বাংলাদেশে একের পর এক খুন, মামলা, হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে।
শেষ আপডেট: 1st September 2024 15:06
অমল সরকার
‘আমি জানতাম যে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। এটাও জানতাম যে শিক্ষার্থীরা আমার অফিস ঘেরাও করবে এবং তারা আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে। ফলে আমি পদত্যাগপত্র সাইন করে অফিসে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু ওরা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা চাইছিল আমি যেন তাদের সামনে গিয়ে পদত্যাগ করি।’
বিবিসি বাংলাকে কথাগুলি বলেছেন বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ক’দিন আগেও যাঁর ক্লাস করতে পড়ুয়ারা মুখিয়ে থাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করেই রেহাই পাননি তিনি, ছাত্ররা তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। বাধ্য হয়ে সপরিবারে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে তাঁকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক বলেছেন, ‘আওয়ামী লিগের সমর্থক, শুধু এই কারণে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।’
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপ্লব সফল হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে ওই শিক্ষকের পদত্যাগ তার একটি নমুনা মাত্র। দেশ জুড়ে কয়েক হাজার শিক্ষককে বাধ্য করা হয়েছে পদ অথবা চাকরি ছাড়তে। চাপ সৃষ্টি করতে ছাত্ররা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চড় থাপ্পর মারার মতো শারীরিক নিগ্রহ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটি ভিডিও-তে দেখা যাচ্ছে, স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ছাত্ররা মারতে মারতে রিকশয় তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, ভয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া শিক্ষক, কর্মচারীদের প্রশাসন দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরাচ্ছে।
হামলাকারীদের হাত থেকে সাবেক মন্ত্রী দীপু মনিতে রক্ষা করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
শনিবার ঢাকায় সাংবাদিক বৈঠক করে বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ। এটি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গ সংগঠন। তারা জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর গত পঁচিশ দিনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯জন শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। তাঁদের ১৯জনকে পরে পুনর্বহাল করা গিয়েছে। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা আওয়ামী লিগের সমর্থক।
অন্যদিকে, জমানা বদলের পর তোলাবাজি, সিন্ডিকেটের দাপট আরও জাঁকিয়ে বসেছে। যাত্রী থেকে মালবাহী গাড়ি, নৌ-যান পিছু হাজার হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী, ছোট শিল্প সংস্থার প্রাণ ওষ্ঠাগত। শতাধিক কলকারখানা লুটপাট করে, পুড়িয়ে দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে এক সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লিগ নেতার টায়ার কারখানায় লুটপাট করতে গিয়ে শেষে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছেন ছ’শোর বেশি মানুষ।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, খুনের মামলায় যাঁর নাম যুক্ত করা হয়েছে।
স্বৈরশাসন কায়েমের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া শাসকের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো কারও বিরুদ্ধে শতাধিক খুনের মামলা দায়ের হয়নি। কোনও কোনও মামলায় হাসিনার সঙ্গে তাঁর মার্কিন প্রবাসী পুত্র ও দিল্লিবাসী কন্যার নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে খুনের মামলায় বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য এবং সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের নাম জড়ানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডটির সময় সাকিব ছিলেন কানাডায়। সেখান থেকে তিনি পাকিস্তান সফররত জাতীয় দলের সঙ্গে যোগ দেন। একই মামলায় নাম রয়েছে অভিনেতা ফিরদৌস আহমেদের। আসলে সাকিব ও ফিরদৌস আওয়ামী লিগের সাংসদ ছিলেন।
প্রতিহিংসাই যে অধিকাংশ খুনের মামলার উদ্দেশ্য রংপুরে মানিক মিঞা হত্যাকাণ্ডের এফআইআর তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মামলা দায়ের হয়েছে মানিক মিঞার মা নুরজাহান বেগমের নামে। ১১৯জন আসামির একজনকেও তিনি চেনেন না এবং তাঁকে দিয়ে শুধু কাগজে সই করানো হয়েছে বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বৃদ্ধা।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসের আর্জিতেও থামেনি হিংসা।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় একটি খুনের মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রধান সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের। বছর পঁচাত্তরের এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর আর এক পরিচয় তিনি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনালের পদমর্যাদার প্রসিকিউটর ছিলেন। তাঁর সওয়ালের জেরে শাস্তি ভোগ করছে মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে যুক্ত বহু অপরাধী।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হালের নির্যাতনের বিরুদ্ধে রানা দাশগুপ্ত শুধু জোর গলায় প্রতিবাদ করেছেন তাই-ই নয়, সীমান্তে জড়ো হওয়া সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে আহ্বান জানান, ‘কোনও অবস্থাতেই দেশ ছাড়বেন না। দেহে শেষ রক্তবিন্দু থাকতে বাংলাদেশের মাটি কামড়ে থাকব আমরা। এ দেশ সকলের।’ দ্য ওয়াল-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ক্রমশ আফগানিস্তান হয়ে উঠছে।’ তাঁর ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, জমানা নির্বিশেষে শাসকের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা রেখে কথা বলা এই প্রবীণ সংগঠককে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই খুনের মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সারজিস আলম। মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ছাত্র সমন্বয়কেরা।
