শেষ আপডেট: 24th October 2024 17:28
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটা ছাত্রেরই প্রথম দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গ়ড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লিগের সাথে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে, একটু স্পেসিফিক্যালি বললে, কিছু অতি উৎসাহীর কারণে বার বার এই ছাত্র সংগঠনটির উল্লেখযোগ্য অনেক সফলতা ম্নান হয়েছে যেগুলো হতে পারতো অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা। সবশেষে, প্রশ্নফাঁস রোধে ছাত্র লিগের বর্তমান পদক্ষেপগুলো আবারও আশার সঞ্চার করছে। যেই সংগঠনটির হাত ধরে একটি ভাষা এসেছে, একটি পতাকা এসেছে, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এসেছে, শত ইতিহাস রচিত হয়েছে আবারও সেই সংগঠনটির হাত ধরেই প্রশ্নফাঁসের মতো কালিমা মোচন হবে। অন্যানে আপোষহীন প্রতিবাদে সদা জাগ্রত বাংলাদেশ ছাত্র লিগ।’
কথাগুলি হাসনাত আবদুল্লাহর। যিনি সদ্য বাংলাদেশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, কথাগুলি আজকের নয়। ২০১৮ সালে ২২ অক্টোবর ফেসবুকে লিখেছিলেন আবদুল্লাহ, যখন তিনি ছিলেন মুজিব ও ছাত্র লিগের ভক্ত। আর গত পরশু অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতে সেই তিনি আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে যে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন তার অন্যতম ছিল ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের অন্তর্বর্তী সরকারের উপর এতটাই দাপট যে মহম্মদ ইউনুসের প্রশাসন বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগেই আবদুল্লাহদের দাবি কার্যকর করেছে ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ছয় বছর পর ছাত্র লিগকে নিয়ে হাসনাত আবদুল্লা কেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছেন তার পুরো দায় এই তরুণ নেতার নয়। দায় অবশ্যই ছাত্র লিগ, তাদের অভিভাবক আওয়ামী লিগ এবং সে দলের প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনারও। ক্যাম্পাসের গণ্ডি ছাপিয়ে মূল ধারার রাজনীতিতে পা দেওয়ার আগে হাসিনার দলের ছাত্র লিগ এবং খালেদা জিয়ার পার্টির ছাত্র দলের দলীয় রাজনীতির সব ধরনের নোংরামোয় অভ্যস্থ হয়ে ওঠা নতুন কিছু নয়। বছর কয়েক আগে ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজির ঘটনায় অভিযুক্ত এক ছাত্র লিগ নেতার একশো কোটি টাকার সাম্রাজ্যের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল। গত জুলাই-আগস্ট মাসে হাসিনা বিরোধী আন্দালন মোকাবিলায় ছাত্র লিগ, যুব লিগের গুণ্ডামি, খুন, রাহাজানি, গোপন ছিল না। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্র নেতাদের যৌন নিপীড়নের শিকার ছাত্রীরা প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন তখন।
ছাত্ররা এই সব অপকর্ম করতে পারার দায় আওয়ামী লিগ ও দলনেত্রী শেখ হাসিনা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু স্বঘোষিত বিচারকেরা যদি উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুজে বিচার করেন তাতে বাকিদের অপকর্মগুলি মিথ্যে হয়ে যায় না। বিএনপি-র ছাত্র দল, জামাতের ছাত্র শিবির, এমনকী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয়ে লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট-রাজ, খুন-ধর্ষণের ঘটনা প্রথমসারির মিডিয়ায় তেমন প্রতিফলিত না হলেও সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে আছে নব্য হামলাবাজদের হুঙ্কার আর আক্রান্তের আর্তনাদের ভিডিও’য়। ‘সমন্বয়ক’ শব্দটি সিডর, মোখা, হামুন, মিধিলি, দানা জাতীয় ঘূর্ণিঝড়ের মতো হাড় হিম করা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমদের প্রতিক্রিয়াকেও তা মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে।
তাঁদের কাঁধে বন্দুক রেখেই মহম্মদ ইউনুস নিউ ইয়র্ক সফরে শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভয়েস অফ অ্যামেরিকার সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে খানিক রুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি পুরনো দিনের কথাবার্তা বলছেন। এর মধ্যে একটি গণ–অভ্যুত্থান ঘটে গেছে, এটা বোধ হয় আপনার স্মরণে নেই।……ছাত্ররা বলেছে, আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। এভরিথিং ইজ গন। অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে।’
সেই ছাত্রদের কথায় বুধবার রাতে ইউনুস নিজেই রিসেট বাটন পুশ করেছেন ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধে ঘোষণা করে, ৭৬ বছর আগে যে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। সেই থেকে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষার অধিকার, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ছাত্র সংগঠনটি।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ দলেরই প্রথমসারির নেতৃত্বের সিংহভাগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে ছাত্র লিগ দিয়ে। এই উপ-মহাদেশ তো বটেই, গোটা বিশ্বে ছাত্র লিগের মতো সংগঠনের নজির কম আছে যাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়, একটি জাতি গঠন এবং যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ—তিন বিরল অর্জনের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকাটির সঙ্গেও মিশে আছে এই ছাত্র সংগঠনটির ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের বছর ১৯৭০-এর ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কতিপয় তরুণ ছাত্র নেতা পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকাটি রাত জেগে তৈরি করা হয়েছিল সেটির নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মাস কয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন।
কোনও সন্দেহ নেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র লিগ নিজেই তাদের অতীতকে নসাৎ করে ক্রমে আওয়ামী লিগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেটা কতিপয়ের অপকর্ম। দল-সংগঠনের নীতি-আদর্শ বিচ্যুত, খুন-ধর্ষণ-রাহাজানিতে অভিযুক্তদের কঠোর সাজাই প্রাপ্য। বিপরীতে ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা জাতির অর্জনকেই অস্বীকার করা।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য দেশের বর্তমান প্রধান অভিভাবক একজন ব্যাঙ্কার, আর তাঁর উপদেষ্টাদেরও দলীয় রাজনীতির আঙিনায় ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা নেই। হাজার মন্দের মধ্যেও দলীয় রাজনীতিতে থাকা মানুষের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে।
প্রশ্ন হল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কথায় মহম্মদ ইউনুস রাতারাতি ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ করলেন কেন? প্রধান কারণ দু-পক্ষই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনাকে হটাতে সে দেশের মানুষকে যে ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি গেলানো হয়েছিল ইতিমধ্যেই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।অন্তর্বর্তী সরকারের অপদার্থতা পদে পদে টের পাচ্ছে মানুষ। আমজনতার অসন্তোষ হাটে-বাজারে-অফিসকাছারিতে টের পাওয়া যাচ্ছে। টিভি ক্যামেরার সামনে আছড়ে পড়েছে গণক্ষোভ। মানুষ বলছে, হাসিনাই ভাল ছিলেন। আর এই পরিস্থিতিতে প্রতি-বিপ্লব, ফ্যাসিস্টদের পুনরুত্থান বলে চালাতে চাইছেন ইউনুস বাহিনী।
পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে তাই রাষ্ট্রপতির অপসারণের ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। গণক্ষোভ রাজপথে আছড়ে পড়ার আগে ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আগাম প্রতিবাদের ডানা ছাঁটার ব্যবস্থা করা হল। আগামী দিনে হয়তো নিষিদ্ধ হবে যুব লিগও।
প্রশ্ন হল বিএনপি-র ছাত্র দল, যুব দলও বিপন্মুক্ত কি? আজ কিংবা কাল বিএনপি-কে ইউনুসের বিরুদ্ধে পথে নামতেই হবে। তার আগে ছাত্র দল, যুব দলকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে না, বাজি রেখে কারও পক্ষে বলা কঠিন। রাজনীতিতে কিছুই অসম্ভব নয়। বরং অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলাও রাজনীতি। কাঁটাতারের এপার থেকে উপলব্ধি করছি, সময়ের দাবি মেনে বিএনপি ও আওয়ামী লিগকে হয়তো ফিরে যেতে হতে পারে সাড়ে তিন দশক আগে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী যৌথ আন্দোলনের দিনগুলিতে। আজকের আওয়ামী লিগের মতো আগামীতে বিএনপি’র-ও আশু কাজ হয়ে দাঁড়াতে পারে দলের অস্তিত্ব রক্ষা। ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ না করা ছাত্র দল ও বিএনপি-র জন্য তাই ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হয়ে যেতে পারে।