শেষ আপডেট: 25th January 2025 18:49
মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লিগ ও বিএনপি-র অবস্থান এখন মোটের উপর অভিন্ন। দুই দলই চাইছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিদায় নিক ইউনুস সরকার। ভোট হোক নতুন কোনও সরকারের অধীনে। বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট দাবি করেছেন। স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন, নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাঁরা ইউনুস সরকারের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না।
অন্যদিকে, আওয়ামী লিগের তরফে সাবেক মন্ত্রী মহম্মদ আলি আরাফত বলেছেন, ইউনুস সরকারকে সরিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে।
লক্ষণীয় হল, বিএনপি এবং আওয়ামী লিগের দুই নেতার কথায় ফারাক শুধু শব্দচয়নে। ইউনুস সরকারকে সরানোর প্রশ্নে দুই দলই সহমত। অন্তবর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা সরকারের অংশ। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করলে ছাত্র প্রতিনিধিদের সরকার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। নইলে এই সরকারকে নিরপেক্ষ বলা যাবে না। এই সরকারের অধীনে তাই নির্বাচন হতে পারে না। ফখরুল নিরপেক্ষ সরকার দাবি করেছেন।
অন্যদিকে, আওয়ামী লিগ নেতার বক্তব্য, মহম্মদ ইউনুসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে বেছে নিয়েছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব। সেই ছাত্র নেতৃত্ব যদি রাজনৈতিক দল গড়ে নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে সেই সরকার আর নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সরকারি মদতে ছাত্ররা ‘কিংস পার্টি’ গঠন করছে বলে ইতিমধ্যে অভিযোগ তুলেছে একাধিক দল।
কিংস পার্টি ধারণাটি ইউরোপের। মূলত ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি মদতে ভোটের মুখে তৈরি নব্য রাজনৈতিক দলকে কিংস পার্টি বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিংস পার্টি নতুন নয়। বর্তমানে সক্রিয় বহু দলেরই জন্ম হয়েছিল কিংস পার্টির মতো করে। অর্থাৎ ভোটের আগে জন্ম নিয়েছিল। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বিএনপি-কেই দেশের প্রথম কিংস পার্টি বলা হয়ে থাকে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৭৮ সালে ভোটের আগে বিএনপি গঠন করেছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার হল দুটি সরকারের মধ্যবর্তী সময়ে স্বল্পকালীন সরকার, যাদের কাজ মূলত নির্বাচন সংঘঠিত করা। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করানোর দাবি উঠেছিল ১৯৯০-এ তৎকালীন শাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদকে উৎখাতের আন্দোলনে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া একযোগে পথে নেমেছিলেন সেনা শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে। এরশাদ সরকারের পতনের পর নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে। যদিও সংবিধানে তেমন সরকারের বিধান তখন ছিল না। জনআকাঙ্খাকে মর্যাদা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়ে নির্বাচন করানো হয়।
সেই নির্বাচনে ক্ষমতা আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বীধীন বিএনপি। খালেদার সরকার ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করে।
যদিও সংবিধান সম্মত প্রথম এবং শেষ তত্ত্ববধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা ভাল হয়নি। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের পর ২০০৭-’২০০৮ ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনা বাহিনী সমর্থিত সেই সরকার রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জেলে পাঠায় হাসিনা, খালেদাকেও। সেই সরকারের অধীনে ২০০৮-এর শেষ লগ্নে হওয়া নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লিগ।
২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার রায় দেয়। সেই রায়কে হাতিয়ার করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন শেখ হাসিনা। তাঁর জমানায় হওয়া ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবিতে অনড় ছিল বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী পার্টিগুলি। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই জানিয়ে হাসিনা সরকার বিরোধীদের দাবি অস্বীকার করে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মহম্মদ আলি আরাফতের একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিএনপি হাসিনা জমানায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইউনুসের বিকল্প সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেননি। যদিও হাসিনার বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গত মাসে ফের বৈধতা পেয়েছে বাংলাদেশ হাই কোর্টের একটি রায়ে। সেই রায় অনুযায়ী আগামী সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে কোনও বাধা নে্ই।
লক্ষণীয়, এই সুযোগে হাসিনার বাতিল করে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবি তুলেছে তাঁর দল আওয়ামী লিগই। সেটি যে নেত্রীর পরামর্শেই তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দলের এক যুগ্ম সম্পাদকের কথায়, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভিমত নেত্রীর পরামর্শ ছাড়া প্রকাশ করা নিষেধ আছে। যদিও আরাফতের বক্তব্য দলের অবস্থান কি না তা এখনও সরকারিভাবে স্পষ্ট করেনি আওয়ামী লিগ। আবার পরোক্ষে মান্যতা দিয়েছে বলা চলে। আরাফতের বক্তব্যের ব্যাখ্যা শনিবার পোস্ট করা হয় আওয়ামী লিগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে।
আরাফতের বক্তব্য, হাসিনা সরকারের সময়ে তাঁরা তত্ত্বাধধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি খারিজ করেছিলেন কারণ দেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু মহম্মদ ইউনুসের সরকার নির্বাচিত সরকার নয়। ৫ অগাস্টের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের দাবি মেনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের সম্মতির ভিত্তিতে। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও বিধান নেই।
আলি আরাফতের বক্তব্য, হাই কোর্টের রায়ে যেহেতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফিরে এসেছে তাই এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে সরিয়ে সাংবিধানিক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্ভব। আরাফত নাম না করে বিএনপি-কে খোঁচা দিয়ে বলেছেন, যারা এতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় ছিলেন তারা এখন চুপ কেন? কেন তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করছেন? যদিও বিএনপি এই পর্যায়ে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব নিয়ে দলীয় অবস্থান জানায়নি।
আওয়ামী লিগ চাইছে এমন একজন ব্যক্তির নেতত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক যিনি নিরপেক্ষ অবস্থান নেবেন। মহম্মদ ইউনুসের সরকার ঘোষিতভাবে আওয়ামী লিগ বিরোধী। আওয়ামী লিগ চাইছে এমন একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক যারা তাদের প্রতি বিরূপ হবে না। একাধিক সুত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ইউনুস সরকারকে হটিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ভাবনাচিন্তা চলছে। সাবেক এক সেনা প্রধানকে সেই সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব নিয়ে একান্তে আলাপ-আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। কারণ, জামায়াতে ইসলামি ছাড়া কোনও দলই ইউনুস সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। জিনিসপত্রের দাম অসহনীয় দাম এবং বেহাল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে বিএনপি-র মতো ঘোর আওয়ামী লিগ বিরোধী দলগুলিও ইউনুস সরকারের বিদায় চাইছে।
হাসিনা জমনার সেই সেনা প্রধান রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লিগের তেমন আপত্তি নেই। তবে যে নামই চূড়ান্ত হোক না কেন, ২০০৭-’০৮ সালের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট মহল সতর্ক। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাথায় এমন কাউকে বসানো যাবে না যিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন।