মা কখনও আমাদের বলেননি তোমাদের শাঁখাপলা পরতেই হবে। কোনদিনও বলেননি এই বাড়ির নিয়ম এটা তোমাকে পরতেই হবে। আমি নিজেও মা হয়ে গেছি কিন্তু এখনও শ্বশুরবাড়িতে জিন্স,টপ, টি শার্ট পরি। কোন রক্ষণশীলতা নেই। তবে পোশাক নির্বাচনে নিজের চক্ষুলজ্জা বোধটা হওয়া উচিত।
মম মাসি থেকে মম মায়ের গল্প
শেষ আপডেট: 16 May 2025 11:33
'মম' মানে আপন। ঠিক তেমনই সকলকে আপন করে নিতে পারেন মমতা শঙ্কর। 'পদ্মশ্রী' বিজয়িনী হয়েও তাঁর পা মাটিতে। তিনি কারও মমদি, কারও মমমাসি কারও বা মা। 'শাশুড়ি কখনও নিজের মা হয় না' এই মিথকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন মমতা শঙ্কর ঘোষ। মাতৃ দিবসের মাসে মমতা শঙ্করের দুই বৌমা, শাশুড়ি মাকে নিয়ে অকপটে মন খুলে কথা বললেন এই প্রথম বার। 'দ্য ওয়াল'-এর মাদার'স ডে স্পেশাল আড্ডায় মমতা শঙ্করের দুই পুত্রবধূ, বড় বউ সুদেষ্ণা শঙ্কর ঘোষ ও ছোট বউ সৌরিতা শঙ্কর ঘোষ।
দুই বৌমাই খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে শঙ্কর ঘোষ পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন। একদিকে বিশ্ববরেণ্য শিল্পী উদয় শঙ্কর, অমলা শঙ্কর, রবি শঙ্কর যে পরিবারের মানুষ অন্যদিকে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋতুপর্ণর নায়িকা ও জগৎখ্যাত নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করকে শাশুড়ি রূপে পাওয়া- পুত্রবধূদের প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
বড় বউ সুদেষ্ণা শঙ্কর ঘোষ দ্য ওয়ালকে জানালেন 'আমি ১০ বছর বয়স থেকে মমমাসির কাছে নাচ শিখছি। তখন তো বোধ ছিল না মমতা শঙ্কর কত বড় মাপের নায়িকা, ডান্সার রূপে কতখানি তাঁর খ্যাতি। মাতৃস্নেহে সব ছাত্রছাত্রীদের মতোই উনি আমাকে আপন করে নেন। মমতা শঙ্কর আর মমমাসি দুটো নামের মধ্যে যতখানি তফাত, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কটাও ঠিক ততখানি কাছের। মমমাসির বাড়ি আমি বড় বউ হয়ে যাব এই ভাবনাটা একেবারেই ছিল না। আমি সল্টলেকে থাকতাম। ১৯৯০ সালে প্রথম 'উদয়ন' নৃত্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই। শুধু নাচ নয় ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত সমস্যাও মা সমাধান করে দিতেন । কারও মুখ ভার দেখলেই মা জিজ্ঞেস করতেন 'কী হয়েছে রে তোকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে?' যে বিষয়ে নাচের স্কুলের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই, সেই বিষয়টাও মা মন দিয়ে ঘন্টা খানেক ধরে বসে আজও শোনেন, এত বড় শিল্পী হয়েও। ডান্স কোর্স সম্পূর্ণ করার পর, মমমাসির সঙ্গে নাচের শোয়ের ট্যুরে যখন গেছি মানুষটাকে আরও কাছ থেকে চিনেছি। এরপর মমমাসি থেকে যখন মা হতে চলেছেন এই সময়টা আমার নিজের কাছে খুব স্ট্রাগলের। ছাত্রী থেকে শঙ্কর পরিবারের বড় বউ । নিজের মনের কাছেও তো বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে এটা কী হতে চলেছে। অসম্ভব ভয়, অসম্ভব সংকোচ! আসলে রাতুলের তরফ থেকেই আমার কাছে প্রস্তাব আসে। রাতুলের সাহচর্যেই আমি শঙ্কর পরিবারে সবার কাছের হয়ে উঠতে পেরেছি।
সেই ভয়টা রাতুল অনেকটা কাটিয়ে দিয়েছিল। আমি অত্যন্ত মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা-মায়ের কাছে রাতুল খুব প্রিয় হলেও পরিবারের এই ফারাকটা নিয়ে ওঁদের দ্বিধা ছিল। এটা হতে পারে না। আমার পরিবারকে নিশ্চিন্তে বিয়েতে সম্মতি দিতে আমার বর রাতুল অনেকখানি সাহায্য করে। মমমাসি এই ফারাকটা কোনও দিনই বুঝতে দেননি। মা আমার শ্বশুরবাড়ির নতুন নাম দেন রাই। রাতুল কথার অর্থ শ্রীকৃষ্ণের রাঙা চরণ। তাঁর স্ত্রীর নাম মা দিলেন রাই। ঈশ্বরের আশীর্বাদে এ বছর আমাদের বিয়ের ২০ বছর হতে চলল।'
ছোট বউ সৌরিতা শঙ্কর ঘোষও কিন্তু ১০ বছর বয়সেই দক্ষিণেশ্বর থেকে উদয়নে নাচ শিখতে আসতেন। সেখানেই মমতা শঙ্কর ঘোষ ও চন্দ্রোদয় ঘোষের ছোট ছেলের সঙ্গে পরিচয় থেকে মন বিনিময়। যদিও সৌরিতা ভীষণ ভয় পেতেন তাঁর মমমাসিকে। স্নেহের মাঝেও একটা শ্রদ্ধার দেওয়াল ছিল। ছোট বউ সৌরিতা বললেন 'উনি মমতা শঙ্কর সেটা কিন্তু মা একদমই বুঝতে দেননি কখনও। মমমাসির কাছে নাচ শেখা মানে নিজেকে ভাল মানুষ হিসেবেও তৈরি করা। উদয়নে নাচের পাশাপাশি বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে, সম্মান করবে, ছোটদের কীভাবে সম্মান করবে সবটাই শেখানো হয়। এখনও মাকে বলি আমার দশ বছর বয়সে প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছিলাম নাচের ক্লাসে সেই ছবিটা চোখে ভাসে, মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের শাড়ির আঁচল থেকে কুঁচি একেবারে নিখুঁত ভাঁজে বিন্যস্ত, খোলা লম্বা চুল, কপালে লাল টিপ। মমমাসি কখনও দুটো ভ্রুর মাঝখানে টিপ পরা পছন্দ করতেন না। প্রথম দিন ক্লাসে আমার মা আমার ভ্রুর মাঝখানে টিপ পরিয়ে দিয়েছিলেন। মমমাসি ক্লাসে আমাকে ডেকেছিলেন সবার মাঝখান থেকে। আর এক জনকে ডেকে তার ভ্রুর মাঝে আর ভ্রুর ওপরে টিপ পরিয়ে আমাকে মমমাসি জিজ্ঞেস করলেন 'দেখো তো কোনটা বেশি ভাল লাগছে?' কখনও চাপিয়ে দিতেন না, মমমাসি শিখিয়ে দিয়ে তফাতটা দেখাতেন। নাচের ক্ষেত্রেও কোন মিউজিকের সঙ্গে কোন নৃত্যভঙ্গি যাচ্ছে এটা আমরা 'উদয়ন' থেকে শিখেছি। ক্লাস শেষে সবার নাচের সমালোচনা করা হয় তাদের ঠিকটা শেখাতে। কিন্তু যখন ছাত্রছাত্রীদের বলবে সেটা যেন তাদের খারাপ না লাগে। শেখানো মানে তাদের ছোট করে, অপমান করে বলা নয়। শেখানোর