ব্রিটানিয়া বিস্কুটের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম।
শেষ আপডেট: 24th June 2024 16:51
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সেই নয়ের দশকে কবীর সুমন গেয়েছিলেন, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই! বাঙালির অবশ্য এক কাপ চা হলেই হয় না। কথাতেই আছে, চা-টা। ওই টা বস্তুটি অতি জরুরি। অর্থাৎ, দুটো বিস্কুট। মেরি হোক বা লেড়ো, মিষ্টি কাজু দেওয়া হোক বা চিনি ছাড়া মুচমুচে। বাঙালির বিস্কুট চাই-ই চাই। এই বিস্কুটের দুনিয়াতে একমেবাদ্বিতীয়ম যে নামটি কার্যত এক কাপ চায়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, সেটি অবশ্যই ব্রিটানিয়া। যার শুরুটা হয়েছিল কলকাতায়, মাত্র ২৯৫ টাকা পুঁজি নিয়ে।
আজ কলকাতার তারাতলায় ব্রিটানিয়ার সত্তর বছরেরও বেশি পুরনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। সংবাদসংস্থা পিটিআই সূত্রে খবর, কর্মীদের সকলকেই স্বেচ্ছাবসর বা ভিআরএস নিতে রাজি করিয়েছে সংস্থা। কিন্তু বিস্কুটপ্রেমীদের আক্ষেপ, শুধু তো কারখানা নয়, একটা ইতিহাস যেন ঝাঁপ ফেলে দিল আজ। যে ব্র্যান্ডের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শহর কলকাতার পরিচিতি।
এই ব্র্যান্ডেরও হাতেখড়ি সাহেবদের হাতে। ১৮৯২ সাল। জাতীয় কংগ্রেসে তখনও নরমপন্থীদের রাজত্ব। এলাহাবাদে সে বছরের কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ রবীন্দ্রনাথ তখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহে যাতায়াত শুরু করেছেন। হিতবাদী-সাধনা পর্বে সেই সময়ে তাঁর কলম থেকে বেরোচ্ছে অবিস্মরণীয় নানা ছোটগল্প, চিত্রাঙ্গদার মত নাট্যকাব্য। সেইরকম সময় একদল ব্রিটিশ ছোট ব্যবসায়ী কলকাতায় স্থাপন করলেন একটি বিস্কুটের কারখানা। খুব বেশি বড় নয়। ট্যাঁকের জোর মাত্র ২৯৫ টাকা। সেকালে যদিও তার দামই ছিল বেশ ভাল। তবে বেশ নাম করেছিল সেসব বিস্কুট। পরে কলকাতার কিছু দেশীয় উদ্যোগপতিও তাতে বিনিয়োগ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সংস্থাটিতে সি এইচ হোমস নামক এক ব্রিটিশ উদ্যোগপতি অংশীদারিত্ব কেনেন। প্রিয় মাতৃভূমি ব্রিটেনের রোমান সাম্রাজ্যের আমলের নাম থেকেই নাম রাখেন 'ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি।'
কিন্তু বিশ শতকের প্রথম দিকের বাকি সব কিছুর মত, ব্রিটানিয়ার কপালও পাল্টে যায় তার কুড়ি বছর পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে।
১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ইউরোপের পূর্ব রণাঙ্গনে শুরু হয় ধুন্ধুমার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যাতে জড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে জার্মানি ও ফ্যাসিবাদী ইতালির সঙ্গে এশিয়াতে যুদ্ধের রাশ ধরে জাপান। প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে শুরু হয় জলে-স্থলে লড়াই। কার্যত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে একাধিক ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশে আঘাত হানতে শুরু করে জাপানের বোমারু বিমান ও যুদ্ধজাহাজ।
এশিয়ায় তখন ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ভারতবর্ষ। রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলেও, তখনও ব্রিটিশ রাজশক্তির অন্যতম শক্তি তাদের পুরনো শহর কলকাতা। ফলে হুগলি নদীর তীরে, পুব ভারতের সবচেয়ে বড় নদী-বন্দর তথা বড় শহর হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়ায় মিত্রশক্তির শেষ ঘাঁটি। এক বিরাট সংখ্যক ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় কলকাতায়। দক্ষিণবঙ্গের একাধিক বিমানঘাঁটিকে যুদ্ধবিমানের শিবির হিসেবে গড়ে তোলা হয়। আর এতেই চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে বিস্কুটের চাহিদা।
