শেষ আপডেট: 10th January 2025 14:03
আজ ১০ জানুয়ারি। আসুন আমরা ফিরে যাই ৫৩ বছর আগের এই দিনটিতে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ছিল সোমবার। কেমন ছিল দিনটি? সেদিন বিজয়ী বীরের বেশে মুক্ত স্বদেশে ফিরছিলেন জাতির পিতা। বাঙালি জাতির হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে এসেছিলেন যে মহাপুরুষ, তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ।
কবি শামসুর রাহমান তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ধন্য সেই পুরুষ,.../ যার নামের ওপর/ কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/...ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা/ ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’ তিনিই তো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। এ জাতির দুঃখের দিনের কাণ্ডারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেদিন আকাশে যে সূর্য উঠেছিল, সেই সূর্য কি জানত যে এক মহান পুরুষ ওই আলো গায়ে মেখে বিজয়ীর বেশে নিজের দেশে ফিরবেন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে? ফিরলেন তিনি বাঙালির ভালোবাসা ছুঁয়ে। বাঙালি জাতির হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরলেন সেই মহাপুরুষ, যাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে চূর্ণ হয়ে যায় এই উপমহাদেশের যুগ-যুগান্তরের চিন্তার অস্থিরতা ও মানসিক অচলায়তন। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষ যেমন ফিরে পায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা, তেমনি তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
কেমন ছিল সেই দিনটি? কেমন ছিল সেদিনের সেই অপরাহ্ন?
সেদিন বাংলাদেশ বেতার থেকে অনবরত ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ জনতা। তাদের চোখেমুখে অন্য রকম উত্তেজনা। নেতা আসছেন।
আসছেন প্রিয় পিতা। পাকিস্তানের কারাগারের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশের মাটিতে আসছেন যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। একসময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পিতা দৃশ্যমান হন। সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ, প্রিন্স কোট আর উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। চেহারায় কি একটু ক্লান্তির ছাপ?
হবে হয়তো। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘদিন থাকা। তারপর পথের ক্লান্তি তো আছেই। বিমানের সিঁড়িতে দেখা যায় তাঁকে। ৩১ বার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের উল্লাস। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করল তাঁর প্রিয় স্বদেশভূমি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রিয় দেশের বাতাস নিলেন বুক ভরে। স্পর্শ করলেন এ দেশের মাটি। প্রিয় আলো তাঁকে ছুঁয়ে দিল। নাম না জানা কোনও পাখি কি দূরে কোথাও গান গেয়ে উঠেছিল? জানা যায়নি।
সেদিনের সেই অপরাহ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল এ রকম: ঢাকায় আজ জনতা তাঁকে এক বিজয়ী বীরের সংবর্ধনা দেয়। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় পৌঁছান।
অত্যন্ত ক্লান্ত শেখ মুজিব তাঁর ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, পৃথিবীর কোনো জাতিকেই স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার সমস্ত সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, সব দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘের সদস্য পদ পাবে। শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি তাঁর ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন। তিনি আশা করেন, অবশ্যই এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হবে।
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা জানেন বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁর দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে।’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তিনি পা রাখেন তাঁর প্রাণের মাটিতে। মাটির সন্তান ফিরলেন তাঁর প্রাণের মাটিতে। দুই চোখে কী স্বপ্ন খেলা করছিল তাঁর? স্বপ্ন ছিল তাঁর একটি স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন ছিল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের। স্বপ্ন ছিল এ দেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার।
বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক, সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ধর্মীয় মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই বিচার শুরু হয়েছিল। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন তিনি। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও তাঁর স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিন যাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বাবার মতোই তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সমৃদ্ধির দিকে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা অপশক্তির ষড়যন্ত্র সেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। চেপে বসা অপশক্তি দেশকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। পরাজিত শক্তির আস্ফালন আজ দেশজুড়ে। স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ ক্ষমতার মসনদে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার ভাষায় বলি, জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।'
আজ ১০ জানুয়ারি। ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারি নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন। আমাদের নতুন মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। দেশবিরোধী চেপে বসা অপশক্তিকে সমূলে উপড়ে ফেলে দিতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত