শেষ আপডেট: 6th March 2025 10:22
‘যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে সব তৈরি হও। মাঠে নামতে হবে।—দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে লাগাতার এই কথাগুলি বলছেন শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)।
প্রায় রোজই দলের লোকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছে তাঁর। রমজান (Ramzan) মাস শুরুর পরও রুটিনের বদল হয়নি। প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি রোজা রাখছেন। সারা দিন রোজা পালন করে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন গ্রুপে নেতা-কর্মীদের দুর্দশার কাহিনি শুনছেন। ভাষণ দিচ্ছেন।
দেশের চলতি পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর ভাষণের নির্যাস হল, ‘দেশে অরাজকতা (Anarchy) চলছে। বিশৃঙ্খলতা চলছে। মানবাধিকার হরণ (Human Rights violation) করা হচ্ছে। দেশকে এই ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের (Bangladesh) মানুষ যাতে মুক্তি পায়, রেহাই পায়, শান্তি ফিরে আসে আমরা সেটা করব। তার আগে এই জঙ্গি সরকারের (Militant government) হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে। ইউনুস সরকারের পতন ঘটাতে হবে।’ তার জন্য…..।
দলনেত্রীর ভাষণের এই অংশটুকু নিয়ে আওয়ামী লিগের (Awami league) নেতা-কর্মীদের অনেকেরই শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১-এর ৭ মার্চের (Mujib’s historic speech of 7th March, 1971) ভাষণের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাত পোহালেই মুজিবের সেই ভাষণের ৫৪ তম বার্ষিকী, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো (Unesco) যে ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ (World documentary heritage) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ঢাকার রেসকোর্স (Dhaka racecourse field) ময়দানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণে মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই ভাষণের উনিশ দিনের মাথায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করে সেই ভূখণ্ডকে পাকিস্তানি সেনা মুক্ত করার ডাক দেন। তারবার্তায় বলেছিলেন, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
লক্ষণীয় হল, ৭ এবং ২৬ মার্চ, দুই ভাষণেই শেখ মুজিবুর রহমান ‘যার যা কিছু আছে’ কথাটি বলেছেন। তাঁর কন্যা তথা আওয়ামী লিগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর ডাক দিতে গিয়ে বাবার ঐতিহাসিক ভাষণকে আশ্রয় করেছেন বলে পার্টির অনেকের মনে হয়েছে। তিনিও নিয়ম করে প্রতিটি ভাষণে ‘যে যেখানে আছো, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত’ থাকতে বলেছেন। নেতারা জানাচ্ছেন, তাৎপর্যপূর্ণ হল, নেত্রীর এই কথায় নেতা-কর্মীদের অনেকে লড়াইয়ের ময়দানে জীবন দেওয়ার অঙ্গীকার করছেন। তাঁরা বলছেন, ‘আপনাকে দেশে ফেরাতে যা করতে হয় করব। প্রয়োজনে জীবন দেব।’ কেউ বলছেন, ‘মাননীয় নেত্রী, আপনাকে এই স্বাধীনতার মাস মার্চেই দেশে ফিরিয়ে আনব।’
নিয়মিত শেখ হাসিনার ভাষণ শুনছেন এমন অনেক নেতাই জানাচ্ছেন, নেত্রীর ভাষণের ওই লাইনগুলি দলের অনেকেরই কানে বেজেছে। দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের কারও কারও মনে হয়েছে, নেত্রী বড় কোনও কর্মসূচির জন্য তাদের প্রস্তুত থাকার ডাক দিচ্ছেন। কারও কারও মনে হয়েছে, দল পাল্টা অভ্যুত্থানের ডাক দিতে পারে। যেভাবে ১৯৭১-এ ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। হাসিনার সভায় যারা প্রাণ দেওয়ার অঙ্গীকার করছেন তারা নিজেদের ‘মুজিব ব্রিগেড’-এর সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছেন। হাসিনা যে গ্রুপগুলিতে কথা বলছেন, সেগুলির নাম ‘ধানমন্ডি-৩২’ কিংবা ‘৩২- ধানমন্ডি’, ‘সংগ্রামী-৭১’ ইত্যাদি।
হাসিনার ভাষণের খুঁটিনাটি সরকারের নজরে এসেছে। দলকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে তাঁর সরকার যে চিন্তিত তা গোপন করছেন না প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশের হুমকি আওয়ামী লিগ থেকেই কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই। এটাতো অবভিয়াস। তারা (পড়ুন হাসিনা ও আওয়ামী লিগ নেতৃত্ব) মাঝে মাঝেই ঘোষণা করছে। বক্তৃতা দিচ্ছে। এড্রেস করছে। আপনি-আমরা সবাই শুনছি। মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে।’ আওয়ামী লিগের থেকে হুমকি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ‘এই যে এড্রেস করছে। জাগো, কাজে নামো ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক আহ্বান জানাচ্ছে, কর্মসূচি দিচ্ছে, হরতাল করো, অমুক করো। মানুষ কীভাবে নেবে এটাকে বলেন? মিষ্টি মুখে চলে যাবে সব?’
