শেষ আপডেট: 26th November 2024 15:48
অমল সরকার
বাংলাদেশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার ধারায় মামলা ঠুকে গ্রেফতার করেছে (Chinmoy Krishna Das Arrest)। অভিযোগ, চট্টগ্রামের যে ময়দানের তাঁর ডাকে সভা হয় সেখানে জাতীয় পতাকার অমর্যাদা করা হয়েছে। আবার সেই সভাতেই তাঁর ভাষণের অনুবাদ শুনে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগে সরব হয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প মুখ খোলার পর বাংলাদেশে যাঁকে নিয়ে কৌতূহল তুঙ্গে, তিনি হলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী (Chinmoy Krishna Das Brahmachari)। গ্রেফতারির আগে তিনিই সাক্ষৎকার দেন 'দ্য ওয়াল'কে (Chinmoy Krishna Das Latest News)।
৩৮ বছর বয়সি এই সাধু (Chinmoy Krishna Das) ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং প্রতিষ্ঠানের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ। সপ্তাহ দুই আগে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের যে সভার হিন্দুদের নজিরবিহীন জমায়েত সংশ্লিষ্ট সব মহলকে চমকে দেয়, সেখানে চিন্ময় কৃষ্ণের দেওয়া ভাষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনও ট্রেন্ডিং। সেই সভার আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের সাধুরা মিলে নবীন এই সন্ন্যাসীকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ঘোষণা করেছেন।
সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর চট্টগ্রামের সভায় চিন্ময় কৃষ্ণ (Chinmoy Krishna Das) দেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে উগ্র ইসলামিক দল ও পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশ্যে চরম হুঁশিয়ারি দেন। হিন্দুর ঐক্য ও জাগরণের ডাক দিয়ে বলেন, 'যারা কথায় কথায় আমাদের দেশ ছাড়তে বলছে, তাদের বলছি, আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না। আমরা মরতে ভয় পাইনা। এ দেশে জন্মেছি, মরব এ দেশেই। কোনও অবস্থাতেই মাতৃভূমি ছেড়ে যাব না।' 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনীতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা ময়দান। 'আমার মাটি আমার মা, বাংলা ছেড়ে যাব না', 'কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার', ইত্যাদি স্লোগান দেয় উপস্থিত জনতা। সভা থেকে সাধুরা আট দফা দাবি তুলে হুঁশিয়ারি দেন, সরকার কথা না শুনলে এরপর ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ করবে সংখ্যালঘুরা।
গত ৫ অগস্ট গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ জুড়ে আওয়ামী লিগ সমর্থকদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের একাধিক ঘটনা ঘটে। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার ভারতে চলে আসতে সীমান্তে জড়ো হয়। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাধায় পরিবারগুলিকে দেশেই থেকে যেতে হয় বটে, তবে অনেকেরই ঘরবাড়ি অক্ষত নেই। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ৫ থেকে ২০ অগাস্টের মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ২০১০টি ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বেশিরভাগই হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান, অফিসের উপর হামলার ঘটনা।
যে বিভাগীয় শহরগুলিতে হামলার ঘটনা বেশি ঘটে চট্টগ্রাম তার অন্যতম। সেই শহরেই সপ্তাহ দুই আগে সাধুদের ডাকে সেই সমাবেশ গোটা বিশ্বে হিন্দু সমাজে আলোচনার বিষয় হয়েছে। স্মরণকালের মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দুদের কোনও সমাবেশে এমন ভিড়ের নজির নেই। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত অচল ছিল বন্দর শহরের একাংশ।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, বাংলাদেশে জমানা নির্বিশেষে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটলেও অতীতে কখনও সাধু-সন্তদের প্রতিবাদের ময়দানে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক পরিষদই সংখ্যালঘুদের স্বার্থে সেই ১৯৮৮ সাল থেকে লড়াই করে আসছিল। ওই বছরই সংবিধান বদলে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মহম্মদ এরশাদ।
এবার সংখ্যালঘুদের উপর নজিরবিহীন আক্রমণের পরও সেই ঐক্য পরিষদকে তেমন একটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। তারা মূলত প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস ও প্রশাসনের অন্য শীর্ষ কর্তাদের স্মারকলিপি দিয়েই থমকে গিয়েছে।
