শেষ আপডেট: 3rd February 2025 15:05
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা বিএনপি সুপ্রিমো খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে চিঠি পাঠিয়েছেন। গত ৩১ জানুয়ারি লেখা সেই চিঠির কপি রবিবার রাতে প্রকাশ করা হয়। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিএনপি নেতৃত্ব দলের তরফে সরকারিভাবে চিঠিটি প্রকাশ করেনি।
দলের পক্ষ থেকে মিডিয়াকে চিঠির কপি দেওয়া হয়। দলের কোনও নেতা, বিশেষ করে পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেলের কোনও দায়িত্বে থাকা নেতা-নেত্রী বা মুখপাত্র ওই চিঠির বিষয়ে মিডিয়ার কাছে মুখ খোলেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সেলের এক নেতার কথায়, ‘আমাদের ওই চিঠি সম্পর্কে নেতৃত্ব কিছু জানায়নি। পাক প্রধানমন্ত্রীর চিঠির কথা আমরাও মিডিয়া থেকে জেনেছি।’
খালেদা জিয়া বহু বছর যাবত অসুস্থ। গত মাসের মাঝামাঝি তিনি লন্ডনে চিকিৎসা করাতে যান। তাৎপর্যপূর্ণ হল, পাক প্রধানমন্ত্রী তাঁর আরোগ্য কামনা করে এমন সময় চিঠি পাঠিয়েছেন যখন তিনি তুলনামূলকভাবে সুস্থ এবং লন্ডন ক্লিনিক থেকে ছেলে তারেক জিয়ার বাসায় উঠেছেন। তারেক বহু বছর ব্রিটেনের রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন।
খালেদাকে পাক প্রধানমন্ত্রীর চিঠি লেখার বিষয়টি জানাজানি হতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। চর্চা চলছে ভারত, পাকিস্তানেও। চারটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। এক. বিএনপি কেন খালদাকে লেখা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চিঠির বিষয়টি নীচু তারে রাখতে চাইছে। দুই. নয়া দিল্লির প্রতি ঘনিষ্ঠতার বার্তা দিতেই কি ইসলামাবাদ নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না খালেদা জিয়ার দল। তিন. পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কেন এখন খালেদাকে চিঠি লিখলেন। চার. এর পিছনে কি কোনওভাবে ভারত-অঙ্ক যুক্ত।
কূটনৈতিক মহলের খবর, পাক প্রধানমন্ত্রীর এখন চিঠি লেখা এবং বিএনপি-র সেই চিঠির প্রসঙ্গে কার্যত নীরব থাকার পিছনে আছে ভারত-অঙ্ক। এই প্রসঙ্গেই কূটনৈতিক মহলের পর্যপেক্ষণ হল, বিএনপি গত দেড়-দু’মাস যাবত ভারত বিরোধিতায় লাগাম টেনে দিয়েছে। রুহুল কবীর রিজভির মতো দলের প্রথমসারির নেতা ভারতীয় পণ্য পোড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। দলের তরফে বার্তা দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় পণ্য পোড়ানো, বয়কটের ডাক রিজভির ব্যক্তিগত বিষয়। বিএনপি এমন কোনও কর্মসূচি নেয়নি।
সূত্রের খবর, খালেদা জিয়ার পার্টি অতীত ভুলে ভারতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার পর বিএনপি নেতৃত্ব অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ভারত এতদিন শুধু একটি দল ও সেই দলের নেত্রীর (পড়ুন, আওয়ামী লিগ ও শেখ হাসিনা) সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যরিস্টার রুমিন ফারহানা ‘দ্য ওয়াল’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভারতের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ মানে শুধু শেখ হাসিনা নন।’
বিএনপি নেতারা অনুযোগ করার পর ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার প্রণয়কুমার ভার্মা খালেদা জিয়ার দলের দফতরে গিয়ে পার্টির প্রথমসারির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আসেন। সেই সাক্ষাৎকার এমন সময় ঘটে যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে ব্যস্ত। সমানতালে তৎপর ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনারও। ঢাকায় পাকিস্তানের জাতির পিতা মহম্মদ আলি জিনহার জন্ম ও মৃত্যু দিন উদযাপন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে দেশের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো, দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ যাতায়াত শুরু হচ্ছে।
লক্ষণীয় হল, বরাবর পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলা বিএনপি মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের ইসলামাবাদ ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গিয়েছে।
আসলে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপি-তে নানা মত আছে। দুটি বিপরীত মতের একটি হল, অতীত ভুলে ভারতের সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরি করা। এই পক্ষের মতে, নয়া দিল্লি চায় বাংলাদেশে তাদের জন্য বিপদের কারণ হবে না এমন কোনও সরকার ক্ষমতায় থাক। অতীতে বিএনপি জমানায় বাংলাদেশের মাটিতে ভারত বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে নয়া দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল।
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সামনে আসে সেগুলি পাক সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জনা পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশে তখন খালেদা জিয়ার সরকার। বিএনপি-র বড় অংশ মনে করছে, আগামী দিনে দল সরকার গড়ার সুযোগ পেলে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক কাজে আসবে। কারণ, নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদ করে সরকার চালানো কঠিন।
অন্যদিকে, বিএনপির আর এক অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ করার পক্ষপাতী। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি- শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে তারেক জিয়া কী ভাবছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তুমুল কৌতুহল ছিল। বিএনপি নেতৃত্ব সরকারিভাবে অবস্থান স্পষ্ট না করলেও তারেক জিয়ার একটি মন্তব্যকে কূটনৈতিক শিবির বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ দিনে নানা উৎসব অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের শিল্পীদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে খালেদা জিয়ার ছেলে তথা বিএনপি-র কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান তারেক মন্তব্য করেন, ‘বিগত সরকারের আমলে শিল্পী আসত ভারত থেকে আর এখন আসে পাকিস্তান থেকে। এসব চলতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি সংস্কৃতির বড় কোনো আয়োজন মানেই ভারতের শিল্পীদের এনে আয়োজন করা। দেশের শিল্পীদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। এই ধারা আমরা বদলাতে চাই।’
মেপে কথা বলার মানুষ তারেকের ওই মন্তব্য মিডিয়ায় আসে ৩১ জানুয়ারি সকালে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, ওই দিন বিকালে খালেদার আরোগ্য কামনা করে চিঠি পাঠৈান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ। কূটনৈতিক শিবিরের একাংশ, তারেকের ওই মন্তব্যকে পাকিস্তানের সঙ্গে বিএনপি-র দূরত্ব তৈরির চেষ্টা হিসাবেই দেখছে। ওই মন্তব্যকে ভারতের জন্য স্বস্তির বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ, তারেক বার্তা দিয়েছেন তিনি পাকিস্তানকে নিয়ে বিগলিত হবেন না।
একাধিক সুত্রের খবর, নানাভাবে বিএনপি ভারতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার বার্তা দিতে শুরু করেছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, আগামী দিনে দল সরকার গড়ার সুযোগ পেলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নয়া দিল্লিকে পাশে দরকার হবে।
জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ভারত সরকারও বিএনপি সম্পর্কে অবস্থান বদলের পথে হাঁটছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রকের কর্তারা অনেকেই মনে করছেন, আওয়ামী লিগ নির্বাচনের আগে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বাংলাদেশে বিএনপির ক্ষমতায় থাকাটা ভারতের জন্য মন্দের ভাল হতে পারে। তবে ভোট হলে আওয়ামী লিগ যাতে কার্যকর বিরোধী দল হিসাবে সংসদে উপযুক্ত সংখ্যায় আসন নিয়ে থাকতে পারে সেটাও চায় নয়া দিল্লি।
শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের রাজনৈতিক পুনর্বাসনকে নয়াদিল্লি শুধু আওয়ামী লিগের কারণেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লিগ প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে ময়দানে না থাকলে খালেদা জিয়ার দলের উপর জামায়াতে ইসলামি সহ কট্টর ইসলামিক দলগুলির প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে বিএনপি এবং ভারত সরকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি আপাতত উন্মুক্ত রেখে চলছে। আর তা আঁচ করেই পাক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-কে ঘনিষ্ঠতার বার্তা দিয়ে খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে চিঠি পাঠিয়েছেন।