'বেলা শেষে'র বড় মেয়ে 'বুড়ি' আমি হতে চাইনি, রাজি করায় শিবু, তারপর তো ইতিহাস
অপরাজিতা শিবপ্রসাদ
শেষ আপডেট: 20 May 2025 15:57
বাংলা ছবিতে রুচি, বাঙালিয়ানা আর নির্মল আনন্দের সম্ভার এনেছেন যাঁরা, তাঁরা পরিচালক জুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। শহরে এখনও রমরমিয়ে চলছে তাঁদের নতুন ছবি 'আমার বস'। বিগত বছরগুলিতে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার বেশিরভাগ ছবিতে উল্লেখযোগ্য মুখ ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য। আজ শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে নানা কাজের সোনালি অভিজ্ঞতা দ্য ওয়াল-এ ভাগ করে নিলেন অপরাজিতা আঢ্য।
রাত ১২টা বাজতেই অপরাজিতা শিবপ্রসাদকে মেসেজে লিখেছেন 'তোর সৃষ্টি যেন মানুষের মনকে অন্য ভাবে নাড়া দেয়, তুই যেন সারাজীবন বাঙালির অস্তিত্বে বিরাজমান থাকিস। '
আজ 'দ্য ওয়াল'-কে অপরাজিতা আঢ্য বললেন একদম শুরুর দিককার কথা। 'শিবুকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৬ সালে। তখন ইটিভি বাংলার জনপ্রিয় 'সিংহবাহিনী' সিরিয়ালে শিবু ছিল হিরো আর আমি ছিলাম হিরোইন। আমাদের দু'জনেরই প্রথম জীবনের গল্প। আমাদের চরিত্র দুটো ছিল একদম স্বপ্নের জগতে বাস করা। শিবু যেন উত্তমকুমার আর আমি সুচিত্রা সেন। সেসময় 'সিংহবাহিনী' কিন্তু দারুণ জনপ্রিয় হয়। যাঁরা দেখেছেন নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন। তার পরবর্তীকালে শিবু আর আমি একটা টেলিফিল্ম করেছিলাম শেখর দাসের। এরপর ইটিভি ছেড়ে শিবু যখন নন্দিতাদি ও ওঁর স্বামী নীতীশ রায়ের হাউজে জয়েন করল তখন ওঁদের সঙ্গে একটা জনপ্রিয় গেম শো 'টাকা না সোনা' করতাম। তারা বাংলায় 'টাকা না সোনা' নন ফিকশন আমি সঞ্চালনা করেছি বহুদিন। তারপর আর মাঝে কখনও শিবুর সঙ্গে কাজ হয়নি। একেবারে 'বেলা শেষে'। এরপর তো পরপর শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায়ের ছবিতে কাজ করেছি 'প্রাক্তন', 'বেলা শুরু', 'হামি'। ওঁদের উইন্ডোজ প্রোডাকশনের 'মুখার্জিদার বউ', 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি', 'রসগোল্লা' তেও অভিনয় করেছি। আমার সব কটা চরিত্রই কিন্তু মানুষের মনে দাগ কেটে গেছে। সবটাই শিবু আর নন্দিতাদির কৃতিত্ব।'
এই মে মাসেই 'বেলা শেষে' ছবির দশ বছর পূর্ণ হল। ২০১৫ এর পয়লা মে রিলিজ করেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর ঐতিহাসিক এই ছবি। বড় মেয়ে বুড়ির চরিত্র দেখে প্রতিটি বাড়ির গৃহবধূ নিজের সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। অথচ 'বুড়ি' চরিত্রটি অপরাজিতা প্রথম প্রস্তাবে করতেই চাননি। ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শিবপ্রসাদকে। কারণ সময়ের অভাব।
অপরাজিতা দ্য ওয়ালকে বললেন ' বেলা শেষে'তে যখন আমাকে ডেকেছিল শিবু, আমি বলেছিলাম ছবিটা করব না। কারণ তখন দুটো বড় সিরিয়াল করছিলাম,'জল নূপুর' আর 'মা'। সময় দিতেই পারব না আর এমন দুটো জনপ্রিয় সিরিয়াল ছেড়ে ছবি করার আমার খুব একটা ইচ্ছে নেই। শিবু বলেছিল 'তুই কি পাগল নাকি? তোকে করতেই হবে!' সে জোর জবরদস্তি করে শিবু আমায় 'বেলা শুরু'তে অভিনয় করায়। তারপর তো বেলা শেষে'র 'বুড়ি' ইতিহাস। বুড়ি হচ্ছে খুব সুখী পরিবারের বউ। ওর সংসার, ঘরদোর, গোপাল, বর, ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব আনন্দে থাকে। অত্যন্ত সরল। ওদের মধ্যে কোনও জিলিপির প্যাঁচ নেই। মা-বাবার যে ডিভোর্স হয়ে যাবে সেটা বুড়ির কাছে যেমন লজ্জার, তেমন ব্যথার। সবাই একটা করে পয়েন্ট নিয়েছে কিন্তু বুড়ি খুব সহানুভূতিশীল। সবাই বাবার ভুল ধরছে কিন্তু বুড়ি ভাবছে আহা রে বাবা-মায়ের খুব কষ্ট। এমন লজ্জার ঘটনা নিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কাছে কীভাবে সম্মুখীন হবে সেটাও সে ভাবছে। বুড়ি সবথেকে ঘরোয়া, যার মানসিকতা হল সংসারে থাকতে গেলে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। বাবা যেমন অন্য দুই মেয়েকে সাহসী তৈরি করেছেন কিন্তু বড় মেয়েকে মা খুব ঘরোয়া তৈরি করেছেন। বুড়ির কাছে জীবনের আর এক নাম অ্যাডজাস্টমেন্ট।'
অপরাজিতার কেরিয়ারে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছবি 'প্রাক্তন'। শিবপ্রসাদ অপরাজিতাকে কাস্ট করলেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির মাঝখানে?
অপরাজিতা বলছেন ' শিবু আমাকে বলেছিল অপরাজিতা তোর রোলটা কিন্তু পুরোটাই ট্রেনে বসে। খুব স্বল্প জায়গার ভিতর অনেকক্ষণের শ্যুট বলে তোকে কিন্তু রোগা হতে হবে! আর তোকে সালোয়ার-কামিজ পরতে হবে। তাই ৫ কেজি ওজন কমিয়ে রোগা হতে হবে তোকে! নইলে ঋতুপর্ণার পাশে বেমানান লাগবে!' কিন্তু তার আগে পুজো ছিল, আমি এত খাওয়া-দাওয়া করেছি রোগা হতে পারিনি। শিবু যখন দেখল আমার দ্বারা রোগা হওয়া হল না তখন শিবু বলল, ঠিক আছে চল কিছু হবে না। তোর অভিনয়টাই আসল। তারপর 'মলি'তো সব্বার মন জয় করেছিল।'
শিবপ্রসাদের ছবিতেই প্রথম প্রসেনজিতের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করার সৌভাগ্য হয় অপরাজিতা আঢ্যর। এক গাল হেসে অপরাজিতা বলছেন
'ছোটবেলা থেকে আমি দুই হিরোর ফ্যান। আমির খান আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। দু'জনকে নিয়েই আমি স্বপ্ন দেখতাম। বাপের বাড়িতে সারা ঘরে আমার আমির খান আর বুম্বাদার ছবি ছিল।
তুমি যেটা স্বপ্ন দেখো সেটা যদি সত্যি হয় জীবনে, তাহলে সেটা পরম পাওয়া। বুম্বাদার বুকে মাথা রেখে আমার দৃশ্যটা সত্যি বড় প্রাপ্তি। আমাকে যে শিবু ভেবেছিল সেটা পরিচালক হিসেবে ওঁর দূরদর্শিতা। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম যখন কাজ করতে শুরু করি তখন খুব রোগা ছিলাম। তারপর মোটা হয়ে যাই। আমি কোনও দিন তথাকথিত নায়িকা হতে চাইনি। কে আমাকে কী করল, তার থেকেও বড় কথা আমি কী হতে চেয়েছি! আমি একজন ভাল অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম এবং সেটা যে আমি হতে পেরেছি সেটাই আমার সৌভাগ্য।
কিছুদিন আগে শিবুর সঙ্গে 'বোরপ্লাস'-এর বিজ্ঞাপন করলাম। শিবুর যখন যাকে প্রয়োজন হবে তখন তাকে ঠিক ডেকে নেবে। এটাই শিবুর প্লাস পয়েন্ট।'