সময় কথাটা কী ভাবে বলবে সেটাও মা শেখান। শুধু নাচ নয়, একটা কাজের সঙ্গে দশটা কাজ কীভাবে করবে সেটাও মা শিখিয়েছেন। নাচের পাশাপাশি উদয়নের অফিসিয়াল কাজ আমায় বাবা চন্দ্রোদয় ঘোষ শিখিয়েছিলেন। বিয়ের আগে মেসো বলতাম। অফিসেই আমার বরের সঙ্গে আলাপ। আমি আর আমার বর ঋজুল সমবয়সী। কাজ করতে করতে ঋজুলের সঙ্গে ভাল লাগাটা ধীরেধীরে ভালবাসায় পরিণতি পেল। তবে মমমাসির ছেলে সেই ভয়টা ছিল। আমার বর খুব সোজাসাপ্টা। ঋজুল প্রথম মাকে বলে আমাকে ওর ভাল লেগেছে। মমমাসি আমায় একা একদিন ডেকে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলেন। পরের পদক্ষেপ গুলোতে ভালবাসাটা থাকবে তো? আমার নিজের উপর সেই বিশ্বাস আছে তো? তারপরই তো ভালবাসার বিয়ে পরিণতি পায়।'
শাশুড়ি মমতা শঙ্কর পুত্রবধূদের কাছে নিজের মা হয়ে উঠতে পেরেছেন কতটা? ছোট বৌমা সৌরিতা বলছেন 'মমমাকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। সারাটা দিন আমি মানুষটার থেকে শিখছি। বিয়ের পর আমি যখন প্রথম এ বাড়িতে আসি বৌভাতের আগের দিন রাত দেড়টার সময় সবার মাঝে মা আমাকে বলেন 'তোকে আমি সই বলে ডাকব আজ থেকে!' বড় বউয়ের শ্বশুরবাড়ির নাম যেহেতু রাই, তাই মা আমার নতুন নাম দিলেন 'সই'। বাড়িতে মায়ের কোন স্টারডম নেই। বাড়িতে আমার ছেলে বয়সে সবার ছোট। কিন্তু মা হল সবথেকে বাচ্চা। মা একেবারেই নিজের যত্ন নেন না। ওঁর মতো তারকারা নিজেদের যে যত্ন নেন, মা তার কিছুই করেন না। ছবির প্রিমিয়ার বা কোন বড় অনুষ্ঠানে মা শুধু শাঁখা পলা পরেই চলে যান। আমি মাকে বলি কয়েকটা চুড়ি অন্তত পরে অনুষ্ঠানে যাও। মা বলেন শাঁখা পলাই আমার সবথেকে সম্মানের অলঙ্কার। এগুলো দেখেই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
বড় বৌ সুদেষ্ণা বলছেন 'মাকে যে কেউ যে কোনও উপহার দিলে মা ভীষণ আপ্লুত হয়ে যান। সে দামি গিফট হোক বা গড়িয়াহাটের ফুটপাত থেকে কেনা একটা টিপের পাতাই হোক , সেটা মা এত খুশি হয়ে গ্রহণ করেন যা শেখার মতো। প্রতিটা উপহার কে কবে দিয়েছেন মা সব মনে রাখতে পারেন। এমনকী ছোটবেলায় পাওয়া গিফটও। পুরনো সুটকেস খুলে একটা ব্লাউজ পিস পেলেও মা বলতে পারবেন কে দিয়েছেন। মায়ের আরো দিক বলি যা ওঁর ভক্তরা জানেন না। মায়ের কাছে বিভিন্ন ফোন কল আসে, যাঁদের মা কোনদিন দেখেননি, তাঁরা মায়ের সঙ্গে শুধু কথা বলে ধন্য হতে চান। মা এত কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁদের জন্য কথা বলার সময় রাখেন। মিসড কল হয়ে গেলে কল ব্যাক অবধি মা নিজেই করেন। এই তো কদিন আগে, একজনদের গৃহপ্রবেশে মাকে একবার তাঁদের নতুন বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। তাঁদের মা-বাবা মমতা শঙ্করের ভক্ত ছিলেন। তাঁরা আর জীবিত নেই। তাঁদের সন্তান মাকে নিমন্ত্রণ করেছেন নতুন বাড়ি দেখতে । তাঁদের বিশ্বাস মমতা শঙ্করের আগমনে বাড়ির শুভ সূচনা হবে।
