তথ্যচিত্র ‘অবিনশ্বর’-এর একটি দৃশ্য।
শেষ আপডেট: 26th February 2024 16:07
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ১৯৭১-এর ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার বাড়ি থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর পুত্র দিলীপকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাক সেনা বাহিনী। এর চারদিন আগে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় দশ হাজার মানুষকে খুন করে সেনারা। সেই রাতেই পূর্ব পাকিস্তানকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণা করে সেনার হাতে বন্দি হন শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকার অদূরে মেঘনার অপারে কুমিল্লায় স্বাধীনতার সেই ঘোষণা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিছিলেন বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ ও তাঁর ছেলে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলতে সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। চারদিনের মাথায় অপারেশন সার্চলাইটে নিহতের তালিকায় যুক্ত হয় বাবা ও ছেলের নাম। তবে মেরে ফেলার কথা স্বীকার করলেও দেহ পরিবারের হাতে দিতে অস্বীকার করে সেনা।
৫৩ বছর পর সেই ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনার সূত্রপাত হওয়ার কারণ, সে দেশের অনেকেই মনে করছেন, এই শহিদ যোগ্য মর্যাদা পাননি। ভুল শুধরে তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছেন দেশের নানা অংশের মানুষ।
বেশিরভাগের দাবি, কুমিল্লায় ধীরেন্দ্রনাথের পৈত্রিক ভিটাটি অবিলম্বে সরকার অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক। সোমবার সে দেশের জনপ্রিয় গায়ক তথা গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ ঘোষণা করেছেন তিনি কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ‘বাংলাদেশ’ সঙ্গীত সিরিজে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে গান গাইবেন। এর আগে রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক এবং সমাজের কৃতিজনদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ সিরিজে গান গেয়েছেন তিনি। এই সিরিজে গানের কথায় ঘুরে ফিরে আসে দেশের নাম। প্রিন্সের কথায়, ‘শহিদ ধীরেন্দ্রনাথের কথা আজকের প্রজন্ম তেমন জানে না। তাদের কাছে তুলে ধরতে চাই তাঁর অবদান।’ তিনি জানান, ৩৫জন শিল্পীর দল গাইবেন ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা গানটি।
আগামী বৃহস্পতিবার রিলিজ হতে যাচ্ছে ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি তথ্যটিত্র অবিনশ্বর। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুদানে ফাখরুল আরেফিন খানের পরিচালনায় ও গড়াই ফিল্মসের প্রযোজনায় এই তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর মাত্র চারদিনের মাথায় সেনার হাতে নিহত ধীরেন্দ্রনাথ দেশকে পাক সেনার কবল মুক্ত করার লড়াইয়ে অবদান রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পিছনে বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াইয়ের যে চেতনা কাজ করেছিল তাতে এই বাঙালির অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনিই প্রথম বাঙালি রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধি যিনি করাচিতে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে প্রথম দাবি তুলেছিলেন, সংসদ ও সরকারের কাজকর্ম শুধু ইংরিজি আর উর্দুতে করা চলবে না। বাংলাতেও করতে হবে। কারণ, দেশের ৫৬ শতাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলা।
ভাষা আন্দোলনের গবেষক ও শিক্ষকেরা মনে করেন ১৯৪৮-এর ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন দাবি উত্থাপন রীতিমতো সাহসিকতার পরিচয় ছিল। বাঙালি নেতার ওই ভাষণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। ক’দিন পরেই জেলে পুরে দেওয়া হয় ধীরেন্দ্রনাথকে। জেল থেকে বেরিয়ে ফের বাংলায় সরকারি ও সংসদের কাজকর্ম করার দাবি তুললে পুনরায় জেলে যেতে হয় তাঁকে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি দেশের পশ্চিমা শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাতৃভাষার জন্য বারে বারে কারাবরণ করেন।
সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কুমিল্লার পৈত্রিক বাড়িটির এখন ভগ্ন দশা। ওই বাড়ি থেকেই পাক সেনা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। দেহ লোপাট করার কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করেন, ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে শোক মিছিল গণবিক্ষোভের চেহারা নিতে পারে আঁচ করেই পাক সামরিক প্রশাসন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কুমিল্লাবাসী গবেষক ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহসানুল কবীর সম্প্রতি সে দেশের সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ধীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি শুধু কুমিল্লা নয়, গোটা দেশের অহংকারের জায়গা। জরাজীর্ণ বাড়িটি তাই দ্রুত সংস্কার জরুরি। এ জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব আইনজীবী নাজমুল বারি জানান, বাড়িটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন। উত্তরের অপক্ষোয় আছেন। তাঁদের দাবি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদানকে স্মরণে রেখে কুমিল্লায় একটি ভাষা জাদুঘর নির্মাণ করা হোক। বাড়িটি সংস্কারে তাঁর সদিচ্ছার কথা জানিয়েছেন কুমিল্লার মেয়র হাবিবুর আল আমিন সাদিও। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা স্টেডিয়ামের সদর গেটটি শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে করা হয়েছে। শহিদের পরিবার প্রস্তাব পাঠালে আশাকরি সংস্কৃতি মন্ত্রক বাড়িটি সংস্কার করে দেবে।’ তিনি জানান, এই নিয়ম মেনেই কুমিল্লার সন্তান বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে।
মারা যাওয়ার ৫৩ বছর পর কেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র স্মৃতি রক্ষা নিয়ে বহু মানুষ এখন উদ্যোগী হয়েছেন? জানা যাচ্ছে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বহু মানুষ ধীরেন্দ্রনাথের জরাজীর্ণ পৈত্রিক বাড়িটির ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে সরকারের উদ্দেশে দাবি করেন, সেটি সংরক্ষণ করা হোক। তারপর থেকে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে বিস্মৃত এই শহিদকে নিয়ে। গায়ক সুরকার প্রিন্স জানিয়েছেন, তিনি চাইছেন ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা দিবসে ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা গানটি প্রকাশ করতে।