শেষ আপডেট: 15th March 2025 10:44
জসিম উদ্দিন
দীর্ঘ সাত মাস প্রচণ্ড নীরবতার পর পর সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায় কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে শুরু করেছে। একাধিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাংবাদিকদের বারবার রিমান্ডে নেওয়া, আইনজীবী নিয়োগ না দেওয়া, বন্দি হিসাবে কারাগারের কনডেম সেলে রেখে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে এতদিন কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। অথচ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন আছে।
আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে সাংবাদিক গ্রেপ্তার-নির্যাতন হলে রাজপথে নেমে পড়ত বিভিন্ন সংগঠন। চাওয়া হত আইনি সুরক্ষা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সব যেন সব কিছু উধাও হয়ে গেছে। শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোসর আর দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে হত্যা মামলায় সাংবাদিকদের ‘শায়েস্তা’ করার সব রকম চেষ্টা চলছে।
কোনো সাংবাদিকই জুলাই-অগাস্ট হত্যার সঙ্গে জড়িত নয়, সেটি দিনের আলোর মতো পরিস্কার। তবুও কারাগারে বন্দি রাখা আর প্রতিহিংসার জন্য কথিত হত্যাকারীর তকমা দেওয়া হচ্ছে। এতে দুই ক্ষেত্রে সফলতা পাচ্ছে অন্তবর্তী সরকার। এক. একটি গোষ্ঠী প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারছে। দুই. অন্য সাংবাদিকদের ভয় দেখানো হচ্ছে- কথা বললে ভাগ্যে একই পরিণত।
এতে ভালই ফল পাচ্ছে অন্তবর্তী সরকার। মহম্মদ ইউনুস বিব্রত হন এমন কোনও খবরই প্রকাশ বা প্রচারিত হচ্ছে না দেশের গণমাধ্যমে।
ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি আছেন চার সাংবাদিক। এদের মধ্যে তিন জন একাত্তর টেলিভিশনের। তাঁরা হলেন, একাত্তর টেলিভিশের প্রধান সম্পাদক ও এমডি মোজাম্মেল বাবু, হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ এবং বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা রুপা। যদিও ৫ অগাস্টের পর ‘বিএনপি-জামায়াতপন্থী’ একাত্তর টেলিভিশন দখল করার পর শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর সেটি হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মাধ্যমে। যেভাবে তারা সময় টিভিতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এর বাইরে কারাগারে বন্দি রয়েছেন দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত।
শতাধিক সাংবাদিককে আওয়ামী লিগের দোসর বলে বারবার ব্যাখ্যা দিচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এমনকী অন্তবর্তী সরকারের বর্তমান তথ্য উপদেষ্টাও একই কথা বলছেন। এই ‘দোসর’ সাংবাদিক অনেকের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনেকের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু এসব সাংবাদিকদের নামে যে অভিযোগ করা হচ্ছে অর্থাৎ আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে, সে বিষয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। এমনি তদন্তের কোনও খবরও জানা যায়নি। শুধু হত্যা মামলা আসামি বানিয়ে তাদের ‘শায়েস্তা’ করছে অন্তবর্তী সরকার।
শতাধিক সাংবাদিকদের নামে অভিযোগ করা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে সিনিয়র চার সাংবাদিক। এরমধ্য তিন জনই একাত্তর টেলিভিশনের। তাহলে প্রশ্ন অন্তর্বতী সরকারের এত রাগ কেন একাত্তরের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। কেনইনবা তারা শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে। যদি তর্কের খাতিরে বর্তমান সরকারের কথাই ধরে নেওয়া হয়- শতাধিক সাংবাদিক দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে তাহলে অন্য সাংবাদিকের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না?