এয়ো স্ত্রীর চিহ্নগুলোকে মমতা শঙ্কর অসীম শ্রদ্ধা নিয়ে মেনে চলেন। তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে কখনও সরেননি, সরেন না। কিন্তু তাঁর এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারণ করে কিছু মানুষ তাঁকে ট্রোল করতেও ছাড়েন না। মমতা শঙ্কর নাকি রক্ষণশীল। নিজের হিন্দু ধর্মের রীতিকে সম্মান করা কেন রক্ষণশীল মানসিকতা হবে? একদল মানুষের বক্তব্য মমতা শঙ্কর নাকি তাঁর পুত্রবধূদের ওপর এইসব রক্ষণশীলতা জোর করে চাপিয়ে দেন। কী বলছেন সরাসরি তাঁর ছেলের বৌয়েরা?
বড় বৌ সুদেষ্ণা বললেন 'শাশুড়ি কখনও মা হতে পারেন না', আমাদের জন্য সম্পূর্ণ কথাটাই ভুল। মম মাসির আগে আমি আমার মাকে দেখেছি এয়ো স্ত্রীর চিহ্ন গুলোকে সম্মান করতে। শাঁখা পলা সবসময় আমার মাকেও পরে থাকতে দেখেছি আর খোঁপার ওপর ছোট্ট করে ঘোমটা দিয়ে থাকতেন। উদয়ন নাচের স্কুলে এসেও একই সাজে দেখলাম মম মাসিকে। এসবের বাইরে যাবার কথা আমার কোনওদিনও মনেই হয়নি। ছোটবেলায় গামছা দিয়ে লম্বা চুল করে, একটা টিপ পরে, মায়ের শাঁখাপলা পরে সেজেছি। এই ইচ্ছেগুলো ছোটবেলা থেকেই ভিতরে আমার ছিল। সব রকমের পোশাক পরি আমরা। কিন্তু কখনও মনে হয়নি জিন্স পরছি বলে শাঁখা-পলা খুলে রাখব। মা কখনই আমাদের উপর কিন্তু এই শাঁখাপলা পরতেই হবে এটা এক্কেবারেই চাপিয়ে দেননি। যারা মায়ের কথার বিরুদ্ধাচারণ করছেন তাঁরা যদি নিজেদের মায়েদের দিকে একবার তাকান আমার মনে হয় প্রত্যেকের মায়েরাই এগুলো করে এসছেন। এখনকার মায়েদের অনেকেই হয়তো শাঁখা সিঁদুর পরেন না । কিন্তু আমি আমার মা,কাকিমা, জ্যাঠিমা সবাইকে এয়ো স্ত্রীর চিহ্ন গুলোকে সম্মান করে পরতে দেখেছি। এই মূল্যবোধ নিয়ে আমি বড় হয়েছি। এটা তো আমার কাছে ভালবাসার। মাকে নিয়ে ইদানীং চর্চা হলেও মা কিন্তু সবাইকে বলেননি শাঁখা সিঁদুর পরতে। মা নিজে কী করেন সেটা বলেছেন। কোন ইন্টারভিউতে মা এটা বলেননি প্রত্যেক বিবাহিতা মেয়েকে শাঁখা সিঁদুর পরতেই হবে। এটা সব মায়েদেরই বলতে শুনেছি শাড়ি পরলে ঠিক ভাবে পড়, চুড়িদারের ওড়নাটা ঠিক ভাবে রাখো। মমতা শঙ্কর বলেছেন তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস। সেই বয়স্ক শ্রদ্ধেয় মানুষকে অপমান করে কথা বলার অধিকার কারুর নেই। যাঁরা বলছেন তাতে তাঁদের শিক্ষা, পারিবারিক সংস্কৃতির দৈণ্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। বড়দের কী ভাবে বলছি সেই বলাটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে আমার বেড়ে ওঠার ওপরে সংশয় জাগে! আমরা শুধু দুই বউই মায়ের সাজ ফলো করি তা নয়, উদয়নের সমস্ত ছাত্রীর মধ্যেই মমতা শঙ্করের সাজের ছাপটা আছে। '
