এলআইসি হাউজিং ফিনান্সের এমডি ও সিইও ত্রিভুবন অধিকারী।
শেষ আপডেট: 12th June 2024 21:00
নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে যদি আপনি একেবারে আনকোরা কেউ হ'ন, নানা প্রশ্ন মাথায় গিজগিজ করতে থাকে। প্রথমবার এত বড় অঙ্কের টাকা ঋণ করতে হবে, কোথায় করবেন, কী কী বিষয় মাথায় রাখবেন, সবই ভাবতে হয়। আবার আপনি যে সংস্থা থেকে ঋণ নেবেন, তাদেরও খুঁটিয়ে দেখতে হয়, সম্ভাব্য গ্রাহক ঠিক কেমন হতে চলেছেন। বাড়ি-বাজারে ঋণ নেওয়ার সাত-সতেরো নিয়ে এবার দ্য ওয়ালের মুখোমুখি হলেন দেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ গৃহঋণদাতা সংস্থা এলআইসি হাউজিং ফিনান্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ত্রিভুবন অধিকারী।
এলআইসি হাউজিং ফিনান্স বা যে কোনও সংস্থায় লোনের জন্য আবেদন করতে গেলে প্রথমেই একটা ইচ্ছেপত্র বা 'এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট' জমা করতে হয়। মধ্য কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে সংস্থার আঞ্চলিক প্রধানদের নিয়ে বৈঠকের শেষে দ্য ওয়ালকে ত্রিভুবন বললেন, 'আমাদের সংস্থার ক্ষেত্রে কেউ আমাদের ওয়েবসাইটে যেতে পারেন, আমাদের অ্যাপ আছে 'হোমি' ('HOMY'), সেটিও ডাউনলোড করে আবেদন করতে পারেন। সেখানে আমরা কিছু প্রশ্ন করব, যেমন আপনার প্যান নম্বর, গত দুই-তিন বছরের আয়ের হিসেব, আপনার কর্মক্ষেত্রের বিবরণ ইত্যাদি। এতে করে আমরা জানতে পারি, কতটা ঋণ তাঁকে আমরা দিতে পারব। তারপরের ধাপে যেটা আমরা করি, তাকে বলা হয় 'প্রি লোন অফার'। প্যান নম্বরের ভিত্তিতে আমরা তাঁর সিবিল স্কোর (CIBIL Score) দেখে নিতে পারি। তখনই আমরা বুঝে যাই যে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী ঋণ দেওয়ার উপযুক্ত কিনা।'
কতটা গুরুত্বপূর্ণ সিবিল স্কোর? ত্রিভুবন বলেন, 'ভীষণ জরুরি। ওটার ভিত্তিতেই আমরা দেখে নিই, একজন ঋণগ্রহীতা কতটা ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত।' সিবিল বা ক্রেডিট ইনফর্মেশন ব্যুরো লিমিটেড হল দেশের চারটি শীর্ষ ক্রেডিট তথ্যসংস্থার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তম। বাকি তিন সংস্থা হল এক্সপেরিয়ান, ইকুইফ্যাক্স ও হাইমার্ক। কিন্তু তাদের চাইতে 'সিবিল'-এর ক্রেডিট স্কোরই সর্বাধিক মান্যতম। সিবিল স্কোর আদতে তিন সংখ্যার একটি মান, যেটি ৩০০ ও ৯০০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। কোনও গ্রাহকের জমা বা আমানতের খতিয়ান, হিসেব ও রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এই স্কোর ধার্য করা হয়। যত বেশি এটা ৯০০-এর কাছাকাছি হবে, ব্যাঙ্ক তত বেশি সেই গ্রাহককে ঋণ দিতে চাইবে।
ত্রিভুবন বললেন, 'মোটামুটি ৭০০ বা তার বেশি সিবিল স্কোর হলে আমরা ধরে নিই, এই গ্রাহক মোটের ওপর ভরসাযোগ্য। তিনি জানেন, কীভাবে তিনি তাঁর খরচ-খরচা চালাবেন। তিনি যা ঋণ নেন, সময়মত শোধ করে দিতে পারেন। ৭০০-এর কম হলেই বুঝতে হবে, তার কিছু সমস্যা আছে। ঋণ নেয়, কিন্তু সময়ে সুদ দেয় না, বা এরকম কিছু। তাঁদের নিয়ে আমরা একটু চিন্তায় থাকি।' প্রসঙ্গত, সিবিল স্কোর ৬৫০ বা তার নিচে নেমে গেলেই কিন্তু ফ্যাসাদে পড়তে হতে পারে।
তবে তার মানে যে তিনি ঋণ পাবেন না এমন নয়। এলআইসি হাউজিং ফিনান্সের শীর্ষতম কর্তা আশ্বস্ত করলেন, ঋণ তাঁরা সকলকেই দেন। 'কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, তিনি গ্রাহক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ কিনা। দেখুন, আমাদের এগুলো দেখে নিতে হয়। ঝুঁকির জায়গাটা যেন খুব বেশি না থাকে, পরে যাতে সমস্যা না হয় ইত্যাদি।'
গৃহঋণের ক্ষেত্রে সাধারণত এই মুহূর্তে ভারতের বাজারে একাধিক নামী সংস্থা রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় জীবনবীমা সংস্থা বা 'লাইফ ইনশিওরেন্স কর্পোরেশন' গ্রাহক-সংখ্যার বিচারে অন্যতম শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। এলআইসি হাউজিং ফিনান্স তাহলে কোথায় আলাদা? ত্রিভুবন বললেন, 'দেখুন, এখন সত্যিই বহু সংস্থা রয়েছে বাজারে। অনেক ব্যাঙ্কও এই নিয়ে গ্রাহকদের লোভনীয় অফার দিচ্ছে। আমাদের প্রথম সুবিধেটা হচ্ছে, আমরা একেবারে 'এক্সক্লুসিভলি' গৃহঋণ সংস্থা। আমাদের আর কোনও ক্ষেত্রে ঋণ দিতে হয় না। আমরা এই পরিষেবায় ৩৪ বছর ধরে রয়েছি। দ্বিতীয়ত, একটা কথা মনে রাখতে হবে, শুধু বাড়ি কিনলেই হল না, আমরা যাতে গুরুত্ব দিই, সেটা হল 'অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং'। আমরা একটাই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, আমাদের সুদের হার কিন্তু বাকিদের চাইতে একেবারেই পিছিয়ে নেই। তৃতীয়ত, আমাদের কারবার একশো দশ ভাগ স্বচ্ছ। আমরা যা প্রতিশ্রুতি দিই, একেবারে সেটাই করি। আমরা যদি বলি, আমরা ২.৫ শতাংশ প্রসেসিং ফি নেব, আমরা ওই পরিমাণই নেব। এটাই আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার সবচেয়ে বড় কারণ।'
এলআইসি ব্র্যান্ড হিসেবেও গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে এলআইসি কিন্তু ওপর থেকে কোনও হস্তক্ষেপ করে না। আমরা যে এলআইসির থেকে গ্রাহক নিই বা এলআইসি তাঁদের গ্রাহকের তথ্যভাণ্ডার আমাদের দেয়, বা এলআইসি এজেন্টরা আমাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে, এমন কিন্তু একেবারেই নয়। এটাকে বাণিজ্যের ভাষায় বলে 'আরপিটি' বা 'রিলেটেড পার্টি ট্রানজ্যাকশন'। সেবি এই নিয়ে ভীষণ কড়া। মানে ধরুন, যদি এলআইসি তাঁদের গ্রাহকদের আমাদের কাছে পাঠায়, সেবি এটাকে অনধিকার প্রবেশ বলে ধরে নেবে। প্রশ্ন উঠবে গ্রাহকের গোপনীয়তা নিয়ে। আমরা আমাদের মত করে প্রচার করতে পারি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
মধ্যবিত্ত বাঙালির ঋণের ক্ষেত্রে ত্রিভুবনের পরামর্শ আরও বেশি গুরুত্ব পেতে পারে, কারণ এলআইসি হাউজিং ফিনান্সের গ্রাহকরা বেশিরভাগ কিন্তু উচ্চ আয়ের গ্রাহক নন। 'আমাদের গ্রাহকরা বেশিরভাগই মধ্য আয়ের বৃত্ত থেকে, খানিকটা নিম্ন আয়ের বৃত্ত থেকেও আছে।' এইখানেই একটা জরুরি জায়গা নিচ্ছে সুদের ধরণ। সাধারণত গৃহঋণের ক্ষেত্রে দুই ধরণের সুদ হয়। এক, 'ফিক্সড ইন্টারেস্ট রেট', যেখানে সুদের হার একই থাকে। দুই, 'ভ্যারিয়েবল ইন্টারেস্ট রেট', যেখানে সুদের হার বাজারের চাহিদা অনুসারে পালটায়।
প্রথম বার যিনি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য গৃহঋণ নেবেন, যার আয় মোটামুটি মধ্যবিত্তের, তাঁর কোন ধরণের সুদ নেওয়া উচিত? ত্রিভুবন বললেন, 'দেখুন, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, সুদের হার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আছে। মানে, এর বেশি হওয়া হয়ত সম্ভব নয়। সেপ্টেম্বর বা ডিসেম্বর থেকেই হয়ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমানো শুরু করতে পারে। তো, যদি সেই সুদের হার কমে যায়, আপনার ঋণের বোঝাও কমে আসবে। 'ফিক্সড' বা স্থায়ী সুদের হার তখনই নেওয়া উচিত, যখন গ্রাহক বাজারের হাল-হকিকত খুব ভাল বুঝবেন। যদি ধরা যাক সুদের হার কমে সাতের ঘরে চলে এল, তখন হয়ত তিনি ভাববেন, এর চেয়ে কম হওয়া সম্ভব নয়, সেই বুঝে উনি ঋণ নেবেন। কিন্তু এটা সব সময়েই ঝুঁকির। আপনি কী করে বুঝবেন, বাজারের মতিগতি কোনদিকে যাবে? তো, আমি সবসময় গ্রাহককে বলব, ভ্যারিয়েবল বা পরিবর্তনশীল রেটের দিকেই যান। বাজার যেমন চলবে, সেই মত আপনার সুদের হারও কমবে-বাড়বে। হয়ত হার একটু বাড়লে চিন্তায় পড়তে হবে। কিন্তু কমে গেলে আবার সুবিধেও পাবেন।'
কিন্তু তাতে ঝুঁকিটাও বেশি থাকছে না? বিশেষ করে বাজারের মতিগতি তো সত্যিই বোঝা দুষ্কর। 'সেইজন্যই তো পরিবর্তনশীল হারে সুদ নেওয়া উচিত। একজন সাধারণ মানুষ কী করে বুঝবেন, সুদের হার কখন সবচেয়ে কম থাকবে? আমাদের পক্ষেও তো এটা বোঝা সম্ভব হয় না সবসময়। তাই আমি সব সময় ভ্যারিয়েবল হারে নেওয়ার কথাই বলব', বললেন ত্রিভুবন। সঙ্গে যোগ করেন, 'আমাদের গ্রাহকদের কথা যদি ধরি, ৯৬ শতাংশ কিন্তু ভ্যারিয়েবল হারেই কিন্তু ঋণ নেন।'
এখন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন। তারপর সেখানেই চাকরিবাকরি করে থিতু হয়ে হয়ত কলকাতায় পরিবার বা বাবা-মায়ের জন্য বাড়ি কেনার কথা ভাবেন। সেক্ষেত্রে অনাবাসী ভারতীয় বা এনআরআই (নন-রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান)-দের জন্য কীরকম কী ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে? ত্রিভুবন আশ্বস্ত করেন, তাঁদের কাছে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য নিয়ম কিছু আলাদা নয়। এমনিতে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য অন্যান্য নানা সংস্থায় সুদের হার সামান্য বেশি রাখা হয়। কিন্তু এলআইসি হাউজিং ফিনান্সের সুদের হার তাঁদের জন্য একই। 'আমরা মনে করি অনাবাসী ভারতীয়রাও একইরকম বিশ্বাসযোগ্য গ্রাহক। তাই আমাদের কাছে তাঁদের জন্য সুদ কিছু আলাদাও নয়।'
পশ্চিমবঙ্গ বা বিশেষ করে পূর্ব-ভারতে রিয়েল এস্টেট বাজারে যা অগ্রগতি এসেছে, তাতে ব্যবসায়িক দিক থেকে পূর্ব ভারত বা কলকাতা দেশের বাকি বড় শহরগুলো থেকে কতখানি এগিয়ে? 'দেখুন, তথ্য অনুসারে দেখলে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই বা গুড়গাঁও হয়ত খানিকটা এগিয়েই আছে। এটা যে শুধু চাহিদার দিক থেকে নয়, যোগানের দিক থেকেও। বিরাট বড় মাপের নির্মাণ সংস্থাগুলো সেখানে কাজ করে চলেছে। তবে কলকাতা কিন্তু খুব বেশি পিছিয়ে নেই। হয়ত তুলনা করলে পিছিয়ে আছে, কিন্তু অগ্রগতির হার খুবই ভাল। কলকাতার আশেপাশে হাওড়া বা বারাসাতেও রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা খুবই ভাল চলছে। আমাদের এই মুহূর্তে লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে ব্যবসা বাড়ানো। পাশাপাশি, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাকি রাজ্যেও পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। ত্রিপুরা যেমন এই তালিকায় খুবই ওপরে।'
এই মুহূর্তে চারদিকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় হল পরিবেশ। যেভাবে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন এসে থাবা বসাচ্ছে, লাগামছাড়া গরমে নাজেহাল হয়ে উঠছেন শহরবাসী, তাতে অনেকেই লাগামছাড়া উন্নয়নের নামে রিয়েল এস্টেটের বাড়বাড়ন্ত ও পরিবেশ ধ্বংসকে দায়ী করছেন। সরাসরি প্রশ্ন করা গেল, দেশের সবচেয়ে বড় গৃহঋণদাতা সংস্থার প্রধান হিসেবে পরিবেশের জন্য কী বার্তা দেবেন? ত্রিভুবন বললেন, 'দেখুন, 'রেরা' (রিয়েল এস্টেট রেগুলেটরি অথরিটি) তৈরির পর থেকে আবাসন শিল্পকে অত্যন্ত কড়াভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। যে কোনও প্রকল্প শুরু করার আগে 'রেরা'-র ছাড়পত্র নিতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল পরিবেশ বিষয়ক ছাড়পত্র।' কিন্তু সেটা কি কেবল নাম-কা-ওয়াস্তে? নাকি গুরুত্ব আছে? 'ভীষণ গুরুত্ব আছে। ওটা না থাকলে কোনও হাউজিং ফিনান্স সংস্থাই আপনাকে ঋণ দেবে না। আমরা সেটা নিয়ে সচেতন ও অত্যন্ত কড়া। ওই ছাড়পত্র 'রেরা' ওয়েবসাইটে আপলোড না হলে আমরা কোনও ঋণে 'স্যাংশন' করি না। পাশাপাশি, আমরা 'গ্রিন হাউজিং' নিয়ে প্রচার করার চেষ্টা করি। যেমন কেউ হয়ত সোলার হিটার লাগালেন ছাতে। এখনই হয়ত সেটা খুব বেশি হয় না। কিন্তু আশা করছি আস্তে আস্তে এগুলো বাড়বে। আমরা এই মুহূর্তে 'গ্রিন ডিপোজিট ফান্ড' বলে একটি নতুন প্রকল্প চালুর কথাও ভাবছি। খুবই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে, আগের মাসেই কার্যকরী সভার ভোটে অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ঠিক করেছি, এই তহবিলের টাকা শুধুমাত্র 'গ্রিন' বা পরিবেশবান্ধব প্রকল্পেই বিনিয়োগ করা হবে।'
এই গ্রিন ডিপোজিট বা পরিবেশবান্ধব ডিপোজিট আসলে কী? ত্রিভুবন ব্যাখ্যা করলেন, 'এটা স্বাভাবিক তহবিলের মতোই। কিন্তু আমরা এই তহবিলের টাকা শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের পিছনেই ব্যবহার করব।'