এমন উদাহরণ অলীক, তবু কোনও দিন কোনও অফিস যদি করে দেখাতে পারে, তাহলে পৃথিবীটা সত্যি স্বপ্নের দেশ হয়ে যাবে।
ভাবনা অলীক হলেও পর্দায় সত্যি করে দেখালেন শিবপ্রসাদ -নন্দিতা।
শেষ আপডেট: 13 May 2025 19:51
ছবি - আমার বস
পরিচালনা - শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়
চরিত্র চিত্রণে - রাখী গুলজার, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী, গৌরব
দ্য ওয়াল রেটিং - ৮/১০
মেয়ের রাখী পূর্ণিমার দিন জন্ম বলে নাম রাখা হয়েছিল রাখী। সেই রাণাঘাটের মেয়ে হয়ে উঠলেন বলিউড বিজয়িনী রাখী গুলজার। বহুদিন পর 'আমার বস' বাংলা ছবিতে কামব্যাক করলেন বর্ষীযান অভিনেত্রী। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন পর্দায় দেখতে পেলাম শ্বেতশুভ্র বসনা রাখী গুলজারকে। 'পরমা' এবার শুভ্রা গোস্বামী রূপে। নীলনয়না রাখীর পূর্ণিমার আলো যেন ছড়িয়ে পড়েছে পর্দায়।
'একাকীত্ব' আমাদের শহরের বড় অসুখ। ছেলেমেয়েদের কর্মব্যস্ততার যুগে তাঁদের আর বাবা-মায়ের জন্য কোনও সময় নেই। এ দোষ সন্তানদের নয়, সময়ের। চাকরির কাছে বন্দি তাঁরা। অফিসের বসের চাহিদা মেটাতে মেটাতে এ যুগের ছেলেমেয়েদের আর বাবা-মা-ঠাকুমাদের সঙ্গে বসে লাঞ্চ-ডিনার করা হয় না, গল্প করা হয় না । এই গভীর সমস্যা থেকে মুক্তির পথ দেখালেন শুভ্রা গোস্বামী ওরফে রাখী গুলজার। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের 'আমার বস' যেন 'সপ্তপদী'-র সেই গানের মতো 'পৃথিবীটা যদি স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হত!'
ছবির শুরুতেই মন পড়ে যাবে মান্না দের সেই গান
'মা মাগো মা, মা গো মা,
আমি এলাম তোমার কোলে,
তোমার ছায়ায় তোমার মায়ায়
মানুষ হব বলে... '
সব স্তরের মানুষের কাজের ব্যস্ততার মধ্যে মায়ের ফোন এলে তা ধরতে হয় সবার আগে। মায়ের কোলে মাথা রাখার সময় যে আর বড় বয়সে থাকে না। তাই মায়ের ফোন কলটুকু সম্বল। এমন দৃশ্য দিয়েই ছবির শুরু মন ভাল করে দেয়।
বই প্রকাশনা অফিসের কর্ণধার অনিমেষ (শিবপ্রসাদ) কাজের চাপে বিধ্বস্ত। এদিকে কর্মীরাও সঠিক সময়ে মনের মতো কাজ করে উঠতে পারেন না। ওদিকে অনিমেষের মা বাড়িতে একা। ঠিক এমন সময় অনিমেষের মা শুভ্রা দেবী এসে হাজির হন ছেলের অফিসে। তিনি ছেলের সঙ্গেই থাকবেন সারাদিন, ছেলের সঙ্গেই লাঞ্চ সারবেন। মায়ের এমন অদ্ভুত খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য ছেলের জীবন অতিষ্ঠ। মা বলে বসেন তিনি ছেলের অফিসে প্রুফ রিডার ট্রেনি হিসেবে জয়েন করবেন। ছেলে শেষ অবধি মানতে বাধ্য হন মায়ের মর্জি। আর এভাবেই নিত্যদিন অফিস যেতে যেতে মা আবিষ্কার করেন অফিসের প্রতিটি সহকর্মীকে বাড়িতে বাবা-মাকে একলা ফেলে আসতে হয়। অফিসে থেকেও সন্তানদের মন পড়ে থাকে বাড়িতে মা-বাবার চিন্তায়। সন্তানদের অজান্তেই বাড়িতে ঘটে যেতে পারে কোনও অঘটন। এমন সামাজিক অবস্থা থেকে মুক্তির পথ দেখালেন শুভ্রা নিজেই। তিনি বললেন বাচ্চাদের ডে কেয়ার ক্রেশ যেমন হয় তেমন প্রকাশনার অফিসের এক তলায় হবে বাবা-মায়ের ক্রেশ। ভাবনা অলীক হলেও পর্দায় সত্যি করে দেখালেন শিবপ্রসাদ -নন্দিতা।
