মহম্মদ ইউনুস
শেষ আপডেট: 24th March 2025 14:23
সৈয়দ ইফতেখার হোসেন
গত বছর অগাস্টে বাংলাদেশের দীর্ঘতম ক্ষমতাসীন নির্বাচিত আওয়ামী লিগ সরকারের পতনের জন্য সূক্ষ্ম পরিকল্পনা এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল ভূমিকা ছিল, তার কালো বিড়াল অবশেষে ঝুলি থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে বর্ণনা করেছেন কীভাবে তাঁর পূর্বসুরি জো বাইডেনের সরকার বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করেছেন। বাইডেন তাঁর সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডোনাল্ড লুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁকে এই কাজে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তাঁদের সঙ্গে ছিল এই দেশের ডজনখানেক এনজিও, যাদের কর্মকর্তারা বর্তমানে ইউনুস সরকারের উপদেষ্টা পদে রয়েছেন। তাঁরা শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের সর্বশেষ সভাটি করেছিলেন ২০২৪ সালের মে মাসে ঢাকায়। সে সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ছয়টি এনজিওর সিনিয়র কর্মকর্তা, যার মধ্যে গ্রামীণের ফারহানা ইসলাম ও জেনল্যাবের ইশরাত রউফ অন্যতম।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী করার জন্য দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে পাচার করেছিল। তিনি এও ঘোষণা করেছেন সব মিলিয়ে এই কাজে বাংলাদেশে ৫০ মিলিয়র ডলার প্রবেশ করেছিল। তাঁর মতে এই বিশাল পরিমাণের অর্থ মূলত বাংলাদেশের দুটি এনজিওর মাধ্যমে বিভিন্ন সরকার বিরোধী কাজে ব্যয় করা হয়েছিল।
ট্রাম্প নাম না বললেও এখন জানা যায় এই দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বদিউল আলম মজুমদারের ‘সুজন’ এবং ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের ‘বেলা’। এই অর্থ বাংলাদেশে বিলিবণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ইউএসএআইডি, এনডিআই ও আইআরআই।
নির্বাচিত শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। পরে ষড়যন্ত্রকারীরা ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাঁকে বলে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হয়ে গেলে তাঁকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হতে পারে। এই কথাগুলো একাধিক ষড়যন্ত্রকারি প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলেছেন। অথচ ইউনুস প্রায়শ বলে থাকেন ৫ আগস্টের আগে তিনি কিছু জানতেনই না।
ইউনূস বেশ ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যা কথা বলতে পারদর্শি। তিনিই ওয়াশিংটনে গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে তাঁর বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলমকে সবার সামনে পরিচয় করে দেন এই বলে যে, ‘এই সেই তরুণ যে দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত সুচারুভাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করার পরিকল্পনা করেছিল। কোনও কিছুই হঠাৎ করে হয়নি।’
যদিও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ছাত্র আন্দোলন মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত হয়, তবে জাতিসংঘ এর চূড়ান্ত সাফল্যে আরও নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে বলে এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ভলকার টুর্ক বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিস্কার করে দিয়েছেন। এই ব্যক্তিকে ইউনুস নিজ উদ্যোগে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর ভাষায় ‘জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীদের শেখ হাসিনা কত নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়েছেন তা অনুসন্ধান করার জন্য। টুর্ক বাংলাদেশে আসেন, ইউনুসের নির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, তাঁর কাজে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাননি। এটি ছিল টুর্কের একটা চালাকি, যাতে তিনি জনগণকে বোঝাতে পারেন তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছেন। আওয়ামী লিগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য একটি বিদেশি গণমাধ্যমে বলেন, তিনি টুর্কের সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে চিঠি দিয়ে বিফল হয়েছেন।
টুর্ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী জড়িত হলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে। অথচ বাংলাদেশে দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা করার কাজে বেসামরিক প্রশাসনকে সহয়তা করা দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব।
আর্থিক কারণে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী বর্তমানে অনেকটা ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা তাদের কাছে এখন গৌণ। সরকারের অজান্তে এই বাহিনীতে সহজে ঢুকে পড়েছে একটি বিরাট বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি। এদের কাছে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের চেয়ে জাতিসংঘের মিশনে গিয়ে কিছু অর্থ কামানো বা অন্যেও হয়ে দেশবিরোধী কাজ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধারণা মিশনে কাজ করলে বাহিনীর জন্য পেশাদার মর্যাদা এনে দেয় যা মোটেও সত্য নয়।
সেনাপ্রধান ওয়াকারউজ্জামান সেদিন আরও একটু দায়িত্বশীল হলে আজ বাংলাদেশ একটি অবৈধ সরকারের দুঃশাসনের ফলে ধ্বংসের যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে তা হয়তো রোধ করা যেত। অবশ্য এরই মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভলকার টুর্কের বক্তব্যকে অস্বীকার করেছে। তাহলে তো সরকারের উচিৎ বিষয়টা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে প্রতিবাদ করা।
যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেই তারাই অশান্তি সৃষ্টিতে নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছিল ১৯৭২ সালে সংস্থার চতুর্থ মহাসচিব হিসেবে হিটলারের নাৎসি পার্টির সদস্য অষ্ট্রিয় নাগরিক কুর্ট ওয়াল্ডহ্যামের নিয়োগ। ভলকার টুর্কও অষ্ট্রিয়ার নাগরিক। ওয়াল্ডহ্যাম শুধু নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন তাই নয় তিনি ইহুদি বন্দি শিবিরের পাহারাদারও ছিলেন। এইসব তথ্য তিনি বেমালুম চেপে দুইবার বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব হয়েছিলেন।
ভলগার টুর্ক বাংলাদেশকে নিয়ে যে কুৎসিৎ খেলায় মেতেছিলেন তা শুধু একটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরই আঘাত করার সামিল নয় তিনি জাতিসংঘের সনদের একাধিক ধারা লঙ্ঘন করেছেন। সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কাজ হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে কোনো একটি ঘটনার সত্যতা যাচাই করা, কোনও দেশকে হুমকি দেওয়া নয়। আর শান্তি রক্ষা মিশনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ রূপে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিচার্য।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত।