শেষ আপডেট: 21st October 2024 14:22
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ সাহাবুদ্দিনের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সে দেশে নতুন করে জলঘোলা শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার বিদায় নিয়ে। জল্পনা শুরু হয়েছে, তাহলে কি গণ-অভ্যুত্থান নয়, সেনার অভ্যুত্থান তথা রক্তপাতহীন ‘ক্যু’-র কারণে হাসিনাকে সরে যেতে হয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারলে সেনা প্রধান দেশের দায়িত্বভার নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন। তিনি দশ দিনের সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। জল্পনা শুরু হয়েছে তিনি দেশে ফেরার পর তাঁকে এবং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলতে পারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাঁদের দাবি, সৈরাচারী শাসক হাসিনার জমানার কোনও পদাধিকারীকে পদে রাখা যাবে না।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন হাসিনার জমানায় দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি একটা সময় আওয়ামী লিগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। দুই সমন্বয় আবুল হাসনাত ও সারজিস আলম তাঁকে অপসারণের দাবি আগেই তুলেছেন। অন্যদিকে, সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকেও নিয়োগ করেন হাসিনা। তিনি হাসিনাকে উৎখাতে সহযোগিতা করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের আঠারো মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব এবং মহম্মদ ইউনুস সেনা প্রধানের উপর রুষ্ট বলে জানা গিয়েছে।
হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে নতুন করে জলঘোলা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সংবাদপত্র মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের সাক্ষাৎকার ঘিরে। সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র আমি অনেক খুঁজেছি। কেউ দেখাতে পারেননি। আমি মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে কপি চেয়েছিলাম। উল্টে তিনি আমার অফিসে এসে একদিন শেখ হাসিনার পদত্যাগ পত্রের কপি খোঁজ করেন।’ প্রসঙ্গত, দেশ ছাড়ার ক’দিন পরেই এক টেলিফোন সংলাপে হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি পদত্যাগ করিনি। চ্যালেঞ্জ করছি, অন্তর্বর্তী সরকার আমার পদত্যাগপত্র দেখাক।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আরও বলেছেন, ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি তাঁকেও বলি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র কই। সেনা প্রধান বলেন, তাঁর কাছে নেই। তিনিও পদত্যাগপত্রের কপি দেখেননি।
যদিও ৫ অগাস্ট বিকালে সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন।’ তিনিই পরে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি সেনা নিবাসে বৈঠক করার সময় এক অধস্তন অফিসার এসে জানান, প্রধানমন্ত্রী ভারতে চলে গিয়েছেন। যদিও সেনা বিমানেই দেশ ছাড়েন হাসিনা, যা সেনা প্রধানের না জানার কথা নয়।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতির ৫ অগাস্টের কথার সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎকারের বক্তব্যের মিল নেই। ৫ অগাস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। আমি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি।’
প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রপতি যদিও পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তাঁর কাছে কপি নেই কেন? বাংলাদেশ সচিবালয়ের নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অফিসেই পদত্যাগপত্র থাকার কথা। কপি থাকার কথা মন্ত্রি পরিষদ সচিবের কাছে। কিন্তু কারও কাছেই পদত্যাগপত্র নেই।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি সেনা বা অদৃশ্য কোনও চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন সেদিন হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা বলেছিলেন? হাসিনাকে হটানোও কি ছিল সেনা বাহিনীর পরিকল্পিত রক্তপাতহীন ক্যু?
আগেই জানা গিয়েছিল ঢাকায় আসা বিক্ষোভকারীদের বলপ্রয়োগ করে সরিয়ে দিতে হাসিনার নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছিল সেনা। সেনার চাপে তাতে সায় দেয় পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও। পরে আরও জানা যায়, ছাত্র-জনতাকে আটকাকে পুলিশ ঢাকার প্রবেশ পথে যে সব ব্যরিকেড তৈরি করেছিল ৫ অগাস্ট সকালে সেনার নির্দেশে সেগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পিল পিল করে মানুষ রাজধানীর রাজপথের দখল নেয়।
সাংবাদিক মতিয়ুর রহমান চৌধুরী হাসিনা সরকারের কট্টোর সমালোচক ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিস গণভবনে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল না। অভিযোগ কোটা আন্দোলন নিয়ে তাঁর লেখালেখি এবং টিভি অনুষ্ঠানে বক্তব্যের কারণে পুলিশ তাঁকে দেশ ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, হয়ে বিদেশে যান, নয়তো জেলে যাবেন। প্রবীণ ওই সাংবাদিক দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। হাসিনা সরকার বিদায় নিলে তিনি দেশে ফেরেন।
প্রবীণ ওই সাংবাদিক তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, গত পনেরো দিন ধরে আমি হাসিনার পত্যাগপত্রের খোঁজ করেছি। সরকারি অফিস, সেনা সদরের দ্বারস্থ হয়ে না পেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলাম। তিনিও বলেন, পদত্যাগপত্র তিনি চোখে দেখেননি। রাষ্ট্রপতি ওই সাংবাদিককে জানিয়েছেন, ৫ অগাস্ট সকালে তাঁর অফিসকে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দেখা করতে আসছেন। এক ঘণ্টা পর জানানো হয় তিনি আসছেন না। আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। আমি টিভির খবর থেকে জেনেছি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
মতিয়ুর রহমানের প্রতিবেদন অনুযায়ী হাসিনাকে একপ্রকার চাপের মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। ভাষণের খসড়া তৈরি ছিল। তাতে লিখেছিলেন, চাপের মুখে দেশ ছাড়ছি। সেই সঙ্গে দেশের জন্য তাঁর অবদানের বিবরণ ছিল। কিন্তু ভাষণ রেকর্ড করতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সামনে দাঁড়িয়ে পদত্যাগপত্র সই করে তাঁর হাতে দেওয়ার কথা। হাসিনাকে সেই সুযোগও দেওয়া হয়নি। প্রতিবারই সেনা কর্তারা বলেন, তাড়াতাড়ি করুন, গণভবনের দুয়ারে বিক্ষোভকারীরা চলে এসেছে। যে কোনও সময় ঢুকে পড়বে।