মমতা শঙ্কর কেন্দ্রিক আঁচল আর শাঁখা সিঁদুর বিতর্ক নিয়ে ছোট বৌ সৌরিতা বলছেন 'মায়ের চিন্তাভাবনা ভীষণ আধুনিক। বিয়ের পর কখনও মা আমাকে বলেননি সবসময় শাড়ি পরে থাকবে, কুর্তা পরলে ওড়না দিয়েই থাকতে হবে। শাড়ি, কুর্তা থেকে ওয়েস্টার্ন, সবরকমের পোশাক পরতে মা আমাদের দুই বৌমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু পোশাক পরার শালীনতাবোধ আমাদের শিখিয়েছেন মা। কোন পোশাক পরলে ভাল লাগবে আর কোন পোশাক ভাল লাগবে না, সেটা আমরা 'উদয়ন' থেকে শিখেছি। মা কখনও আমাদের বলেননি তোমাদের শাঁখাপলা পরতেই হবে। কোনদিনও বলেননি এই বাড়ির নিয়ম এটা তোমাকে পরতেই হবে। আমি নিজেও মা হয়ে গেছি কিন্তু এখনও শ্বশুরবাড়িতে জিন্স,টপ, টি শার্ট পরি। কোন রক্ষণশীলতা নেই। তবে পোশাক নির্বাচনে নিজের চক্ষুলজ্জা বোধটা হওয়া উচিত। বাঙালি হিসেবে আমরা মাকে নিয়ে গর্ব করি। এত অ্যাওয়ার্ড শোতে মা যখন যান কাঞ্জিভরম পরে ঐ বাঙালিয়ানাটাকে সাজের মধ্যে ধরে রাখেন। আমরাও শিখেছি মায়ের থেকে বাঙালির বড় অলঙ্কার শাড়ি। শাড়ির মতো সুন্দর অন্যকিছুতে লাগে না। মা বলেন 'হাতের শাঁখাপলা আমার সবথেকে বড় শক্তি'। ছোট বয়সে মাকে দেখা আর অভিজ্ঞতা বেড়ে বড় বয়সে যখন মাকে দেখি তত শিখি। এমন বড় মাপের শ্বশুর-শাশুড়িমাকে পেয়ে আমরা ভীষণ ভাগ্যবতী। মা একদমই ঠিক কথা, উচিত কথাই বলেন। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, তেমন সব মানুষ সমান হয় না। নিজেদের মতামত নিজেদের কাছে। এয়োস্ত্রীর চিহ্ন পরা কারোর ভাল না লাগতেই পারে। মা নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। তবে নিজেদের ভাল লাগেনি বলে উচিৎ বলা মানুষটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করব না। এত রকম রাজনীতির জমানায় মা যে সত্যি কথা বলার সাহস রাখছেন এটা নতুন প্রজন্মকে চোখ খুলিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কী ভাবে নিজের জায়গায় অনঢ় থাকতে হয়। মা বারবার বলেন 'তোমরা ঝাঁকের কই, ঝাঁকে মিশে যেও না। নিজেদের এমন ভাবে তৈরি কর যাতে আর পাঁচটা মেয়ের থেকে তোমরা স্বতন্ত্র বজায় রাখতে পারো। তোমরা নিজেরা নিজেদের আলাদা বলবে না। বাইরের মানুষ তোমাদের দেখে বলবে তোমরা সত্যি আলাদা।'
শঙ্কর পরিবারে সবাই বিখ্যাত নাম। এই আলোকবৃত্তের মধ্যে পুত্রবধূদের ঢুকতে কখনও ইচ্ছে করে না? যেখানে তাঁরাও দক্ষ নৃত্যশিল্পী, শঙ্কর ঘরানার ধারক বাহক। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সে অর্থে তাঁদের দেখা যায় না। খ্যাতি না শুধুমাত্র পরিবারের অংশ হয়েই তাঁরা দু'জন থাকতে চান?
