শেষ আপডেট: 26th March 2025 12:27
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিন ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই ওয়ারলেস ও বেতারযন্ত্রে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরে সমগ্র জাতিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান তিনি। তার আগে ৭ মার্চের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দুঃখের বিষয়, তখন এই দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। গড়ে তুলেছিল রাজাকার-আল বদর-আল শামসসহ বিভিন্ন নামের বাহিনী, যাদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসের সব বর্বরতাকে হার মানিয়ে দিয়েছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থন, ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালিদের পৌঁছে দেয় তাদের স্বপ্নের গন্তব্য-মাহেন্দ্রক্ষণ বর্ষ ১৯৭১ সালে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকরা সেই দলের নেতা, বাঙালির নয়নমণি বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুরু করে বহুমুখী ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা মহাবিক্রমে জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করে।
দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারণাস্ত্রে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তলোলুপ পিশাচেরা। নির্বিচারে তারা হত্যা করে অগণিত মানুষকে। ইতিহাসের এই বর্বরতম গণহত্যা বাঙালিদের স্তব্ধ করতে পারেনি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে ওঠে তারা।
২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার অল্প সময় আগেই তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয়ে যায় ইপিআরের ওয়্যারলেসযোগে। ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা হয়তো-বা আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আপনারা যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হওয়া এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্তু আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা।’ ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস বার্তা চট্রগ্রামে পৌঁছায়। তারপর চট্রগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন চট্রগ্রাম আওয়ামী লিগ নেতা তৎকালীন এমএনএ এম এ হান্নান। পরদিন ২৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭টায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খন্ডের দলিল, মেজর সিদ্দিক সালিকের (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর দায়িত্বে নিয়োজিত পাক সেনাবাহিনীর গণসংযোগ কর্মকর্তা) ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার এটাই প্রেক্ষাপট।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি। ২৪ বছরের একটা অহিংস, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। তারা সারা দেশে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অদম্য মনোবল আর বুকভরা সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়ায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তু বিজয়। ঐতিহাসিক এই বিজয়ের গৌরব-গাথার পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনা এবং শোকের বিস্তৃতিও পাহাড়সম। ৩০ লাখ বাঙালি শহিদ হল, দুই লাখেরও অধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারাল। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হল। নৃশংস এইসব বর্বরতাও বাঙালিদের দমাতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে সৈন্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ কে নিয়াজী। এমনি করেই শেষ পর্যন্তু অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
তিরিশ লাখ শহিদের রক্ত এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলাম। আজকের এই দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধের সব শহিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যাঁরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী সব ব্যক্তিকে। অন্যদিকে, আমরা ঘৃণা জানাচ্ছি পাকিস্তান বাহিনীকে সহযোগিতাকারী এই দেশেরই কিছু কুসন্তানকে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পরও স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দেশ চলে যায় স্বাধীনতাবিরোধীদের কব্জায়। একাত্তরের ঘাতকরা ফিরে আসে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চলে। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।
এই অপশক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গতবছর জুলাই-অগাস্টে দেশে হত্যা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও পঁচাত্তরের ঘাতক এবং তাদের দোসরদের তাবেদার মুহাম্মদ ইউনুস গং জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় চেপে বসে। তারা একাত্তরের পরাজয়ের বদলা নিতে শুরু করে।
অপশক্তির অবৈধ সরকার
পাকিস্তানিদের মাস্টারপ্ল্যান মতো বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি এক্সকাভেটর ও বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সারা দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন ধ্বংস করেছে। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলিগকে নিষিদ্ধ করেছে। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা করছে। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। এই অবদান মোছা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙ্গে ইতিহাস মোছা যাবে না। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আছে থাকবে।
স্বাধীনতা ৫৫তম বার্ষিকীতে মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সব অপশক্তিকে নির্মূল করব। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, দেশরত্ন শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে। বিশ্ব সভায় আবার মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে। দেশের মানুষের জীবনে আবার সুখ শান্তি ফিরে আসবে।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লিগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক