শেষ আপডেট: 12th February 2025 22:11
চেপে বসা ইউনুস সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশকে নিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা একেবারেই একপেশে। সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লিগের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অবগতি, সমন্বয় ও নির্দেশনায় জুলাই-আগস্ট মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাবাহিনী আওয়ামী লিগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সহিংস উপায় ব্যবহার করে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এতে শতশত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ করা হয়। একইসঙ্গে নির্বিচারে আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিগ্রহের ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যখন একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করা হয়, তখন কি সরকার জনগণের কল্যাণে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাতের চেষ্টা করবে, নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?
রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ পুলিশের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। এখানেই মূল সত্যটি উঠে এসেছে। আমাদের সবারই মনে আছে, তথাকথিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তথাকথিত সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শো তে বলেছিলেন, 'যদি মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া না হতো বা যদি পুলিশদের না মারা হতো, তাহলে বিপ্লব এতো সহজে অর্জিত হত না।' অর্থাৎ মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া, পুলিশ হত্যা সবকিছু পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছে।
আমরা আরও স্মরণ করতে পারি, গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে বর্তমান চেপে বসা সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বক্তব্য। তিনি বলেন, এই আন্দোলন ছিল 'মেডিকুলাসলি ডিজাইনড'। ছাত্র-জনতা কিছু জানত না এর মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ আলম। তাঁকে স্টেজে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেন। অর্থাৎ বর্তমান চেপে বসা সরকারের প্রধান নিজেই দীর্ঘদিন থেকে একটি নির্বাচিত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে সরাসরি জড়িত।
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও অনেক বিষয় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। ড. মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর শুরুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। সেখানে তিনি বলেন, 'এই বুলেট আমাদের পুলিশ ব্যবহার করে না।'
৭ জুলাই থেকে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। তাদের ওপর কোনও জুলুম অত্যাচার করা হয়নি। ১৫ জুলাই থেকে হত্যাকাণ্ড অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। যা ওই 'মেটিকুলাস ডিজাইন'-এর অংশ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চলে যখন ৬জন নিহত হয় তখনই শেখ হাসিনা বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করে দেন। এই তদন্তে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়ে বক্তব্য দেন। তারা তদন্তের কাজও শুরু করে। কিন্তু ইউনুস একটি নির্বাচিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগী তদন্ত কমিটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। এ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় ক্ষমতা দখলের জন্য সিভিলিয়ানদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
জাতিসংঘ তদন্ত কমিটি কেন এ বিষয়গুলি খতিয়ে দেখল না, এটাই আমাদের প্রশ্ন। যথাযথ বিশেষজ্ঞ দিয়ে লাশের ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে তদন্ত করার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ থাকবে আমাদের। তাহলেই সত্যটা বের হয়ে আসবে।
সারা বিশ্ব জানে, জুলাই-অগাস্টে, বিশেষ করে ৫ অগাস্টের পর সারাদেশে নানা সহিংসতা ঘটে। এতে আওয়ামী লিগ সমর্থক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সরকার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হয়। শুধু ৫ আগস্ট ২৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। ঢাকার একটি দৈনিকের তথ্যানুযায়ী, ৫ আগস্টের পর সারা বাংলাদেশে এক হাজার ৪৯৪টি ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর করা হয়েছে এবং ৫ থেকে ২০ আগস্ট সারাদেশে সংখ্যালঘুদের এক হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ২২টি উপসানালয় হামলার শিকার হয়।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতে, মোট দুই হাজার ১০টির বেশি হামলা হিন্দু সম্প্রদায় বা তাদের সম্পত্তির ওপর হয়েছে, যা ৪৫টি জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব হামলায় পাঁচজন হিন্দু নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুইজন আওয়ামী লিগের সদস্য বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপরও ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ হয়, যা তাদের মসজিদ ও ঘরবাড়ির ক্ষতি করে। সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপরও হামলা চালানো হয়।
আর একটি তথ্য বলছে, ৫ থেকে ১৪ অগাস্টের মধ্যে ৫৯টি জেলায় এক হাজার ৪৯৪টি ভাস্কর্য, ম্যুরাল এবং স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ, সিলেটের শাহপরান, সিরাজগঞ্জের একাধিক, ঠাকুরগাঁওয়ের বিবি সখিনার মাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু সংখ্যক মাজারে হামলা করা হয়েছে।
একটি ইংরেজি দৈনিকের তথ্যমতে, সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রথম ঘণ্টায় অন্তত ২৭টি জেলায় হিন্দুদের নানা বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে।
১ জুলাইয়ের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় বিক্ষোভকারীদের হাতে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে, ৪৫০টিরও বেশি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। পুড়িয়ে হত্যা করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পুলিশ হত্যা করে তারা।
রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে এসব তথ্য এড়িয়ে গেল কী করে?
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রসংঘ যে প্রতিবেদনটি দিয়েছে, তা একপেশে এবং ইউনুস সরকারের ডিক্টেশন মেনে তৈরি করা। আমরা এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি। রাষ্ট্রসংঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠান এ ধরণের কাজ করতে পারে, এটি আমাদের কাছে বিস্ময়।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রসংঘের উচিত এ ধরণের একপেশে প্রতিবেদন নিজ দায়িত্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লিগ
মতামত ব্যক্তিগত