ইউনুসকে ঘিরে হাসিনাকে হটানো সমন্বয়কেরা
শেষ আপডেট: 19th October 2024 15:19
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কেউ বলছেন, ‘সরকার সীমান্ত খুলে দিলে কালই দেশ ছাড়ব। এ দেশে নইলে না খেয়ে মরতে হবে।’ কারও কথায়, ‘সপরিবারে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই।’ অশীতিপর বৃদ্ধ টিভি ক্যামেরার সামনে হাউ হাউ করে কেঁদে বলছেন, ‘৫ অগাস্টের আগে গুলি খাইয়া মইরা গেলেই ভাল ছিল। আল্লাহ, আমাগো বাঁচায়ে রাইখা এ তোমার কেমন বিচার। এর নাম বাঁচা!’ কেউ রসিকতার সুরে কঠোর বাস্তব তুলে ধরতে বলেছেন, ‘ছোটবেলায় মা একটা ডিম পাঁচ ভাগ করে আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের পাতে দিতেন। সরকারকে ধন্যবাদ ছেলেবেলা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’
বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে গিয়েছে এমন সব মন্তব্যে। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বহু মানুষ এখন টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই বলতে শুরু করেছেন, ‘সরকারের মুখে শুধু সংস্কার আর সংস্কার। এদিকে আমাদের সংসার চলছে না। এর থেকে হাসিনাই ভাল ছিল।’ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে সপরিবারে অংশ নেওয়া এক মহিলা টিভি ক্যামেরার সামনে বলেছেন, ‘একবেলা খাব, আরেকবেলা না খেয়ে থাকব? এজন্য নতুন সরকার আনছি আমরা?
সবে আড়াই মাস হয়েছে গণ অভ্যত্থানের মুখে দেশ ছেড়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আদালতে পেশ করার তোড়জোড় শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনা-সহ আওয়ামী লিগের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও আড়াই মাসেই গণ-অভ্যুত্থানের উন্মাদনা উধাও। মানুষ পাল্টা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে, হাসিনাকে হটিয়ে লাভটা কী হল। আওয়ামী লিগ তাই প্রচার শুরু করেছে মহম্মদ ইউনুসের সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশে এনে জেলে পুরতে চাইছে। আর বাংলাদেশের মানুষ চাইছে তিনি ফের দেশের হাল ধরুক।
শুধু শেখ হাসিনার দলই নয়, গণ অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাশে থাকা সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী থেকে জনপ্রিয় ইউটিউবারদেরও অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, হাসিনাকে সরিয়ে লাভ হয়নি, বরং খারাপই হয়েছে। কোনও কোনও সাংবাদিক, ইউটিউবার তাঁদের আড়াই মাস আগের ভূমিকার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাহসী ভূমিকা নিয়ে বাকিদের চোখে ‘অগ্নিকন্যা’ হয়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সনজিদা চৌধুরী একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, ‘এখন দেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা ঠিকই বলতেন যে, ছেলেমেয়েদের ভুল বুঝিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নামানো হয়েছে। কতগুলি তাজা প্রাণ অকালে ঝড়ে গেল। আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি।’
জনক্ষোভের মূলে আছে দুটি বিষয়, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য এবং অস্থির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ঢাকায় শাক-সবজি, মাছ-মাংসের সবচেয়ে বড় বাজার কাওরান বাজারে বাজার করার ফাঁকে মাঝবয়সি এক মহিলা টেলিভিশন সাংবাদিককে বলেছেন, ‘বাজারে সত্যিকারের আগুন লাগলে আমরাই জল ঢেলে নিভিয়ে দিতে পারতাম। দামের আগুন তো সরকার ছাড়া কেউ নেভাতে পারবে না। দেশে সরকার আছে কি?’ পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন বোঝাতে এক সবজি বিক্রেতা বলেছেন, বছর তিরিশ হল হল সবজি বেচছি। কখনও একশো গ্রাম পটল, একশো গ্রাম বেগুন, পঁচিশ গ্রাম কাঁচা মরিচ বেচিনি। মানুষ নিরুপায়।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ে এমন জন-অসম্তোষের খণ্ডচিত্রের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে, টিভি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীর মতো বড় বড় শহরে দিনের বেলা চাকু, পিস্তল ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের ছড়াছড়ি।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস এবং তাঁর উপদেষ্টারা বাজার দর এবং চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে তেমন মুখ না খুললেও জনক্ষোভ আঁচ করে প্রকাশ্যে সরব হয়েছেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছয় সমন্বয়কের দু’জন, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম। হাসনাত শুক্রবার রাতে ঢাকায় এক সভায় বলেছেন, ‘চারদিকে লোকেরা বলতে শুরু করেছে, হাসিনাই ভাল ছিল। মানুষ একথা বলছে কারণ অন্তর্বর্তী সরকার তাদের আশু চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।’ তরুণ এই সমন্বয়কের কথায়, ‘বাজারে কোনও সবজি একশো টাকার নিচে নেই। আরা খাব কী?’ এরপরই তাঁর সংযোজন, ‘এমন পরিস্থিতির জন্য বিপ্লবের পর প্রতি-বিপ্লব হয়ে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আপনাদের বিরুদ্ধেও মানুষ মাঠে নামতে দেরি করবে না। সাবধান হয়ে যান।’
আর এক সমন্বয়ক সারজিস তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সরাসরি বলেছেন, ‘সরকার ঢিমে থালে চলছে।’ তিনি আলাদা করে নিশানা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রককে। পুলিশের গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর সুপারিশ করেছেন ঢাকার চিকিৎসকেরা। ইউনুসের ঘোষণা অনুযায়ী বিদেশে চিকিৎসার খবরও সরকার বহন করবে। সারজিস আলমের অভিযোগ, আড়াই মাসে একটা ফাইলও নড়েনি। সরকারকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা না পারলে সরে যান। আমাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিন।’ প্রসঙ্গত, ছয় প্রধান সমন্বয়কের দু’জন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই মনে করছেন, ছাত্র উপদেষ্টারা উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
শুধু সারজিস ও হাসনাতই নন, জেলা সমন্বয়কেরাও অনেকেই এখন পিঠ বাঁচাতে ইউনুসের মুণ্ডপাত শুরু করেছেন। পথেঘাটে তাঁদের জনক্ষোভের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সমন্বয়কেরাও করছেন, আশু কাজ ফেলে ইউনুস সরকার দীর্ঘ মেয়াদের কর্মসূচি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সরকারের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, রোজকার খাওয়াপরার থেকেও শাসন ব্যবস্থার সংস্কার বেশি জরুরি।