মিঠুন এক নকশাল নেতা মানিক মণ্ডলের চরিত্রে। মিঠুনের নিজের জীবনের ছায়া ছিল মানিক চরিত্রে।
বামপন্থী নেতা যখন মিঠুন দেবশ্রীর পরিচালক
শেষ আপডেট: 13 May 2025 15:37
বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত হলেন। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। কমরেড নেতা নেপালদেব রাজনীতির আঙিনা বাদেও টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও যুক্ত হয়েছিলেন। ২৫ বছর পর, রাজনৈতিক সত্ত্বার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক নেপালদেব ভট্টাচার্য। বামপন্থী নেতার প্রয়াণে ফিরে দেখা যাক তাঁর পরিচালক সত্ত্বা।
ভাটপাড়ায় বাড়ি ছিল নেপালদেবের। প্রমোদ দাশগুপ্তর স্নেহধন্য ছিলেন নেপাল। ছাত্রদের সবথেকে প্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। উত্তর ২৪ পরগনার জনপ্রিয় নেতা নেপালদেব এসএফআইয়ের ইতিহাসে অন্যতম সফল সাধারণ সম্পাদক, যিনি গোটা দেশে ঘুরে ঘুরে সংগঠন বিস্তারে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮১-৮৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন নেপালদেব। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে দলবিরোধী কাজের অভিযোগে নেপালদেবকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। তবে বামমনস্ক নেপালদেব অন্য কোনও দলে যাননি। ২০০৩ সালে ফের তাঁকে সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয় সিপিএম। পরবর্তী সময়ে দলের রাজ্য কমিটির সদস্যও হয়েছিলেন তিনি।
সিপিএম দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার সময় কালে নেপালদেব মন দেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। বহুদিনের স্বপ্নপূরণ করতেই টালিগঞ্জ পাড়ায় চলে আসেন তিনি। ছবি বানাতে এসে দুই তারকাকে নির্বাচন করেন নেপালদেব। মিঠুন চক্রবর্তী আর দেবশ্রী রায়ের জুটিকে নিয়ে 'চাকা' ছবি পরিচালনা করেন এই বামপন্থী নেতা।
মিঠুন এক নকশাল নেতা মানিক মণ্ডলের চরিত্রে। মিঠুনের নিজের জীবনের ছায়া ছিল মানিক চরিত্রে। মানিক বর্তমানে শ্রমিকের কাজ করে। যৌবনে মানিক ভালবেসেছিল ঝুমুরকে (রাজশ্রী ভৌমিক)। ঝুমুরদের পরিবার মানিকের টাকার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঝুমুর ভালবাসে অন্য এক পুরুষকে। মানিককে ছেড়ে ঝুমুর চলে যায়। ভেঙে পড়া মানিক নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় নেয় মনের দুঃখে। সেখানেই পতিতা টগরের (দেবশ্রী রায়) সঙ্গে মানিকের দেখা হয়। নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার ঘরে টগরের শরীর নয়, মন পড়তে পেরেছিল মানিক। তাই পতিতা পল্লী থেকে বার করে নিয়ে গিয়ে টগরকে স্ত্রীর সম্মান দেয় মানিক। কিন্তু টগরের সংগ্রাম শেষ হয় না বিয়ের পরেও। ছাঁটাই হওয়া মানিক আর অসুস্থ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ নেয় টগর। সুজাত বাবুর (সতীনাথ মুখোপাধ্যায়) বাড়ি কাজ করতে গিয়ে টগর পায় জীবনে সুপরামর্শ দেবার মতো মানুষ। মানিক আর টগরের স্ট্রাগলের জীবন কাহিনি নিয়েই নেপালদেব বানান ছবিটি।
সালটা ২০০০। মিঠুন চক্রবর্তী এই ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। অ্যাকশন হিরোর ইমেজ ছেড়ে এক নিম্নবিত্ত মধ্যবয়স্ক পুরুষের চরিত্রে মিঠুনের অভিনয় বড় বাস্তব। ২০০১ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন মিঠুন।
দেবশ্রীর চরিত্রে দু রকম ঘরানা। বেশ্যার ছলাকলা থেকে ঘরের বউয়ের লড়াই। মিঠুন-দেবশ্রীর রসায়ন ডিগ্ল্যামারাইজড রোলে দারুণ ফুটিয়েছিলেন নেপালদেব। এছাড়াও ছবিতে কেতকী দত্ত, অলকা গাঙ্গুলি, পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়, বাসন্তী দাস, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনেতারা অভিনয় করেন।
'চাকা' ছবিতে সমাজের প্রান্তিক চরিত্রগুলোকে রক্ত মাংসের করে তোলেন নেপালদেব। যৌনপল্লীর কার্তিক পুজোতে পতিতাদের নাচগানের দৃশ্য বেশ জনপ্রিয় হয় সেসময়। কেতকী দত্ত নিজের গলায় গান গেয়েছিলেন মাসীর চরিত্রে 'যখন ছিল কাঁচা বয়স, খেতাম ক্ষীরের মিষ্টি পায়েস, এখন আমি মোটে কুড়ি, চিবোই শুধু শুকনো মুড়ি'। বেশ্যাপল্লীতে যে কার্তিক পুজো হয় ভাল 'বাবু' পেতে, তা 'চাকা' বাংলা ছবিতে প্রথম দেখান নেপালদেব। 'ও সাধের নাগর রে তুই খাইতে চাইলি পান' গানটি জমেছিল বেশ। রবীন্দ্রনাথের গানের আভিজাত্য ছেড়ে ইন্দ্রাণী সেন দেবশ্রী রায়ের লিপে গাইলেন পতিতার গান 'আমি হলাম তোমারই'। স্বাগত দের কন্ঠে 'রাজকন্যা রে' মাঝিদের গানটি সবথেকে মন কেড়েছিল। নচিকেতা গেয়েছিলেন 'দুলছে মাটি' ও 'হাতের মুঠোয় যদি থাকত আকাশ' দুটি গান। কল্যান সেন বরাটের সঙ্গীত পরিচালনায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় বাংলার নানা প্রান্তিক মানুষের গান এ ছবিতে পাওয়া যায়।
তবে দুঃখের বিষয় নেপালদেব ভট্টাচার্যর 'চাকা' একেবারেই সাফল্য পায়নি ২০০০ সালে। ছবিটি প্রথম টিভি প্রিমিয়ার হয়েছিল তৎকালীন আলফা বাংলা চ্যানেলে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দুপুরে। পরে ছবিটি হল-রিলিজ করলেও সাফল্য পায়নি। প্রথম পরিচালনা হিসেবে নেপালদেব কিন্তু যথেষ্ট উন্নতমানের ছবি বানিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য ছিল নিখুঁত। কিন্তু প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের দুঃখ কষ্টের গল্প দর্শক আর কতই বা টিকিট কেটে দেখে। মিঠুন-দেবশ্রীর কেরিয়ারে স্মরণীয় ছবি হয়ে রয়েছে 'চাকা'।
বড় তারকা নিয়েও প্রথম ছবি ফ্লপ করাতে আর কখনও ছবির জগতে ফিরে যাননি নেপালদেব। রাজনীতিতেও পরবর্তীকালে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে হিট ফ্লপ বিচার করে তো মননশীল ছবির মান বিচার হয় না!
একেবারে স্বচ্ছ, রসিক, স্পষ্ট মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে নেপালদেব ভট্টাচার্য ইতিহাসে রয়ে যাবেন।
কমরেড নেপালদেব ভট্টাচার্য লাল সেলাম ...