ঐক্য পরিষদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে দু'রকম মত শোনা যাচ্ছে। একটি মত হল, ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হওয়ায় সংগঠনের বাকি নেতারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ৭৫ বছরের প্রবীণ, মুক্তিযোদ্ধা তথা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নামজাদা আইনজীবী রানা দাশগুপ্তর মতো মানুষের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হতে পারে, ভাবতে পারেননি কেউ। মামলা প্রত্যাহারের যাবতীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় সংগঠনের কর্তাদের অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এমনকী মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে। রানা দাশগুপ্তও সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়ে গ্রেফতারি এড়াতে আত্মগোপনে থেকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় কৌশলগত কারণে ঐক্য পরিষদ সাধু সন্তদের এগিয়ে দিয়েছে। যদিও তাতে সংখ্যালঘুদের এতদিনের যৌথ আন্দোলন ভেঙে গিয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানের যৌথ আন্দোলন এখন অতীত।
যদিও চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী তা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, হিন্দু সমাজ ও ধর্ম রক্ষায় সাধুরা নিজেদের তাগিদ থেকে পথে নেমেছেন। কোনও সংগঠনের নাম না করে তিনি বলেন, 'যে সংগঠনগুলি এতদিন সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষার কাজ করছিল বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ তাদের উপর ভরসা হারিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে আমরা সামনে এগিয়ে এসেছি।' চিন্ময় কৃষ্ণের কথায়, 'ভরসা হারানোর কারণ, সংগঠনগুলির নেতাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। ফলে রাজনৈতিক কারণেও সংখ্যালঘুরা হামলার শিকার হয়েছে।'
প্রসঙ্গত, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লিগের ঘনিষ্ঠতা অজানা নয়। শেখ হাসিনার জমানায় পরিষদ আন্দোলন করলেও তার চরিত্র নিয়ে বারে বারেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের দীর্ঘদিনের দাবি সংখ্যালঘু মন্ত্রক, সংখ্যালঘুদের অভাব-অভিযোগের নিষ্পত্তিতে কমিশন গঠন। আওয়ামী লিগ গত তিনটি নির্বাচনে তাদের ইস্তাহারে এই সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও সরকার গঠনের পর কথা রাখেনি। অন্যদিকে, দাবি আদায়ে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে।
অনেকেই মনে করছেন, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সমাজের ত্রাতা হয়ে উঠতে চাইছে ইসকন। আন্তর্জাতিক ওই সংগঠন অবশ্য জানিয়েছে, চিন্ময় কৃষ্ণ ইসকনের সাধু হলেও তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের কোনও সম্পর্ক নেই। যদিও বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় রামকৃষ্ণ মিশন যেমন নীরব, অন্যদিকে ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছে ইসকন। দু বছর আগে দুর্গাপুজোয় কুমিল্লায় মণ্ডপে হামলার ঘটনা গোটা বিশ্বের প্রচার করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারকে বিপাকে ফেলেছিল ইসকন। এবারও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারে নেমেছে ওই সংগঠন। ট্রাম্পের মুখ খোলার পিছনেও রয়েছে ওই সংগঠনের তৎপরতা।
চিন্ময় কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার ধারায় যে মামলা হয়েছে তাতে অভিযোগ করা হয়, নিউ মার্কেটের সভায় জাতীয় পতাকার উপরে ইসকনের পতাকা টাঙানো হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্ররা সেখানে বেদি তৈরি করে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে পুলিশ ইতিমধ্যে দু'জনকে গ্রেফতার করেছে।এফআইআরে চিন্ময় কৃষ্ণের নাম থাকলেও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি। এমনকী তলবও করেনি পুলিশ।
অভিযুক্ত সাধুর বক্তব্য, 'মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের দমানো যাবে না। নিউ মার্কেটের সমাবেশ দেখে হিন্দু বিরোধীরা তটস্থ হয়ে উঠেছে।তারা বুঝে গিয়েছে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ। তাদের আর দমিয়ে রাখা যাবে না।' প্রতিবাদ সভা হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার ধারায় মামলা হওয়ার বিরুদ্ধে।
ইসকনের ওই সাধুর বিরুদ্ধে মামলা করেন চট্টগ্রামের বিএনপির এক নেতা। বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক জিয়ার নির্দেশে চট্টগ্রামের ওই নেতাকে বহিষ্কার করেছে দল।
চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে চিন্ময় কৃষ্ণ দ্য ওয়াল'কে বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় বিপদ জনসংখ্যা। দ্রুত কমছে হিন্দুর সংখ্যা। তার পিছনে নিপীড়ন, নিযাতন তো আছেই, আরও এক কারণ এ দেশে হিন্দুদের পরিবার পিছু একটি সন্তান। এখন তাদের পবিত্র কর্তব্য হবে বেশি বেশি করে সন্তানের জন্ম দেওয়া।'