শেষ আপডেট: 12th September 2024 17:29
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার জল্পনা নতুন নয়। হাসিনা জমানার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা আগেই করেছেন।
প্রশ্ন হল সাহাবুদ্দিনকে সরালে রাষ্ট্রপতি কে হবেন? বাংলাদেশ প্রশাসনের শীর্ষ মহলের খবর, প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি উপদেষ্টা পরিষদের পরিবর্তে মন্ত্রিসভাও গড়ে নিতে পারেন। এমাসের শেষে ইউনুস আমেরিকা যাবেন রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে। ঢাকায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে জোর জল্পনা, রাষ্ট্রসংঘে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতিৃ হিসাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন তিনি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
অবশ্য, বাংলাদেশের সনামধন্য কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মাজহারের নামও নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে আলোচনায় আছে। ঘটনাচক্রে তিনিই সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে ইউনুসকে রাষ্ট্রপতি করার পক্ষে প্রথম সরব হন। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে নাম আছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিরও। বলাইবাহুল্য, জল্পনা ইউনুসকে নিয়েই বেশি।
সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আরও জোরালো হয়েছে তাঁর মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট ও সেকেন্ড হোম এবং দুবাইয়ে যৌথ ব্যবসা থাকার খবরে। রাষ্ট্রপতির অফিস ওই খবরের সত্যতা অস্বীকার করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে আভাস দেওয়া হয়েছে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
সেই জল্পনা আরও গতি পায় হঠাৎ করেই সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়। সেনা প্রধানের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের যুক্তিযুক্ত কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল। জানা গিয়েছে, রাষ্ট্রপতির দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার দিনেই সেনা প্রধান সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে সময় চান।
ইউনুসকে নিয়ে জল্পনায় আলোচনায় এসেছে রাষ্ট্রপতি শাসিত বিগত সরকারগুলির প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশে এর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনবার সরকার গঠিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকেৃ হত্যার পর ক্ষমতায় আসে খন্দকার মুস্তাক আহমেদ। এরপর দুই সেনা প্রধান জিয়াউর রহমান এবং হুসেন মহম্মদ এরশাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। যদিও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ওই তিন সরকারকেই অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে ওই সময় গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্ত, আইন ইত্যাদি বাতিল করে দেয়।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যে একাধিক সাংবিধানিক পদাধিকারীকে চাপ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কাজি হাবিবুল আউয়াল সহ পাঁচ কমিশনার গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা থাকবেন নাকি বিদায় নেবেন তা জানতে চেয়ে রাষ্ট্রপতি মহম্মদ সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন। সাড়া না পেয়ে বুঝে যান তাঁদের বিদায় নিতেই বলা হচ্ছে।
গত সোমবার পদত্যাগ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে সংসদ না থাকলেও স্পিকার পদ চলে যায় না। স্বভাবতই শিরীন শারমিনের পদত্যাগ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে।
একাধিক সুত্র জানিয়েছে, চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো হয়েছে স্পিকারকে। পদত্যাগের পর তিনিও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ। রংপুরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় খুনের মামলায় আসামি করা হয়েছে তাঁকে। দেশের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখা সাবেক স্পিকার ও তাঁর স্বামীর ব্যাঙ্কের বিস্তারিত তথ্য তলব করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার অল্প দিনের মধ্যে জন বিক্ষোভের মুখে সরে যেতে হয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে। নতুন প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে সৈয়দ রেফাত হোসেনকে।
একাধিক সুত্র জানিয়েছে, এবার পালা রাষ্ট্রপতি মহম্মদ সাহাবুদ্দিনের। শেখ হাসিনার স্নেহধন্য রাষ্ট্রপতিকে সরানোর দাবি তুলেছে বিএনপি সহ একাধিক দল।
যদিও দেশের বর্তমান শাসকেরা রাষ্ট্রপতিকে সরানো নিয়ে সাংবিধানিক সংকটের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ কোনও কারণে শূন্য হলে সংসদের স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। ভারতের মতো সে দেশে উপ রাষ্ট্রপতির পদ নেই। রাষ্ট্রপতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও সাংবিধানিক সংকটে পড়বে দেশ৷ অবশ্য বাংলাদেশের সংবিধানে সাংবিধানিক সংকটে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশের ২৮তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিনের নাম যেদিন শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন সেদিন আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাও চমকে যান। কারণ, সাহাবুদ্দিনের নাম তাঁরা কখনও শোনেননি এবং তাঁর পরিচয় সম্পর্কেও কেউ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আসলে সাহাবুদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশ বিচারবিভাগের জেলাস্তরের একজন বিচারক। এই পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর হাসিনাই তাঁকে দেশের দুর্নীতিদমন শাখার কমিশনার করেছিলেন। এমন সাধারণ যোগ্যতার কোনও মানুষ এর আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হননি। কিন্তু শেখ হাসিনা কেন তাঁকে এত বড় পদে বসিয়েছিলেন?
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট হত্যা করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেদিন কতিপয় প্রতিবাদীর একজন ছিলেন তরুণ সাহাবুদ্দিন। তার জন্য তাঁকে ৩ বছর জেলও খাটতে হয়েছিল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, শুধুমাত্র এই কারণেই হাসিনা তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে এনেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে হাসিনা দেশ ছাড়তেই সাহাবুদ্দিন সেনার চাপে পড়ে গেছেন। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও তা স্পষ্ট হয়।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ায় চাপে পড়েছেন সাহাবুদ্দিনই। বাংলাদেশের সেনা প্রধান তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেছিলেন যে, আপাতত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। এরপরই রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে জানান, জেলবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হবে, পাশাপাশি একাধিক রাজনৈতিক বন্দিরাও অবিলম্বে মুক্তি পাবেন। তাঁর এই বক্তব্য শুনে অনেকেই মনে করছেন, সেনার চাপে পড়েই তিনি এমন কথা বলেছেন। এমনকী, তাঁর ভাষণের খসড়াও নাকি সেনারই লিখে দেওয়া।
সেনাবাহিনীর কথামতো চলেও সাহাবুদ্দিন কতদিন দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবেন সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ, বাংলাদেশে যে আন্দোলন হয়েছে তার প্রধান ইস্যু ছিল দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার। এই তালিকায় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতার বিচারে পুনর্নিয়োগ, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের বদলি, একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি বদল। কারণ সাহাবুদ্দিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সেই সময়ে দেশে নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই দাবি করে ভোট বয়কট করেছিল বিএনপি। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর আবার রাষ্ট্রপতি বদলের দাবি উঠতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অবশ্য মেয়াদের আগে রাষ্ট্রপতির ইস্তফা দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে অন্তত হাফ ডজন এমন ঘটনা ঘটেছে। কখনও প্রধানমন্ত্রী চাপ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন, কখনও সেনার চাপে রাষ্ট্রপতিকে সরাতে হয়েছে। এমনও হয়েছে, পদত্যাগ পত্র লিখে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে শুধু সই করানো হয়েছে। এখন এটাই দেখার, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পাশাপাশি মহম্মদ সাহাবুদ্দিনের ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয়।