শেষ আপডেট: 10th January 2025 08:13
‘যাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নাই গণহত্যা নিয়ে, তাদের সাথে নো রিকন্সিলিয়েশন (পুনর্মিলন)। আগে বিচার, তারপর সমঝোতা! মুজিববাদের (Mujibar Rahman) বিরুদ্ধে এবার হবে প্রত্যাঘাত। খুনিদের ক্ষমা নাই। খুনিদের আদর্শের ফেরিওয়ালাদের ক্ষমা নাই।’ গত ১৫ অক্টোবর ফেসবুকে লেখেন মাহফুজ আলম।
কে তিনি? বছর তিরিশের এই যুবক বাংলাদেশে বেশ আলোচিত নাম। তিনি জামায়াতে ইসলামি নাকি হিযবুত তাহেরীর, কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা নিয়ে বিস্তর চর্চা আছে। তাঁর কথাবার্তা, কর্মকাণ্ড থেকে এই দুই সংগঠন বা তাদের সমগোত্রীয় যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সদস্য বলে ধরে নিতে বাধা নেই। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর আদর্শ, ভাবনার মিল আছে। যদিও জানিয়ে রাখা প্রয়োজন তিনি নিজে এই জাতীয় কোনও সংগঠনের সঙ্গেই তাঁর যোগ অস্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শগত দুটি ধারা হল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিরোধী শক্তি। দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ বিরোধীরা সংখ্যায় কম হলেও বৌদ্ধিক জগতে, এলিট সমাজে তাঁদেরই কদর বেশি। আজকের বাংলাদেশে মাফফুজ আলম সেই অংশের প্রতিনিধি। সেই কারণে তাঁকে নিয়ে কৌতূহল সমবয়সীদের ঈর্ষার কারণ।
গত সেপ্টেম্বরে মহম্মদ ইউনুস নিউ ইয়র্কে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের সভায় এই তরুণকেই হাসিনা বিরোধী গণ অভ্যুত্থানের মাথা বা মাস্টার মাইন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বছর তিরিশের মাহফুজ তখন ছিলেন ইউনুসের সহকারী। এখন একই সঙ্গে তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। শপথ নেওয়ার পর এই তরুণ উপদেষ্টা বিস্তর বিরক্তি প্রকাশ করে নির্দেশ দেন, বঙ্গভবন থেকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সরিয়ে দিতে হবে। তৎক্ষণাৎ সেই নির্দেশ কার্যকর হয়েছে।
মুজিবুর রহমানকে অশ্রদ্ধা, তাঁর প্রতি এই ভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে গিয়ে মাহফুজ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়া শব্দ ‘মুজিববাদ’-কে জীবন্ত করে তুলেছেন। ‘মুজিববাদ’ শব্দটি আমি শেখ হাসিনা, আওয়ামী লিগের কোনও নেতা, ওই দলের অনুগামী লেখক, গবেষক, কারও মুখে শুনুনি। আওয়ামী লিগের নথিপত্রে, সম্মেলন ইত্যাদিতে শেখ মুজিবের রাজনীতিকে ‘মুজিববাদ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলেও জানি না। লেখক, সাংবাদিক খোন্দকার মহম্মদ ইলিয়াসের ‘মুজিববাদ’ নামে বইটি বাদে ওই শব্দটির আর কোনও উল্লেখ নেই। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের দিনে ঢাকার জনসমুদ্রে অনেকের মুখেই শোনা গিয়েছিল, ‘বিশ্বে এল নতুন দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ,’ ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ, মুজিববাদ, মুজিববাদ’ ইত্যাদি। আবেগ আপ্লুত জনতার সেই স্লোগান স্থায়ী হয়নি। ‘মুজিববাদ’ শব্দটি একটি মাত্র বইয়ের দুই মলাটের মধ্যেই আটকে থাকে।
যদিও স্বয়ং শেখ মুজিবের ঘোরতর আপত্তি ছিল শব্দটিতে। ‘মুজিববাদ’ নিয়ে চর্চা শুরু হলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র—এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমার মতকে অনেকে বলছেন মুজিববাদ। এদেশের লেখক, সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কী নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মোহ নাই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ! আমি চাই আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।’
সেই বাংলাদেশ থেকে ৫ অগাস্ট তাঁর কন্যা হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে শেখ মুজিবের কত মূর্তি ভাঙা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। সেই ধ্বংসলীলার টুকরো দৃশ্য দেখে অনুমান করা যায়, সংখ্যাটা কয়েকশো হওয়া অসম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাস দেড়েক পর ঢাকায় কিছুদিন কাটিয়ে আসা কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, এখানে সেখানে তবু শেখ হাসিনার এক দুটি ছবি অক্ষত আছে, শেখ মুজিবের নেই বললেই চলে।
ধানমণ্ডির বাড়িটি সংস্কারের কাজ এখনও শুরু হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার শেখ মুজিবকে হত্যার দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে পালন করেনি, বাতিল করেছে সেদিনের সরকারি ছুটি। বাতিল করা হয়েছে ৭ মার্চের (ঢাকার স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ) ছুটিও। সংবিধান সংশোধনের আগেই সরকার ঘোষণা করেছে তারা শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলে মানে না। মুজিবের হাত ধরে চালু হওয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দুটি মুছে দিতে আগ্রহী ইউনুস সরকার। ‘জয় বাংলা’-কে জাতীয় স্লোগান বলেও মানে না বর্তমান সরকার।
