সোমবার থেকে বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র।
শেষ আপডেট: 20th January 2025 21:22
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় তিন নম্বরে আছে বাংলাদেশের নাম (Bangladesh Media)। ফরাসি সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর গত সপ্তাহে প্রকাশিত এই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সোমবার থেকে বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র ‘ভোরের কাগজ’। সোমবার কাগজটি প্রকাশিত হয়নি। দুপুরে অফিস থেকে সাংবাদিক-অসাংবাদিক কর্মচারীদের বের করে দিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বোর্ডে টাঙানো নোটিসে বলা হয়, ‘ভোরের কাগজ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর ১২ ধারা অনুযায়ী মালিকের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যা ২০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।’
ঢাকার সাংবাদিক মহলের খবর, অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশ এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামির লাগাতার চাপের মুখে কাগজটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল কর্তৃপক্ষ। অনেকেই মনে করছেন, এরপর মালিকানা বদল করে সরকারের পছন্দের কথা লেখার উদ্দেশ্যে কাগজটি ফের প্রকাশিত হতে প। তাতে এখনকার বেশিরভাগ সাংবাদিকই চাকরি ফিরে পাবেন না। ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তকে গণঅভ্যুত্থানের অল্প দিন পরই গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে। একই দিনে গ্রেফতার করা হয়, বাংলাদেশ এডির্টস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবুকেও।
গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিনই ঢাকার পাঁচটি টেলিভিশন চ্যানেলের দখল নিয়েছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামি। হামলা হয় ৫০টির বেশি সংবাদমাধ্যমের অফিসে। আওয়ামী লিগের দালাল তকমা দিতে কয়েকশো সাংবাদিককে রাতারাতি চাকরিচ্যুত করা হয়। তাঁদের জায়গায় অনুগত বসানো হয়েছে।
বাংলাদেশের দুটি প্রথমসারির সংবাদপত্র প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার। দুটি একই মালিক গোষ্ঠীর। মাস খানেক আগে ওই দুটি সংবাদপত্র গোষ্ঠীকে ভারতের দালাল তকমা গিয়ে ঢাকার অফিস অবরোধ করে রাখে কিছু লোক।
সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন দাবি করেছে, মালিকদের উপর লাগাতার চাপ তৈরি করা হচ্ছে অপছন্দের সাংবাদিকদের বসিয়ে দিতে। বহু মালিক চাপের মুখ সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বসিয়ে দেন। চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের বেতন এবং অন্যান্য প্রাপ্য মেটানো হচ্ছে না।
দিন পনেরো আগে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি সময় টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের হাতে দশজন সাংবাদিকের নামের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে তাঁদের চাকরিচ্যুত করতে চাপ দেন। মালিকপক্ষ পাঁচ সাংবাদিককে হাসনাতের চাপে রাতারাতি ছাড়িয়ে দেয়। ঘটনা জানাজানি হতে আবদুল্লাহ দাবি করেন, সাংবাদিকদেরই একাংশ তাঁকে বলেছিলেন ওই সাংবাদিকদের সতর্ক করে দিতে। তিনি মালিকপক্ষকে চাকরি থেকে বসিয়ে দিতে বলেননি।
যদিও সময় টেলিভিশনের মালিকপক্ষ দাবি করেন আবদুল্লাহর চাপেই তাঁরা পাঁচ সাংবাদিককে বসিয়ে দিতে বাধ্য হন। প্রবল চাপের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারও ওই ঘটনার সমালোচনা করতে বাধ্য হয়।
সূত্রের খবর, গণঅভ্যুত্থানের পর হাজারের বেশি সাংবাদিককে চাকরি থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা চাপ দিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৬৩জন সাংবাদিকের সরকারি পরিচয়পত্র বালিত করে সরকার। চাকরি খোয়ানো এবং সরকারের রোষের মুখে পড়া সাংবাদিকেরা বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
যদিও তাঁরা আওয়ামী লিগ ও শেখ হাসিনার কাছের সাংবাদিক বলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন শিবিরের দাবি। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের অনেকেই অবশ্য বলছেন, তাঁরা কোটা আন্দোলন এবং হাসিনা বিরোধী অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন শিবিরের বিষ নজরে পড়েছেন। কারণ তারা নিজেদের অনুগত সাংবাদিকদের বসাতে চায়।
সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। জমানা নির্বিশেষে এর ধারাবাহিকতা আছে। তবে দেশটির প্রবীণ সাংবাদিক ও নাগরিকদের অনেকেই বলছেন, এখনকার মতো পরিস্থিতি কখনও ছিল না। এক মাঝবয়সি সাংবাদিকের কথায়, খবর লেখার সময় বর্তমানে ক্ষমতবান শিবিরের লোকেদের সাংবাদিকদের পাশে বসে ডিক্টেশন দেওয়াই শুধু বাকি। চলতি ধারা বহাল থাকলে সাংবাদিকেরা কী লিখবেন, কেন লিখবেন তাও বহিরাগতরা পাশে বসে বলে দেবে। সেই মতোই হয়তো লিখতে হবে।
