শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী
শেষ আপডেট: 15th September 2024 16:35
অমল সরকার
আগামী ২০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার শেষ হয়ে যাবে শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ। কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা টানা ৪৫দিন ভারতে অবস্থান করতে পারেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গত ৫ অগাস্ট ভারতে আসেন। তিনি দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকার হাসিনা-সহ বিগত সরকার এবং সাবেক শাসক দল আওয়ামী লিগের ৫৯৮ নেতা-কর্মীর পাসপোর্ট বাতিল করেছে। এরমধ্যে হাসিনা-সহ বহু নেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী, দূতাবাস কর্মীর কূটনৈতিক পাসপোর্টও আছে। ফলে এই মুহূর্তে শেষ হাসিনার কাছে কোনও কার্যকর বা সচল পাসপোর্ট নেই।
কূটনৈতির মহলে চর্চা শুরু হয়েছে, শুক্রবারের পর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ভারত সরকার। হাসিনা দিল্লির অদূরে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে সেনা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বল্প সময়ের জন্য ভারতে এসেছেন।’ সেই সঙ্গে পড়শি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাও জানান তিনি। পরদিন ৬ অগাস্ট সর্বদলীয় বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী সরকার জানায় কোন পরিস্থিতিতে হাসিনাকে ভারত সরকার আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈঠকে সব দল সরকারি সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয়।
এখন প্রশ্ন হল জয়শঙ্করের কথা মতো স্বল্পকালীন সময়ের সর্বোচ্চ সীমা হতে পারে ৪৫ দিন। হাসিনা ভারতে আসার সময় তাঁর কূটনৈতিক পাসর্পোট কার্যকর ছিল। সেই মতো ৪৫ দিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০ সেপ্টেন্বর, অর্থাৎ আর পাঁচদিন পর। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে হাসিনার বিরুদ্ধে বহু মানুষ সরব হয়েছেন। তারা দাবি তুলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে খুন, অপহরণ এবং মানবাধিকার হরণের একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত বিচারপতিও দাবি তুলেছেন, হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারত সরকারের উপরে চাপ তৈরি করুক ইউনুস প্রশাসন।
যদিও এই জাতীয় বক্তব্য হাওয়া গরম করা ছাড়া কিছু নয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী কোনও আসামীকে সরকার ফেরত চাইলেই হবে না। সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ধরনের অপরাধে কোন আদালতে মামলা চলছে, সেখানকার বিচারক শুনানির জন্য আসামিকে কোর্টে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন কি না ইত্যাদি নথিপত্র-সহ জানাতে হয়।
হাসিনার ক্ষেত্রে সেই পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। উল্টে বাংলাদেশে একাধিক নামজাদা আইনজীবী বলেছেন, হাসিনা-সহ অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা টিকবে না। শুনানির পয়লা দিনেই সেগুলি বাতিল হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হল, হাসিনাকে ফেরানোর বিষয়ে ইউনুস সরকারের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অবস্থান কী। আশ্চর্যজনকভাবে এই ব্যাপারে ইউনুস প্রশাসন এখনও চুপ। উল্টে হাসিনা এক ফোনালাপে বলেছেন, ‘দেশের কাছাকাছি আছি। যাতে টুক করে দেশে ঢুকে পড়তে পারি।’ ইউনুস প্রশাসন হাসিনার এই বক্তব্য নিয়েও চুপ। প্রধান উপদেষ্টা শুধু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ভারতে থাকাকালে শেখ হাসিনা যেন কোনও বিবৃতি না দেন।
প্রশ্ন হল ভারত কী করবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রকের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তা বলেন, কূটনৈতিক ভিসার মেয়াদ ৪৫ দিন হলেও ভারত সরকার মনে করলে হাসিনা যতদিন চাইবেন, ততদিন আশ্রয় দিতে পারে। এই ব্যাপারে আইন কোনও বাধা নয়। এটা সম্পূর্ণভাবে ভারত সরকারের বিষয়।
ওই কর্তা আরও বলেন, বন্দি প্রত্যপর্ণ চুক্তি থাকলেও কাকে হস্তান্তর করা হবে আর কাকে করা হবে না, সেই ব্যাপারেও আশ্রয়দাতা দেশই শেষ কথা বলবে। চুক্তি এই ক্ষেত্রে শেষ কথা নয়। হাসিনা কোনও দাগি আসামি নন। তিনি পাঁচবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলা হচ্ছে, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার নয়। হাসিনাকে ফেরালে তিনি দেশে গিয়ে বিপদে পড়বেন না, প্রাণহাণির আশঙ্কা থাকবে না, এই সব বিষয়ে একশো ভাগ নিশ্চিত হলে তবেই ভারত সরকার ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেবে না। অবশ্যই এই ব্যাপারে আওয়ামী লিগ নেত্রীর বক্তব্যও গুরুত্ব পাবে।
তাহলে কি ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চলেছে? কূটনৈতিক মহলের বড় অংশ মনে করে পরিস্থিতি সেই দিকেই গড়াচ্ছে, যদি না ২০ তারিখের আগে তৃতীয় কোনও দেশে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপদে থাকা নিশ্চিত করা যায়। একটি মহলের খবর, কাতার সরকারের সঙ্গে হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহল এবং নয়াদিল্লির কথা চলছে। কাতারের বর্তমান শাসকদের সঙ্গে হাসিনার ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে।
তবে নয়াদিল্লি গোটা বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে আগের মতোই সচল সম্পর্ক রেখে চলতে আগ্রহী ভারত, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে দেশের প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসকে কথা দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার দু-দেশের সম্পর্কের প্রশ্নে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুতে ভবিষ্যতে আপত্তি করতে পারে ধরে নিয়ে তৃতীয় দেশে আশ্রয়ের বিষয়ে ভারত দরজা খোলা রাখছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ভারত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দেওয়ায় তা দু-দেশের সম্পর্কে কোনও ছাপ ফেলবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রকের কর্তারা একান্তে বলছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এই ইস্যুতে দেশের সব দল কেন্দ্রের পাশে আছে। মোদী সরকার রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে কোনও দলই আপত্তি তুলবে না। অতীতে দলাই লামা এবং আরও অনেকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান নিয়েছিল সরকার এবং সব দল। দলাই লামা ছাড়াও নেপালের প্রয়াত রাজা ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ এবং আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লাহকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। এমনকী হাসিনাও অতীতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছয় বছর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন।
তৃতীয় কোনও দেশে শেখ হাসিনার আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে কোনও কোনও মহল থেকে আইনি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভারত সরকার চাইলেও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তৃতীয় কোনও দেশে পাঠাতে পারবে না। কোনও দেশ রাজি হলেও তা সম্ভব নয়। কারণ, হাসিনার কোনও পাসপোর্ট নেই।
যদিও এই সমস্যাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না নয়াদিল্লি। পররাষ্ট্রমন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ভারতে বসবাসীকারী তিব্বতীরা বেশিরভাগই এ দেশের নাগরিকত্ব নেননি। তাঁদের কোনও দেশেরই পাসপোর্ট নেই। তবু তারা গোটা পৃথিবী ছুটে বেড়াচ্ছেন তীব্বতের উপর চিনের আগ্রাসনের কথা প্রচার করতে। ওই কর্তা বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ভারত সরকারের ট্রাভেল ডকুমেন্টসই যথেষ্ট। হাসিনা আপাতত ভারতে থেকে গেলে এখান থেকেই তিনি অন্য কোনও দেশে যেতে পারবেন। পাসপোর্ট থাকা বা না থাকাটা কোনও সমস্যা হবে না।