এরও আগে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়নি। ছিল না তাঁর কোনও প্রতিকৃতি। প্রথা মেনে উচ্চারিত হয়নি সে দেশের জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মুহাম্মদ মনসুর আলির নাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে শুধু কোরান পাঠ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের চালু প্রথা মেনে কোরানের পর গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হয়নি। হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলেও ৫ থেকে ৮ অগাস্ট রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বালাই ছিল না।
যাদের হাত ধরে এই উল্টে পথে যাত্রা, গণ অভ্যুত্থানের দিনগুলিতে সেই ছাত্ররা আওয়াজ তুলেছিল, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি রাজাকাররা শত শত খুন আর হাজার হাজার নারীর উপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছিল। মহম্মদ ইউনুসের নানা পদক্ষেপে স্পষ্ট, রাজাকারদের অভিভাবক জামায়াতি ইসলামী তাঁর আসল উপদেষ্টা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এ সবই আসলে শেখ মুজিবকে সরকারিভাবে মুছে ফেলার আয়োজনের অংশ যা মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশ থেকে ‘মুজিববাদ’ মুছে ফেলাই তাঁদের লড়াই।
প্রশ্ন হল মুজিববাদ কী? লেখক, সাংবাদিক খোন্দকার মহম্মদ ইলিয়াস ছিলেন কলকাতায় শেখ মুজিবের সহপাঠী, রাজনীতিতে সহযোদ্ধা। ‘মুজিববাদ’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মুজিববাদের মূল দর্শন—বাংলার মাটি, বাঙালি-মানস এবং বাঙালির চারিত্রিক, ভৌগৌলিক ও পারিপার্শ্বিক বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে সেই সঙ্ঘবদ্ধ ও সুসংহত শক্তিকে জাতি গঠনের কাজে নিজস্ব পথে এবং সাফল্যজনকভাবে নিয়োগ ও প্রয়োগ। সেই সঙ্গে মুজিব-চিন্তার শপথ—বাংলাদেশে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও সকল মেহনতী মানুষের জন্যে একটি গণতান্ত্রিক, শোষণহীন, সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গ্যারান্টি। সোনার বাংলা তার পরিচয়।’
কুষ্টিয়ায় এক জনসভায় শেখ মুজিব সংবিধানে ঘোষিত সংকল্পের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। আরও বলেছিলেন, ‘দেশের সম্পদ এখন সাড়ে সাত কোটি লোকের। যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এ দেশ শোষণহীন সমাজ হবে।’
টাঙ্গাইলের এক সভায় বলেন, ‘গরিব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক। শোষকরা হবে না। বিদেশ থেকে হাওলাত কইরা আইনা সমাজতন্ত্র হয়না; ওটা যাঁরা করতে গেছেন কেউ সমাজতন্ত্রে পৌছতে পারেন নাই।’
গণতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি শোষিতের গণতন্ত্র কথাটি বারে বারে বলেছেন। বলেছেন, ‘গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায়- পুঁজিবাদকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য গণতন্ত্র কাজ করে এবং যেখানে প্রয়োজন হয়- শোষকদেরকে রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করিনা। আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র। সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হল আমাদের গণতন্ত্রে যে বিধি-বিধান আছে সে সমস্ত প্রোভিশন করা হয়েছে, তাতে এদেশের দুঃখী মানুষ যাতে প্রোটেকশন পায় তারই বন্দোবস্ত আছে; ওই শোষক প্রতিষ্ঠিত হয় তার ব্যবস্থা নাই।’ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ছিলেন স্পষ্টবাদী। ঘোষণা করেছিলেন, যার যা ধর্ম সে তা পালন করবে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকেই মূল স্তম্ভ করেছিলেন তিনি।
সেই সংবিধানকে সঙ্গী করে মাত্র তিন সাড়ে-তিন বছরের শাসনকালে নেওয়া আইন, সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপে তিনি স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন ৫২ বছর আগে, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রত্যাবর্তণ কেন জরুরি ছিল। সেগুলিও মুজিববাদের অংশ। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বদেশে মুজিববাদ মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হলেও পুরোপুরি সফল হয়নি। চার বছর আগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশটির উন্নয়নের বিস্ময় নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা, স্বীকৃতি প্রাপ্তির পিছনে ছিল ওই তিন-তিন সাড়ে তিন বছরের কর্মকাণ্ড, প্রকৃতপক্ষে যা মুজিববাদের ফসল, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে যে মতবাদের কথা দাবি করতে হয়নি। পাকিস্তানের কারাগারে তাঁর সেলের পাশেই খোঁড়া হয়েছিল কবর। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাক শাসকদের পক্ষে জীবন্ত মুজিবকে পুঁতে দেওয়া অসম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই মুর্খামি তাঁরা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পঁচিশ দিনের মাথায় শেখ মুজিব বাঙালির দেশ বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলেন।
আজ সেই ঐতিহাসিক দিনটির তাৎপর্য সেদিনের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। কপালের লিখন স্পষ্ট, শেখ মুজিবের পার্টি আওয়ামী লিগের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ‘মুজিববাদ’ রক্ষার, মুছে দেওয়ার চেষ্টার কারণেই যে মতবাদ আজ প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেয়েছে। মাহফুজকে দিয়ে মুজিববাদ বিরোধীরা তাঁদের এজেন্ডা জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লিগকে ঠিক করতে হবে তাঁরা কী করবে।