বরাবরই যুদ্ধের বাজারে শুকনো খাবারের গুরুত্ব বেশি। এককালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লম্বা 'সাপ্লাই লাইন' তৈরি করা থাকত, যাতে শিবির থেকে সরাসরি রণাঙ্গন অবধি খাবার ও রসদ পরিষেবা দেওয়া যায়। কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাতারাতি যুদ্ধের সংজ্ঞাটাই পাল্টে যায়। সেনাবাহিনীকে আকাশপথে নামিয়ে দেওয়া হত বিভিন্ন এলাকায়, তারপর রসদের লাইন তৈরি করা যেত। ততদিন অবধি বাহিনীকে নিজেদের রসদ নিজেদের সঙ্গেই রাখতে হবে। তাছাড়াও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের একাধিক দ্বীপের গরম জলহাওয়ায় খাবারদাবার বেশিদিন টিকিয়ে রাখাও সমস্যার হত। ফলে বিস্কুট ও কেক ছিল অদ্বিতীয়। ব্রিটিশ সেনাদলের জন্য বিস্কুট ও কেকের জোগান দিতে অতএব বাড়তি বরাত দেওয়া হল ব্রিটানিয়াকে। একাধিক জায়গায় 'ফ্যাক্টরি' তৈরি করে আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিস্কুট উৎপাদন শুরু করে ব্রিটানিয়া। আনানো হয় ভাল মানের বিদেশী ওভেন, উন্নত মানের আটা ও ময়দা।
স্বাধীনতার পরে অবিশ্যি ব্রিটানিয়াকে বিস্তর ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। নানাভাবে নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করে সংস্থা। মার্কিন সংস্থা নেবিস্কোর তরফে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়। শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়। অবশেষে ১৯৯৩ সালে মুম্বইয়ের বিখ্যাত ওয়াদিয়া গোষ্ঠীর কর্ণধার নুসলি ওয়াদিয়া ব্রিটানিয়া সংস্থাকে কিনে নেন।
কাপড়ের ব্যবসায় ওয়াদিয়া গোষ্ঠীর সুনাম সর্বজনবিদিত। পাকিস্তানের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলি জিন্নাহের কন্যা ডিনা জিন্নাহ ওয়াদিয়া ও জামাই নেভিল ওয়াদিয়ার পুত্র নুসলি ওয়াদিয়া। ভারতের অন্যতম স্বনামধন্য এই পার্সি পরিবার ভারতবিখ্যাত 'বোম্বে ডাইং' ব্র্যান্ডের মালিক। তার পাশাপাশি সস্তার উড়ান গো ফার্স্ট (আগের গো এয়ার), আইপিএলের ক্রিকেট দল পঞ্জাব কিংসও তাঁদের অধীনে। ব্রিটানিয়ার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ওয়াদিয়া গোষ্ঠী ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করেন। বিস্কুট, কেক, চিজ, দই, পনীর, চকোলেট-সহ নানা বাহারি দ্রব্য উৎপাদন করে ব্রিটানিয়া। কলকাতার তারাতলা থেকেই তৈরি হত ব্রিটানিয়ার নানা আকর্ষক বিস্কুটের প্রোডাক্ট। যার মধ্যে রয়েছে 'টাইগার', 'মেরি', 'মেরি গোল্ড', 'গুড ডে', 'মিল্ক বিকিস', 'ফিফটি ফিফটি', 'বুরবোঁ'।
আপাতত তারাতলার ফ্যাক্টরির ভবিষ্যৎ কী হবে, জানায়নি ব্রিটানিয়া। যে ১১ একর জমিতে ওই বিরাট ফ্যাক্টরি, সেটি আদতে কলকাতা বন্দরের। লিজ নিয়ে তাতে কারখানা চালিয়েছে ব্রিটানিয়া। সেই লিজ যদিও ২০৪৮ সাল পর্যন্ত আছে। কিন্তু সংস্থার অন্দরের যা কানাঘুষো, তাতে জমিটি আবার বন্দর কর্তৃপক্ষ 'কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট'-এর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায় কিনা, সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বিস্কুটের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার খুব একটা আশঙ্কা নেই। কলকাতার পাশাপাশি দিল্লি, মুম্বই, বিহার এবং অসমে ব্রিটানিয়ার কারখানা আছে। বিস্কুটের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঠিক কী কারণে কলকাতার ফ্যাক্টরি বন্ধ হল, সেই নিয়ে কিছু জানায়নি সংস্থা। ভারতের অন্য প্রান্তের কারখানায় লাভজনক ব্যবসা চললেও কলকাতায় কেন লাভ পেল না সংস্থা, সেও একপ্রকার ধোঁয়াশা।