দেশে সাংবাদিকদের উপর দমনপীড়ন করা হচ্ছে অভিযোগে সরব হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লিগ নেত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার তিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমে তিনটি সভা করেছেন। প্রতিটি সভাতেই হাসিনা বলেন, আমার সময় কি সাংবাদিকদের এইভাবে চাকরি গিয়েছে। কোনও সংবাদমাধ্যনের অফিসে হামলা হয়েছে। হাসিনার অভিযোগ, ইউনুস সরকার সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরেছে।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, ৫ অগাস্টের পর এখনও পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে ২৯৬জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৬০০ মামলায় অন্যদের সঙ্গে সাংবাদিকদেরও নাম আছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮জন সাংবাদিককে। তাঁদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না। মাসের পর মাস জেলে ফেলে রাখা হয়েছে। ঢাকার নামজাদা সাংবাদিক ফারজানা রুপা ও তাঁর স্বামী শাকিল আহমেদকে গণঅভ্যুত্থানের দিনই একাত্তর টিভি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ। রুপাকে জেলের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা সমাজমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন। এই ব্যাপারে অবশ্য সরকারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর এক নামজাদা সাংবাদিক মুন্নি সাহাকে দিন কয়েক আগে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘিরে ঘরে হেনস্থা করা হয়। তিনি কোনওরকমে প্রাণে বাঁচেন। মুন্নি সাহা ও তাঁর স্বামী কবীর হোসেন তাপসের ব্যাঙ্কের বিশদ নথি তলব করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। মামলা হয়েছে চ্যানেল আই-এর সঞ্চালিকা সোমা ইসলামের নামেও।
সাংবাদিকদের ঢালাও গ্রেফতারি, দমন পীড়নের নিন্দা করে ইউনুস সরকারকে পদক্ষেপ করতে আর্জ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। রিপোর্টার্স ইউদাউট বর্ডারস বিবৃতিতে মামলায় অভিযুক্ত সম্পাদক, কলামিস্ট এবং টিভি উপস্থাপকদের নামও দেয়া হয়েছে। তারা হলেন- দৈনিক সমকালের সাবেক সম্পাদক আবেদ খান, সময় টেলিভিশনের সাবেক সিইও ও পরিচালক আহমেদ জোবায়ের, দৈনিক সমকালের সাবেক উপসম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের বার্তা পরিচালক আশীষ সৈকত, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, একাত্তর টিভির ফারজানা রুপা, ডেইলি অবজারভার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, এটিএন বাংলার সাবেক বার্তা পরিচালক জ ই মামুন, এশিয়ান টিভির বার্তা পরিচালক মানস ঘোষ, ডিবিসি নিউজের এডিটর-ইন-চিফ মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম, একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, এটিএন নিউজের সাবেক বার্তা পরিচালক মুন্নী সাহা, ব্র্যাকের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও উপস্থাপক নবনীতা চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক প্রণব সাহা, এটিএন নিউজের সাবেক বার্তা পরিচালক প্রভাষ আমিন, যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম, একাত্তর টিভির সাবেক বার্তা পরিচালক শাকিল আহমেদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক শ্যামল সরকার, চ্যানেল আই-এর উপস্থাপক সোমা ইসলাম এবং রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসির (আরএফইডি) সভাপতি সুভাষ সিংহ রায়, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্বদেশ রায়, এখন টিভির বার্তা পরিচালক তুষার আবদুল্লাহ, ডিবিসি নিউজের সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু প্রমুখ।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে, ৯৬জন সাংবাদিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত বিশদ তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ১৮জন সাংবাদিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে পারছেন না।
সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনার দায় অস্বীকার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সমালোচনাকে তিনি খোলা মনে গ্রহণ করেন, বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম দ্য ওয়াল-কে ইতিপূর্বে বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা জনসাধারণ করেছে। মামলা করার অধিকার সরকার কেড়ে নিতে পারে না। তিনি আরও বলেছেন, কিছু সাংবাদিক আগের সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে নিজেদের একাত্ব করে তুলেছিলেন। সেই কারণে গণঅভ্যুত্থানের পর সেই সাংবাদিকদের কেউ কেউ ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। তাঁর দাবি সেই সাংবাদিকেরাই বিপাকে পড়েছেন যাঁরা শেখ হাসিনার সরকারের দূর্নীত আড়াল করতেন। সাংবাদিক বৈঠকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আপা আপা করে সম্মোধন করে তোষামোদ করতেন। কেউ কেউ আর্থিক সুবিধাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন শফিকুল।