রাখী গুলজারের 'আমার বস' দেখলে আট থেকে আশি সবার ভাল লাগবে। সিনেমাহলে এক ঝাঁক খুদে দর্শকও কিন্তু নীরব ছিল এই ছবি দেখে। এই ম্যাজিক একমাত্র শিবপ্রসাদ-নন্দিতারই জানা। বহু বছর পর বাংলা ছবি করলেও রাখীর স্বাভাবিক অভিনয়ে এতটুকু ধুলো পড়েনি। তিনি পর্দায় এলেন এবং ছবির রাশ টেনে রাখলেন শেষ অবধি। একটা আভিজাত্যের পরশ যেন রাখী বুলিয়ে দিলেন।
ছেলে শিবপ্রসাদের সঙ্গে রাখীর রসায়ন অনবদ্য। শ্রাবন্তীর শিবপ্রসাদের রসায়নের থেকে পর্দায় বেশি জমেছে এই মা-ছেলের সম্পর্ক। শিবপ্রসাদের সঙ্গে মা রাখীর মতভেদের টক্কর কিছু জায়গায় শিবুকে খলনায়ক বানালেও ছবি শেষে মা আর ছেলে লাড্ডুর মিল সবার মন জয় করে নেয়। শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় উচ্ছল চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন। সহকর্মীদের চরিত্রে গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের লুক, শ্রুতি দাসের সোজাসাপ্টা সংলাপ, হিসাবরক্ষক কাঞ্চন মল্লিকের দুষ্টুবুদ্ধি থেকে ভাস্কর ব্যানর্জির ভদ্রোচিত চরিত্র, আভেরির মাতৃত্বকালীন অভিনয়, সৌরসেনীর আবেদন, যামিনী চরিত্রে উমার প্রানচ্ছলতা ছবিটিকে চালচিত্রের মতো ভরিয়ে তুলেছে।
তবে সবাইকে অভিনয়ে মাত করে দিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। কমেডি 'পাশের বাড়ি'র নায়িকার রক্তে, তা আবার প্রমাণিত হল। রজত গাঙ্গুলি আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বাথরুমে যাওয়া নিয়ে কমেডির যুগলবন্দী সারা ছবিঘরের দর্শককে হাসিয়ে ছাড়ে। চিত্রনাট্যের বুনোট কয়েক জায়গায় আলগা হলেও সেসব শূন্যস্থান ভরিয়ে দিল সাবিত্রীর প্রাণবন্ত অভিনয়।
সঙ্গীতে অনুপম রায়ের ' মালা-চন্দনে বেঁধো না' গানটি ছবির প্লট অনুযায়ী অনবদ্য। গানটি বারবার ফিরে আসে পর্দায়, যা মন কেমন করায়। সরস্বতী পুজোর বসন্তের প্রেমের গানটিও মন ভাল করা। তবে গানের মান আরও উৎকৃষ্ট হতে পারত। সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্রসঙ্গীতে সৌরসেনীর অভিনয় চিত্রনাট্যের দাবি মিটিয়েছে মাত্র।
অফিসের ছাদে সরস্বতী পুজো থেকে সুদৃশ্য ক্যান্টিনের সিনেমাটোগ্রাফি অনবদ্য। পোশাক পরিকল্পনায় অভিষেক রায় দুরন্ত।
এ শহরটা যখন একটা বৃদ্ধাবাসে পরিণত হচ্ছে তখন 'আমার বস' ছবি সত্যি বড় প্রাপ্তি। বাবা-মায়ের জন্য ডে কেয়ার খুললে নার্সদের পরিচর্যায়, সবার বন্ধুত্বে কত প্রবীণ প্রাণ হঠাৎ আসা বিপদের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই ছবি। এমন উদাহরণ অলীক, তবু কোনও দিন কোনও অফিস যদি করে দেখাতে পারে, তাহলে পৃথিবীটা সত্যি স্বপ্নের দেশ হয়ে যাবে।