গত বছর পর্যন্ত ৭ মার্চ দিনটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছিল বাংলাদেশে। মহম্মদ ইউনুসের সরকার ৭ মার্চের ছুটি বাতিল করেছে। ১৫ অগাস্ট অর্থাৎ মুজিব হত্যার দিনটি শোক দিবস হিসাবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তও বাতিল করেছে বর্তমান সরকার।
অনেকেই মনে করেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ ছিল আনুষ্ঠানিক বার্তা। আগের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চের সন্ধ্যাতেই বলে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী অত্যাচার শুরুর মুহূর্ত থেকে আমরা স্বাধীন। ওই দিন রাতে ঢাকা-সহ বেশ কিছু শহরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে পাকিস্তানি সেনা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজার পঁচিশ মানুষকে খুন করে তারা। সেই রাতেই ধানমন্ডির বাড়ি থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে বন্দি করে রাখে পাকিস্তান সরকার।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লিগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন হাসিনা। আগের দিন তিনি ভাষণ দেন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগের ফেসুবক পেজে। গত বছর ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার পর সেটাই ছিল দেশের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ। সে জন্য বেছে নেন ইউনুস সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ছাত্র লিগের ফেসবুক পেজ। শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি ইউনুস সরকারের নির্দেশে গত বছর অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
৫ তারিখের ওই ভাষণ শুরুর আগেই ঢাকা-সহ বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় আওয়ামী লিগ বিরোধীদের তাণ্ডব। ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর বুলডোজার দিয়ে সেটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লিগ সুত্রের খবর, ওই দিন আওয়ামী লিগের বিভিন্ন গ্রুপে নেতা-কর্মীরা ঢাকা অভিযানের অনুমতি চান। বড় সংঘর্ষের আশঙ্কায় হাসিনা অনুমতি দেননি। বলেন, ধৈর্য ধরো। এর জবাব আমরা দেব। পরে একটি গ্রুপের আলোচনায় বলেন, ‘যারা ধানমন্ডি বত্রিশের গায়ে লাথি মেরেছে, ভেঙেছে, পুড়িয়েছে, তাদের বিচার করব। এমন শাস্তি ওরা পাবে যেন আজীবন মনে রাখে কোন বাড়িতে ওরা হাত দিয়েছে।’
৫ ফেব্রুয়ারির ভাষণের আগে থেকেই বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা এবং ৪৯৫টি উপজেলার আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে পৃথক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছেন হাসিনা। তবে সেখানে বলছেন কম, শুনছেন বেশি। নেতারা বলছেন, যারা বলছেন, বিগত ১৫-১৬ বছর নেত্রী গণভবনে আরামে কাটিয়েছেন, নেতা-কর্মীদের কথা শোনেননি তাদের ধারণা বদলে যাবে এই সব গ্রুপের বক্তব্য শুনলে। তিনি যে দেশটিকে হাতের তালুর মতো চেনেন তাঁর কথায় তা স্পষ্ট। কেউ ঠিকানা বলা মাত্র হাসিনা বলছেন, তোমার বাড়িকি কলেজের পাশে, যেখানে শহিদ বেদি আছে। কেউ নাম-ঠিকানা বলে হয়তো বলেছেন, আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা। হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, তুমি কি ওমুকের মেয়ে? বঙ্গবন্ধু যাঁকে খুব স্নেহ করতেন! গণঅভ্যুত্থানে স্বামীহারা কারও পরিচয় শুনে বলছেন, ‘আর বলতে হবে না। তোমাকে চিনি, তোমার স্বামীকেও খুব ভাল চিনতাম। তোমার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে বলো। মন শক্তি করো। ভেঙে পড়লে চলবে না। ওদের মানুষ করতে হবে।’
নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে জানাচ্ছেন, অত্যাচার, অনাচারের কথা। তিনি সবাইকেই ধৈর্য ধরতে বলছেন। বলছেন, ‘সুদিন ফিরবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।’ বলাইবাহুল্য, গ্রুপ অ্যাডমিনদের বাছাই করা নেতা-কর্মী কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে। বাকিরা নেত্রীর সঙ্গে কথা বলতে, তাঁকে সালাম জানাতে অ্যাডমিনদের কাকুতি-মিনতি করছেন। কেউ বলছেন, এক মিনিট চাই না। তিরিশ সেকেন্ড বলতে দিলেই হবে। জীবনে কী আর এই সুযোগ পাব। নেত্রীরে একবার সামাল জানাইতে দেন।
গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে অর্থাৎ গণ অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার তিন মাসের মাথায় হাসিনা দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভার্চুয়াল সভায় ভাষণ দেওয়া শুরু করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়ামের আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারপর দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন। আওয়ামী লিগের ফেসবুক পেজের ‘দায়মুক্তি’ অনুষ্ঠানেও বেশ কয়েকবার যোগ দিয়েছেন। ছোট ছোট গ্রুপের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন আরও আগে থেকে। দিল্লি থেকে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মানিক মিঁঞা, মোবারক আলি, রুবিনা খাতুন, সবিতা দাসদের সঙ্গে কথা বলছেন শেখ হাসিনা। মুজিব কন্যা তাঁদের বলছেন, ‘তৈরি হও। জোট বাঁধো।’ তাঁরা বলছেন, ‘আপা, জীবন দেব, তবু হার মানব না। আপনি একবার শুধু বলেন কী করতে হবে।’