একাত্তর টেলিভিশনের তিন সাংবাদিকদের উপর এই ক্ষোভের কারণ জানতে একটু পেছনে ফিরতে হবে। আওয়ামী লিগ সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধীর বিচার, মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকর, জামায়াতের ইসলামি ও হেফাজতে ইসলামের চক্রান্তর বিষয়ে সবচেয়ে সরব ছিল একাত্তর টেলিভিশন। নিউজ সামলাতেন শাকিল আহমেদ এবং টকশোতে তির্যক প্রশ্ন ছুড়ে নাস্তানাবুদ করতেন ফারজানা রুপা।
শাপলা চত্বর অভিযানে বল প্রয়োগ করে সরিয়ে দেওয়ার পর বহু মাদ্রাসা ছাত্রের নিহতের তালিকা করেছিল হেফাজতে। একাত্তর টিভি সেই তালিকা ধরে খুঁজে বের করেছিল- নিহতদের তালিকায় নাম থাকা বেশির ভাগ জীবিত ছিলেন। তখন থেকে একাত্তর টিভির উপর ক্ষোভ ছিল জামায়াত ও হেফাজতের। তাই ৫ অগাস্টের পর ঢাকার বারিধারার সুরক্ষিত ডিপ্লোমেটিক জোনের প্রাচীর ভেঙ্গে একাত্তর টিভির অফিসে চার দফা হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার হওয়া একাত্তর টিভির তিন সাংবাদিককে বিচারের নামে রীতিমত ‘পিষে’ ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
কারাগারে নির্যাতনের শিকার চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা শেখ হাসিনার দোসর। গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেন তাঁরা। এরমধ্যে মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত ও ফারজানা রুপা বিভিন্ন সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতেন। আর এই প্রশ্ন করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সুনাম করেছেন। এ কারণে তাঁদের আওয়ামী লিগের দোসর বলা হচ্ছে। অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারজিস আলম এক সময় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলতেন। কিন্তু সারজিস আলমকে আওয়ামী লিগের দোসর বলা হচ্ছে না!
এখন যদি প্রধান উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন করেন, আর তখন সাংবাদিকরা মহম্মদ ইউনুসের প্রশংসা করে প্রশ্ন করে তবে কি সাংবাদিকের দোষ হবে? রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রশংসা করা তো কোনও অপরাধ নয়। যদি এসব সাংবাদিক দুর্নীতি করে অনিয়ম করে তাহলে সেই মামলায় তাদের বিচার হতে পারে। হত্যা মামলা দিয়ে কেন হয়রানি? যখন সরকারের কাছে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও প্রমাণ নেই, তখনই মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এমন নজির আগেও ছিল, এখনও আছে।
একাত্তর টিভির মোজাম্মেল বাবু, শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাকে আওয়ামী লিগের দালাল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অথচ ছাত্র জীবনে ছাত্র দল করার কারণে শাকিল আহমেদ এবং বাম রাজনীতি কারার কারণে ফারজানা রুপার একসময় গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা গণভবনে যেতে পারতেন না। শিক্ষা জীবনে অন্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁরা কখনও আওয়ামী লিগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধ আর অসম্প্রদায়িকতার পক্ষে সব সময় সরব থেকেছেন শাকিল-রুপা দম্পতি। এটিই কাল হয়েছে তাঁদের জীবনে।
আর একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু আওয়ামী লিগের সঙ্গে জড়িত থাকলেও, তাঁর মালিকানাধীন একাত্তর টেলিভিশনে বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শের সাংবাদিকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লিগ সরকারের ১৬ বছরে দাপটের সঙ্গে তাঁরা কাজ করেছেন। অনেকে অর্থ সম্পদ করেছেন। ৫ অগাস্টের পর একাত্তর টিভির বড় বড় পদ দখল করেছেন সেসব সাংবাদিক। এই পদ দখলের জন্য সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সহযোগিতার করার কথা বলে মোজাম্মেল বাবুকে ছাত্র-জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
রাজনতিক পট পরিবর্তনের পর একাত্তর টিভির যে কয়েকজনের চাকরি গেছে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক। আর অল্প কিছু আছে- শুধু কাজের কারণে তাঁদের চাকরি টিকে আছে। কিন্তু বড় সংখ্যক সাংবাদিকদের পরিবর্তন করতে হয়নি। এর একমাত্র কারণ তাঁরা বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শের। কেউ কেউ আবার ভয়কর দলীয় একটিভিস্ট। তবে গেল ১৫ বছরে সবারই ফ্ল্যাট-গাড়ি হয়েছে, অ্যাকাউন্ডে জমেছে লাখ লাখ টাকা। অথচ সব দোষ শাকিল-রুপার।
বাংলাদেশের সবাই জানে অন্তবর্তী সরকারের প্রশাসনে বড় হাত রয়েছে জামায়াতের। এই দলের পরামর্শে বা নির্দেশে সচিব থেকে জেলা প্রশাসক-এসপি পদায়ন করা হয়। জামায়াতের গ্রিন সিগন্যাল না পেলে কেউ বড় পদে বসতে পারে না। এটি যে সত্য তা বারবার বলে আসছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এমন সুসময় আর পায়নি জামায়াত। সেই সুযোগটা পুরো ব্যবহার করছে দলটি। জামায়াতের ক্ষমতা খর্ব না হওয়া পর্যন্ত শাকিল-রুপাদের মুক্তি নেই এটি পরিস্কার।
বাংলাদেশের সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও সাকিল আহমেদ। দু'জনকেই খুনের মামলা দিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে।
শাকিল আহমেদ-ফারজানা রুপা দম্পতির একটি মেয়ে রয়েছে। নাম, মনফুল, বয়স ১৭ বছর। সাধারণত ছুটির দিন ছাড়া বাবা-মার সঙ্গে মনফুলের দেখা কম হত। কাজ শেষে অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন শাকিল-রুপা। বাবা-মার সঙ্গে গল্প করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতো মনফুল। যতো রাতই হোক, তিনজন মিলে কথা-গল্প করে তবেই ঘুমাতে যেতেন।
এবার দেশের বাইরে যাওয়ার বায়না ধরেছিল মনফুল। ৮-১০ দিন বাবা-মা’র গায়ে গায়ে থাকতে চেয়েছিল মনফুল। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাদের ফ্রান্সে যাওয়া কথা ছিল। তিনজন ভিসাও করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সব যেন উলোটপুরান। এই বয়সে সে চোখের সামনে বাবা-মাকে গ্রেপ্তার হতে দেখেছে। বিদেশে যাওয়ার বায়না ধরতে গিয়ে এখন মা-বাবা ছাড়া দিন কাটে মনফুলের।
সাত মাস হল মা-বাবার সঙ্গে দেখা নেই, কথা নেই মনফুলের। খালার বাসায় থেকে সে পরিচিত সাংবাদিক শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে যোগযোগ করেছে। যাতে তার বাবা-মার মুক্তির জন্য কেউ কোনও ব্যবস্থা নেন। কিন্তু সবাই যেন শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কেউ সাহস করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে না। অথচ তার বাবা-মাকে দেখেছে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, শামসুজ্জামান গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পথে নেমে প্রতিবাদ করতে। কিন্তু অজানা আতঙ্কে এখন সবাই নীরব। সাংবাদিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সাংবাদিকরাই প্রতিবাদ করছে না সেখানে সাধারণ মানুষের কথা ভাবাই বৃথা।
মনফুলর এই ভাবনাগুলো সত্য। দেশে সাংবাদিকদের কত সংগঠন আছে। তাছাড়া শাকিল আহমেদের হাতে গড়া ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারও কোনও প্রতিবাদ করেনি। গ্রেপ্তার সাংবাদিকরা যদি ছাত্র হত্যা করে, তাহলে তার বিচার হোক, শাস্তি হোক। তাই বলে তাঁরা কোনও আইনি সুরক্ষা পাবেন না, আইনজীবী পাবেন না? এটি কোন বাংলাদেশ?
তবে আশার কথা- বুধবার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আদালতে তোলা এবং রোজা রাখা নিয়ে শাকিল আহমেদের বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর কেউ কেউ সরব হয়েছেন। অন্তত ফেসবুকে লিখছেন, অপরাধী হলেও তাকে আইনি সুরক্ষা দিতে হবে।
প্রবাসী সাংবাদিক ফরিদ আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, 'আওয়ামী লিগের শাসনামলের অনেক চিহ্নিত রাঘব-বোয়াল কোটি টাকা ছিটিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। সেই টাকা কারা খেয়েছেন? শাকিল আহমেদ আর ফারজানা রুপা ও এয়ারপোর্টে আটক হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁদের হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে এখন বিচার চলছে। ধন্যবাদ সেই ক্ষমতাসীনদের, যারা বলেন, 'জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মূল ভিত্তি মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার।'
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জ ই মামুন লিখেছেন, 'সরকার বা রাষ্ট্র চাইলে যে কাউকে যে কোনও অভিযোগে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করতে পারে এবং তাঁকে বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। তাই গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছু বলে লাভ নেই। বিচারের ভার আদালতের। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরও কিছু অধিকার থাকে, তাঁর মধ্যে অন্যতম হল জামিন পাওয়ার অধিকার। একদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে সাংবাদিকদের পেছন থেকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হচ্ছে! সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।