সুদেষ্ণা বললেন ' আমার কাজটা অন্য। আমি নাচ মায়ের কাছে শিখলেও, আমি পারফর্ম করি না। আমি উদয়নে নাচ শেখাই ছাত্রছাত্রীদের। খ্যাতির মোহ কখনও হয়নি। আগে কিন্তু আমি মমতা শঙ্কর ডান্স ট্রুপে নাচ করতাম। আমার কোমরের সমস্যার জন্য ৭ বছর আমি শুয়েই কাটিয়েছি। ঠাকুরের ইচ্ছেতে সত্য সাই বাবার কৃপাতে আবার আমি নাচ করতে পারছি। নাচ শেখানোই যখন আমার প্যাশন তাই অন্যদিকগুলোতে আর ইচ্ছে করেনি। পেছন থেকে আমার বর রাতুলকে, মাকে যতটা সাহায্য করা যায় আমি সেটাই করি। এই যে ৭ বছর আমি নাচতে পারিনি মা আমাকে বারবার নাচের জগতে ফিরে যেতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। আমাদের দুই বৌমার সঙ্গে মা যে কী মজা করেন, কত দুষ্টুমি করেন কী বলব!'
সৌরিতা কিন্তু মমতা শঙ্করের প্রতিটি শোতে পারফর্ম করেন। তিনি বলছেন ' আমার শ্বশুরমশাই ও শাশুড়ি মায়ের ভালোর শেষ নেই। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। সত্যি ভাবি কতটা ভাল এনারা। নাচের বাইরেও সাংসারিক কাজ থাকে জীবনে চলতে গেলে।
মা তো আমাকে নাচও শিখিয়েছেন, আবার রান্নাও শিখিয়েছেন। আমজনতা তো জানেন না মমতা শঙ্করের রান্নার গল্প। মা বলেন 'ভালবেসে রান্নাটা করবি, তাহলে সেই রান্নার স্বাদ ভীষণ ভাল হয়। আমি আমার নিজের মায়ের কাছে কখনও রান্না শিখিনি। ছ্যাঁকা খেয়ে যাব, হাত পুড়ে যাবে তাই আর শেখাননি। কিন্তু বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে মম মার থেকে রান্না শিখেছি। কোন চাপে পড়ে নয়, ভালবেসে শিখেছি। মা বলতেন 'চল সই, আমরা একটা রান্না করি।' বিয়ের পর মা, আমি, আমার বর তিনজনে মিলে রান্নাঘরে ঢুকে খুব রান্না করেছি। নুন মিষ্টির স্বাদ কেমন হবে, মশলা কতটা দিলে রান্নাটা চোখা স্বাদ হবে সব জেনেছি শাশুড়ি মায়ের থেকে। রান্না যেমনই করি খাবার টেবিলে সবাই এমন ভাবে প্রশংসাটা করেন তাতে নতুন আর একটা রান্না করার ইচ্ছে জাগে। মেকি ভাল বলা নয়, এমন ভাবে বলেন মনটাও খুশি হয়ে যায়। এই যে নতুন রান্না তৈরির ইচ্ছে জাগানো, এই করতে করতে আমি সব রান্না শিখে গেছি। মা এখন বলেন আমার দুই বউ, সই আর রাই আমার থেকেও ভাল রান্না করে।'
মমতা শঙ্করের সংসার আজও একান্নবর্তী। সংসারের এই ভাঙন কালের যুগে শঙ্কর ঘোষ পরিবারের একতার মূল মন্ত্র শিক্ষণীয়। বড় বৌ সুদেষ্ণার কথায় 'আমার সঙ্গে আমার ছোট জায়ের খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক। শ্বশুরবাড়িতে আমি প্রথম আসি যখন তখন বাবা, মা,রাতুল এত সহজ করে দিয়েছে, যে চাপটা কখনও মনে হয়নি। ওঁনাদের অবদান বেশি কারণ বাইরে থেকে আসা আমাকে এত সহজে মেনে নিয়েছেন ওঁরা। আমায় মা আমার দশ বছর বয়স থেকেই দেখছেন। এতদিনের অ্যাসোসিয়েশন তো তাই মায়ের পছন্দ অপছন্দগুলো খানিকটা আমি জানি। অচেনা বউ হয়ে আসা মেয়েদের মতো অনুভূতিটা আমার ছিল না। আমি যে এত সহজে বলতে পারি এটা আমারও বাড়ি, এখানে এই বাড়ির মা-বাবার কৃতিত্ব অনেক বেশি। '
ছোট বৌ সৌরিতার কথায় 'একটা বাড়িতে একসঙ্গে থাকলে খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে রাগ-অভিমান হয়েই থাকে। মা বলেন 'বাবু একটু অভিমান হয়েছে, দু'জনে মিলে পরে ঠিক করে নেব। তোর কথায় আমি কষ্ট পেলে সেটা বলে দেব এবং আমার কথায় তুই। দু'জন মিলে আদর করে নিয়ে সেটা আবার ঠিক করে নেব। কেউ কোন বিদ্বেষ ধরে থাকব না। ধরে থাকলেই কোনও একটা জায়গা থেকে ভাঙনটা শুরু হতে থাকে। চারিদিকে দেখি সবাই শ্বশুর শাশুড়ি, জায়েরা আলাদা বাড়িতে থাকে। কিন্তু ঐ নিজেদের মতো বাঁচতে আমাদের ইচ্ছে করেনি। এরকম একটা খ্যাতনামা পরিবারে থেকে কখনও মনে হয়নি নিজের নাচটা ছেড়ে,এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান উদয়ন কলাকেন্দ্রকে ছেড়ে অন্য কিছু করব। নাচ ভালবাসি এবং নাচটা নিয়েই ভাল ভাবে কাজ করে যেতে চাই । তাছাড়া একটা মন্টেসরি হাউজে নাচ শেখাই ছোট বাচ্চাদের- সেটাও এই মা-র জন্যে।
আমাদের এই পরিবারে আলাদা করে কোনো চাপ নেই ,তুমি যেভাবে কাজ করে খুশি থাকতে চাও ,সেইভাবে থাকতে পারো। মা ও বাবা সবসময় সেই স্বাধীনতা দিয়েছেন আমাদের দুই বউ মাকে।
নাচের গ্রুপের সবাইকেও মা বলেন, 'তোরা সবাই একসঙ্গে থাকলে পৃথিবী কাঁপাবি।'
শঙ্কর ঘোষ পরিবারে শাশুড়ি-বৌমাদের সম্পর্কে 'সাত পাকে বাঁধা'র সেই সংলাপ 'বৌমা রাগটাকে বাসি হতে দিও না' বারবার ধ্বনিত হয়ে উঠল উদয়ন তীর্থে।