শেষ আপডেট: 18th February 2025 17:21
যে মানুষটি হতে পারতেন বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত উঁচুমাপের মানুষ, তিনি তাঁর লাগামহীন ক্ষমতার লোভে বর্তমানে এই দেশের সিংহভাগ মানুষের চোখে ভয়াবহ প্রতিহিংসাপরায়ন, ক্ষমতালোভী একজন। তিনি ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে গত ছয় মাসে সভ্যতা ও মানবতার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে তিনি আগামীতে পরিচিত হবেন একজন অভিশপ্ত মানুষ হিসেবে যিনি নিজের স্বার্থে নিজের দেশকে ধ্বংস করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তিনি মহম্মদ ইউনুস।
বিশ্বশান্তির জন্য নোবেল জয়ী ইউনুসের বর্তমান পরিচয় তিনি একটি জঙ্গি রাষ্ট্রের জনক যেটি কয়েক মাস আগেও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই দেশের নাম পরিবর্তন করতে একজন মার্কিন পণ্ডিত ভাড়ায় আনা হয়েছে। পরিবর্তন করার চেষ্টা হচ্ছে ৩০ লাখ শহিদের রক্তে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানকে, পরিবর্তনের পরিকল্পনা হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত।
ইউনুস ক্ষমতা দখলের পর কারাগার থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় প্রায় দেড়শ ভয়ঙ্কর জঙ্গিকে, যাদের মধ্যে আছে হারকাতুল জিহাদ, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরির এবং জামায়াতের জঙ্গিরা। ১৮টি জেলখানা হতে শ’খানেক জঙ্গি নিজেরাই পালিয়ে যায়। তাদের আটক করার কোনও প্রচেষ্টা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। এখন রাস্তায় মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইসিসের পতাকা নিয়ে সহজে চলাফেরা করা যায়। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে বসন্ত উৎসব বন্ধ করা যায়, লালনের উৎসব নিষিদ্ধ করা যায়। এমনকি ফুলের দোকানে হামলা করে একদল উচ্ছৃঙ্খল ধর্মান্ধ মানুষ যারা নিজেদের তৌহিদি জনতা। বন্ধ হয়ে যায় দোকান। তারা মনে করে এই ফুল তরুণ-তরুণীরা বসন্ত উৎসব পালনে বিনিময় করে। কোনও কোনও এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নারীদের ফুটবল খেলা।
এক সময় এই বাংলাদেশকে বলা হত বারো মাসে তের পার্বণ আর উৎসবের দেশ। সেই দেশে এখন অধর্শিক্ষিত কাঠমোল্লাদের বিনোদনে ভরপুর তথাকথিত ওয়াজ মাহফিলে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। বিনা বাধায় মানুষকে বিরক্ত করা যায় । অন্য কোনও অনুষ্ঠান করা অনেকটা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ অথবা একদল উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্ত, যাদের বলা হয় ‘মব’-তারা তা করতে দেয় না। কোনও সংগঠন কোনও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সাহস দেখালে তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসে নির্বিঘ্নে বন্ধ করে দেয়। বলে অনুষ্ঠান করলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। গত শনিবার ঢাকার ৮৪টি নাটকের দল ঢাকা নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছিল। তৌহিদি জনতার নামে একদল দুর্বৃত্ত তা বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগে দেশে অনেক স্থানে বন্ধ হয়েছে লালন মেলা/উৎসব। চট্টগ্রামে বসন্ত উৎসব চলার মাঝখানে এই দুর্বৃত্তদের দাবির মুখে আয়োজকরা তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বন্ধ হয়েছে অমর একুশের বইমেলার স্টল, কারণ তারা তসলিমা নাসরিন নামের একজন নির্বাসিত লেখিকার বই বিক্রি করছিল। বলে, এই লেখিকার বই অনৈসলামিক। এই নির্বোধরা বুঝতে অক্ষম এখন বই কিনতে মেলায় যেতে হয় না। ঘরে বসে অনলাইনে বইসহ সব কিছু কেনা যায়। শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে মঞ্চায়িত হচ্ছিল নাটক। একদল ‘তৌহিদি’ দুর্বৃত্ত এসে বলে বন্ধ করতে হবে এই নাটক। কারণ, এটি ভারতীয় লেখকের লেখা। অবাক করার বিষয় হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন ‘এই নাটক আর চলবে না’। শিল্পকলার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। কথায় কথায় ভারতবিরোধিতা কিন্তু ভারত থেকে চাল, পেঁয়াজ রসুন না আসলে এই দুর্বৃত্তদের চুলায় হাঁড়ি চড়ে না।
ইউনুস এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘গণশত্রু’ হিসেবে পরিচিত। ইউনুস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন। পরক্ষণেই সংবাদ আসে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ২৯ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা তহবিল বাতিল করে দিয়েছে। গত ছয় মাসে দেশে ৭১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ১৩ শতাংশের উপর মূদ্রষ্ফিতি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে।
যে দেশটি একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দেশ এখন সার্বিকভাবে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানের মতো একটি পতিত রাষ্ট্র হিসেব পরিচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ইউনুসের দখল করা দেশে কোনও দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমানে নেই। ১২২টি রেডিমেড পোশাক কারখানা বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে। বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান বা ভিয়েতনামে। আরও একাধিক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ইউনুসের খপ্পরে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর পরই। নিত্যদিন বেকার হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক। একজন ব্যবসায়ী নেতা যখন বলেন ‘সাভারে সব্জির দামের চেয়ে মেয়ে মানুষের দাম কম’ তখন বোঝা যায় দেশের অর্থনীতির অবস্থা কত ভয়াবহ। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের (চাল-গ্যাস) মূল্য পরিশোধ করার অর্থ নেই বলে জানিয়েছেন একজন উপদেষ্টা। তার উপর আইএমএফ থেকে প্রতিশ্রুত চতুর্থ কিস্তির অর্থ (৬৫ কোটি ডলার) পাওয়া অনিশ্চিত। আগের তিন কিস্তি পাওয়া গিয়েছিল শেখ হাসিনার শাসনকালে। নরওয়ে যেকোনও সময় বাংলাদেশে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে । একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে বাংলাদেশে একটি দূর্ভিক্ষ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। দেশের একটি বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যম সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) খবর দিয়েছে ‘অগাস্ট থেকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ বেড়েছে’। এখন সুযোগ পেলেই মানুষ অন্য দেশে বসবাসের জন্য নিজ দেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে।
ক্ষমতা জবরদখলকারি ইউনুসের প্রথম ছয় মাসের শাসনকাল ছিল একটি ভয়াবহ তমাশচ্ছন্ন দুঃসময়। এই সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিত হয়েছে একটি জঙ্গিবাদের উত্থানের দেশ হিসেবে। এই সময়ে বাংলাদেশের ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) ইউনুসপালিত দূর্বৃত্তরা ঘোষণা দিয়ে ধ্বংস করেছে। ধ্বংস হওয়া বাড়িতে উড়িয়েছে জঙ্গি সংগঠন ‘আইসিসের’ পতাকা। দেশের বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সব স্মারক ভেঙে ফেলা হয়েছে এটি বোঝানোর জন্য যে, এই দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানকে দু'টুকরা করা হয়েছে। এখন তা আবার জোড়া লাগানো হচ্ছে। এই কাজটি করছে একাত্তরে এই দেশে রেখে যাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঔরসজাত সন্তানরা। একদিন শান্তির ফেরিওয়ালা ইউনুস চলে যাবেন। কিন্তু তিনি ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে বাংলাদেশকে রেখে যাবেন, তা সার্বিক অর্থে উঠে দাঁড়াতে কয়েক প্রজন্মকে অপেক্ষা করতে হবে। ভাগ্যের ফেরে আর ক্ষমতার লোভে কথিত শান্তির দূত বিগত ছয় মাসেই নিজেকে ইতিহাসের একজন বড়মাপের অভিশপ্ত খলনায়ক হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন। এক কথায় বাংলাদেশ এখন নব্য আফগানিস্তান অথবা সিরিয়া। ‘শান্তির ফেরিওয়ালা’ ড. ইউনুস এখন দেশবাসীর কাছে এ যুগের মীরজাফর বা নব্য খোন্দকার মোশতাক। তবে শেষতক সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত