ফাইল চিত্র
শেষ আপডেট: 7 May 2025 00:00
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় পরিবর্তনগুলির একটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। আবির্ভাব ঘটেছিল কথিত ওয়ান-ইলেভেনের। একটি চেপে বসা অপশক্তি সেই সময়ের বাস্তবতায় প্রবল প্রতাপে দেশ শাসন শুরু করে।
ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেনা সমর্থিত। তখন কেউ ধারণা করেনি যে দেশটিতে বিরাজনীতিকরণের একটি নতুন ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে মাত্র এবং এই ষড়যন্ত্রের প্রধান টার্গেট বাংলাদেশ আওয়ামী লিগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
এমনিতেই তো বঙ্গবন্ধুকন্যার রাজনীতিতে অভিষেক তাঁর জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। মসৃণ ছিল না তাঁর রাজনৈতিক চলার পথটিও। পায়ে পায়ে পাথর ঠেলে শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর, তা থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায়নি। ১৯৮১ থেকে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রাটি একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ বলা যাবে না, বরং কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাসে। স্বামী-সন্তান নিয়েও গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর বাবা-মা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি খুনিচক্র। তারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেয়নি। অবশেষে অনেক ঝুঁকি নিয়েই ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে ঘাতকেরা।
২০০৭ সালের মধ্য মার্চে আওয়ামী লিগ সভাপতি ও মহাজোটপ্রধান শেখ হাসিনা নিজের চোখের চিকিৎসা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী তাঁর পুত্রবধূর অসুস্থতার খবরে সেখানে যান। এরই মধ্যে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লিগসহ রাজনৈতিক দলগুলির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
গণতন্ত্র তখন রুদ্ধ। সেই চেপে বসা শাসকদের বিবেচনায় রাজনীতি তখন যেন ছিল গর্হিত অপরাধ। আর সে কারণেই রাজনীতিক পরিচয় দিতেও যেন অনেকে কুণ্ঠিত ছিলেন তখন। পাঁচ বছরের জোট অপশাসনের সুযোগ নিয়ে চেপে বসা শাসককুল তখন রীতমতো ত্রাস। রাতারাতি সব কিছু বদলে ফেলার আভাস দিয়ে রাজনীতি থেকে জঞ্জাল পরিষ্কার করার কথা তখন এমন করে বলা হত, যেন রাজনীতি এক গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল।
ওয়ান-ইলেভেন নামের পটপরিবর্তনের পর সরকার পরিচালনায় আসা তত্ত্বাবধায়ক নামের সরকারের একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দেশপ্রেমের সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রাজনীতির পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস মুছে ফেলার কী কুৎসিত, নির্মম ও ভয়াবহ চক্রান্তই না করেছিল! সংকীর্ণ রাজনৈতিক হীনম্মন্যতার ছদ্মাবরণে তাঁর ভাবমূর্তি নস্যাৎ করার কী জঘন্য চেষ্টাই না তারা করেছিল ঐ সময়। নিষ্ঠুর রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও চক্রান্তের জাল তারা বিছায় গোপনে।
২০০৭ সালের ৭ মে, স্বাভাবিকভাবেই সময়টা ছিল অন্যরকম। গণতন্ত্র আর রাজনীতির জন্য সে এক গুমোট পরিস্থিতি। তত্ত্বাবধায়ক নাম নিয়ে চেপে বসা সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটাও পরিস্কার হতে থাকে। অতীতে এ ধরনের লেবাসধারীরা যেসব কথা বলে চেয়ারে চেপে বসে, তারাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কত যে মধুর কথা শুনিয়েছিল সেই ‘চেপে বসা’ সরকার!
কী করবে তারা? রাজনীতির ক্ষেত্রে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছিল মানুষের মনে, তা কী করে হয়? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি কী করে এক লেভেলে থাকে? প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বিছায় চক্রান্তের জাল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় সংকীর্ণ হীনম্মন্যতায়। একের পর এক জারি হয় ফরমান। তখন অবস্থা ছিল এমন যেন রাজনীতি করার মতো গর্হিত কাজ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। বাংলাদেশের যত রাজনীতিবিদ, কারও কোনও নীতি নেই-এটা প্রমাণের কী যে চেষ্টা তাদের!
২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং জামায়াত-শিবিরের দায়ের করা হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। বোঝাই যাচ্ছিল শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করতেই এমনটি করা হয়েছিল।
পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনী এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ কলকাঠি নাড়ছিলেন বলে টের পাওয়া যাচ্ছিল। ওই সময় নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণের কর্মযজ্ঞ থেকে সরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্রমে দুর্নীতিবিরোধী, রাজনীতিবিরোধী, রাজনীতিতে সংস্কার আনাসহ নানা কথা বলতে শুরু করে এবং শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসতে বাধা দেওয়া হতে থাকে।
২০০৭ সালের ৭ মে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারঘোষিত জরুরি অবস্থা চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সে সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লিগ সভাপতি হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন সেজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক অবৈধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সব বিমান সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তারা যেন শেখ হাসিনাকে বহন না করে। শেখ হাসিনা একাধিকবার লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ফিরেও যান। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। যে কোনও মূল্যে তিনি দেশে ফিরবেনই।
সাহসী শেখ হাসিনা তৎকালীন সরকারের বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, সাহস ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
৭ মে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে এলে লাখো জনতা তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসা হয়। দেশে ফিরে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় শুরু করেন নতুন সংগ্রাম।
দেশটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৎপর। ঘাপটি মেরে আছে রাজনৈতিক অপশক্তিও। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির সম্মিলিত প্রয়াস। আমরা আশাবাদী হই এ কারণেই যে, আমাদের ভরসার স্থল বঙ্গবন্ধুকন্যা। আমরা জানি 'অন্ধের দেশে' অভয় দেওয়ার জন্য একজন শেখ হাসিনা আছেন, যাঁর দীপ্র কণ্ঠ আমাদের প্রাণিত করে।
দেশে আজ সেই একই ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আর এক চেপে বসা সরকারের প্রধান ড. ইউনুস নিজেই স্বীকার করেছেন, কয়েক বছর ধরে 'মেটিকুলাসলি ডিজাইন' করা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা হয়েছে। এই ইউনুস ২০০৭ সালেও সক্রিয় ছিলেন। সেই ষড়যন্ত্রও স্থায়ী হয়নি। আমরা নিশ্চিত, এবারও ষড়যন্ত্র স্থায়ী হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ৭ মের মতো আবারও বীরদর্পে দেশের মাটিতে ফিরে আসবেন।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লিগের সভাপতি এবং মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক