমরমিয়ে চলছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের 'আমার বস' ছবি। এই ছবি দেখে নির্মল আনন্দে ভেসে যাচ্ছেন দর্শকরা। ছবির প্রধান আকর্ষণ রাখী গুলজার। জীবনের শেষপ্রান্তেও পর্দা কাঁপাচ্ছেন রাখী। শহর জোড়া রাখী গুলজারের 'আমার বস' ছবির পোস্টার। বহু বছর পর কলকাতায় আবার এলেন রাখী। কিন্তু এতদিন পর রাখীর 'আমার বস' করা হতই না, যদি না লেজেন্ডারি অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় উদ্যোগ নিতেন।
সন্ধ্যা রায়ের আবিষ্কার ছিলেন রানাঘাটের রাখী। আবার এত যুগ পর জীবনের শেষ বেলাতেও রাখীকে বাংলা ছবিতে সুযোগ করে দিলেন সেই সন্ধ্যাই। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায় বা তাপস পালকে মাটির তাল থেকে অভিনেতা তৈরি করেছিলেন সন্ধ্যা রায়। স্বামী পরিচালক তরুণ মজুমদারের পাশে নীরবে থেকে বহু অভিনেতাকে গড়ে দিয়েছেন সন্ধ্যা।
বাংলা ছবির লক্ষ্মী প্রতিমা হলেন সন্ধ্যা রায়। সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রীর জমানাতেই সন্ধ্যার কিন্তু নিজের অসংখ্য ভক্ত ছিল। সন্ধ্যার লক্ষ্মীশ্রী মুখের জোরে তিনি বক্স আর্টিস্ট আখ্যা পান সেসময়। সন্ধ্যা রায়ের মুখ পোস্টারে থাকা মানেই বাঙালি দর্শকের ঢল নামবে প্রেক্ষাগৃহে। এমনকি হিন্দি ছবিতেও সন্ধ্যা অভিনয় করেছিলেন। 'আসলি নকলি'তে দেব আনন্দের সঙ্গে ও 'পূজা কে ফুল' ছবিতে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে। সন্ধ্যা রায় কিন্তু শিক্ষিতা অভিনেত্রী ছিলেন না। খুব নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসেন। কিন্তু 'পূজা কে ফুল' ছবিতে সন্ধ্যার হিন্দি বলা অনেক বেশি সফল ছিল, অন্য বাঙালি নায়িকাদের তুলনায়।
১৯৬১ সালে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় 'আহ্বান' ছবির শ্যুটিং করতে গিয়েছিলেন রানাঘাটে। গ্রামকেন্দ্রিক ছবির গল্প। রানাঘাট তখন একদমই গ্রাম। সেখানেই চলে গেল ফিল্ম ইউনিট। অনিল চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়ের মতো তারকারা গ্রামে। গ্রামবাসী ছুটে এল শ্যুটিং দেখতে। ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল নীল চোখের একটি ফর্সা মেয়ে। সুন্দর মুখশ্রী হলেও গায়ে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। সন্ধ্যা রায়ের চোখে পড়ে গেল মেয়েটি। সন্ধ্যা, মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করে জানলেন তাঁর নাম রাখী মজুমদার। সেই মেয়েকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন সন্ধ্যা রায়।
শোনা যায়, রাখীকে সন্ধ্যা মূলত তুলে এনেছিলেন তাঁর সাহায্যকারিণী হিসেবেই। শ্যুটিংয়ে সন্ধ্যার নানা কাজ সামলাতেন রাখী। তবে সন্ধ্যা রাখীকে টালিগঞ্জের স্যার নৃপেন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশনে ভর্তি করে দেন। সন্ধ্যার বাড়িতেই থাকতেন রাখী।
তবে স্টুডিওপাড়ায় ঘোরার দৌলতে সিনেমার জগত আকর্ষণ করত রাখীকে। সেখান থেকেই ফটোগ্রাফার, প্রোগাম অ্যারেঞ্জার অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ হয় রাখীর। অজয়ের বিপরীতে 'বধূবরণ' ছবিতে প্রথম রুপোলি পর্দায় অভিনয় করেন রাখী। এই ছবির প্রধান নায়িকা ছিলেন গায়িকা গীতা দত্ত।
এরপর সন্ধ্যা ছিলেন 'বাঘিনী' ছবির নায়িকা। পরিচালক বিজয় বসুকে বলে রাখীকে 'বাঘিনী' ছবিতে কাজ পাইয়ে দেন সন্ধ্যা। ক্যামিও রোলে একটি আইটেম ডান্স করেছিলেন রাখী। আশা ভোঁসলে গেয়েছিলেন রাখীর লিপে 'মন নিয়ে কি মরব নাকি শেষে'!
তবে সন্ধ্যাকে না বলেই অজয় বিশ্বাসকে বিয়ে করে রাখী বম্বে পাড়ি দেন। সে সময় প্রচন্ড স্ট্রাগলের জীবন ছিল রাখীর। কিন্তু দু চোখে ছিল নায়িকা হবার স্বপ্ন। টলিউড নয় বলিউডের হিরোইন। এদিকে সন্ধ্যার সঙ্গে সম্পর্কে ধরল চিড়। সন্ধ্যার কাছে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল। রাখী সবটাই গোপন রেখেছিলেন সন্ধ্যার কাছে। যদি সন্ধ্যা না যেতে দেন!
রাখীর সঙ্গে অজয় বিশ্বাসের ঘর টেঁকেনি। শেষমেশ গুলজারের সঙ্গে পরিচয় হয় রাখীর। বাংলা ভাষা ছিল গুলজারের প্রাণ। তাই বঙ্গকন্যা রাখীকে বিয়ে করেন গুলজার। যদিও একমাত্র কন্যা মেঘনা হবার পরপরই আলাদা থাকা শুরু করেন গুলজার আর রাখী। কিন্তু তাঁদের কখনও ডিভোর্স হয়নি। গুলজার চেয়েছিলেন রাখী শুধুমাত্র ঘরের বউ হয়েই থাকবেন। যা মানা অসম্ভব ছিল রাখীর পক্ষে।
তবে সন্ধ্যা রায়ের কাছে গর্বের বিষয় ছিল, যে মেয়েকে তিনি রানাঘাট থেকে তুলে এনেছিলেন সে বম্বের বিখ্যাত নায়িকা। মাঝে কিন্তু যোগাযোগ ছিল না দুই অভিনেত্রীর। বহু বছর পর রাখী নিজেই আবার কলকাতা এসে দেখা করেন সন্ধ্যা রায়ের বাড়ি 'সন্ধ্যানীড়ে'। সন্ধ্যা বুকে টেনে নেন রাখীকে। দুই অভিনেত্রী কেঁদে ভাসান এতদিনের জমে থাকা অভিমান ভুলতে।
রাখী গুলজার অপর্ণা সেনের 'পরমা', ঋতুপর্ণ ঘোষের 'শুভ মহরৎ' ছবির পাশাপাশি ইন্দর সেনের 'চামেলি মেমসাহেব', প্রভাত রায়ের 'প্রতীক', অনিল গাঙ্গুলির 'বলিদান'-এর মতো মেনস্ট্রিম ছবিও করেছিলেন।
এই সময়ের পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে চাইতেন রাখী। শিবপ্রসাদ-নন্দিতার বেশ কয়েকটি ছবি মুম্বই বসে দেখেছিলেন তিনি। সবথেকে ভাল লাগে তাঁদের 'হামি'। শিশুশিল্পীদের অভিনয় মন জয় করে নেয় রাখীর।
কিন্তু কলকাতার এখনকার পরিচালকদের সঙ্গে পরিচয় ছিল না তাঁর। গুরু মা সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে ফোনে প্রায়ই কথা হত রাখীর। সন্ধ্যাকেই রাখী বলেন তিনি শিবপ্রসাদ-নন্দিতার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। সন্ধ্যা রায় নিজেই উদ্যোগ নিয়ে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে বলেন 'রাখী গুলজার তোমাদের ছবি দেখেছেন। তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। রাখীর সঙ্গে যোগাযোগ কর।'
শিবপ্রসাদ হাতে চাঁদ পান। এই ঘটনার কথা সম্প্রতি এক সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানান শিবপ্রসাদ।
রাখীর সঙ্গে সাক্ষাতে ঠিক হয় 'আমার বস' ছবির কথা। চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ শুনে শিবপ্রসাদকে রাখী বলেন 'আমার ছেলের চরিত্র কে করবে এই ছবিতে?' শিবপ্রসাদ বলেন 'দেখছি কোন ভাল অভিনেতা যদি পাওয়া যায়!' রাখীর উত্তর ছিল 'অন্য কোন অভিনেতা নয়, যদি শিবু তুমি আমার ছেলের রোল কর তাহলেই আমি এই ছবি করব!' আর তারপর তো 'আমার বস' রিলিজ হতেই ইতিহাস। এত বছর পর রাখীর বাংলা ছবিতে কামব্যাক ও রাখী-শিবপ্রসাদের মা-ছেলের রসায়নে মুগ্ধ দর্শক।
তবে সন্ধ্যা রায়ের হাতযশ না থাকলে 'আমার বস' ছবির শুভ্রা গোস্বামী রাখীকে আমরা পেতাম না।