এ রকমই একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ঢাকার ২৫জন নামজাদা সাংবাদিককে। তাঁদের মধ্যে ফারজানা রুপা ও তাঁর স্বামী শাকিল আহমেদকে শনিবার ঢাকার একটি আদালত পুলিশ রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে। খুনের মামলা হওয়ার আগে এই দুই টিভি সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তালিকায় নাম আছে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর এডিটর-ইন-চিফ নায়িম নিজাম, তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক তথা ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ডিবিসি নিউজের প্রণব সাহা, সাংবাদিক মুন্নি সাহা, সোমা ইসলাম, সুভাষ সিংহ রায়, বাংলাদেশ এডিটরস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু প্রমুখের।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। এই সাংবাদিকদের অনেককেই আমি চিনি যাঁরা কোটা আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখি করেছেন তাই শুধু নয়, নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারার বিরোধিতা করে কলম ধরেন। তাঁদের অপরাধ তাঁরা ৫ অগাস্ট পরবর্তী অরাজকতার বিরুদ্ধেও সমান সরব ছিলেন। দেশের আর এক প্রান্ত চট্টগ্রামে প্রেসক্লাবে হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। জেল ফেরৎ দুষ্কৃতী, মাদক ব্যবসায়ী, বন্দর মাফিয়ারা সেখানে প্রেসক্লাবের সদস্য হতে হুমকি দিয়ে চলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার এবার ১৫ অগাস্টের ছুটি বাতিল করে। ১৯৭৫-এর ওই দিন সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব। আওয়ামী লিগ দিনটি শোক দিবস হিসাবে পালন করে। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ‘জাতির পিতা’ সম্মান প্রত্যাহার করা হয়নি। কিন্তু ১৫ অগাস্ট সরকারের তরফে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কোনও আয়োজন ছিল না। রাষ্ট্রপতি ভবন-সহ সমস্ত সরকারি অফিস থেকে মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সরকারি অবজ্ঞার যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার তাই-ই হয়েছে। ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়ি, যা জাতীয় যাদুঘর হিসাবে পরিচিত সেখানে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি ১৫ অগাস্ট কাউকে শ্রদ্ধা জানাতে দেওয়া হয়নি। আগের রাত থেকে উন্মত্ত ছাত্র-জনতা বাড়িটির দখল নিয়ে রাতভর জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে উল্লাস করে, ডিজে বাজিয়ে চলে লুঙ্গি ড্যান্স। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি, অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী শ্রদ্ধা জানাতে গেলে তাঁদের ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হয়। ওই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হামলায় আহত আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মমিন পাটোয়ারী শনিবার হাসপাতালে মারা গেছেন।
কী হচ্ছে আদালতে? ন্যায় বিচারের মঞ্চ আদালত হয়ে উঠেছে আতঙ্কপুরী। আওয়ামী লিগের নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী, হাসিনার সহযোগী এবং দলের কর্মী-সমর্থক মিলিয়ে কয়েকশো জন আদালতে পুলিশ-সেনার ঘেরাটোপের মধ্যে জনতার হামলার শিকার হয়েছেন। সেই তালিকায় বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির মতো ষাটোর্ধ্ব মহিলাও আছেন। কিল-চড়-ঘুষি কিছুই বাদ থাকছে না। দেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রাক্তন বিচারপতি আদালত চত্ত্বরে এমন মারধরের শিকার হন যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে অস্ত্রপচার করাতে হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা নতুন নয়। তা না হলে দু’জন রাষ্ট্রপতিকে সেনার হাতে খুন হতে হল কেন? বেপথে ক্ষমতা দখলেরও অসংখ্য নজির আছে সেখানে। জমানা নির্বিশেষে প্রতিহিংসাই ছিল শাসকের অপশাসনের প্রধান অস্ত্র। জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হাসিনার জমানায় বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি বাংলাদেশে একজন সজ্জন রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে আশিটি মামলা ঝুলছে, যার একটিতে পুরসভার ময়লার গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। কিন্তু ৫ অগাস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী অতীতের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে, বলছেন সে দেশের নানা অংশের ভুক্তভোগী মানুষ।
অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় উপদেষ্টা এসব ঘটনাকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করে পাল্টা বলছেন, রাতারাতি মানুষ মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংসার পূজারি হয়ে যাবেন, এটা প্রত্যাশা করা ভুল। কিন্তু অনাচারের ঘটনার কিছু ভিডিও খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এই ‘মব জাস্টিস’ বা ক্ষিপ্ত জনতার বিচার আসলে সুপরিকল্পিত। সব ক্ষেত্রেই জনতার ভিড়ে মুরুব্বিদের চেনা যাচ্ছে, যারা হিংসার চিত্রনাট্য নিয়ে ঘুরছেন।
সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে, নাকি তথাকথিত ক্ষিপ্ত জনতার হাতে, তদন্তে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা না হলে আরও বড় বিপদের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। লক্ষণীয় হল, হত্যাকারীরা নিজের চেহারা গোপন করেনি। সামাজিক মাধ্যমে তাদের জিঘাংসার ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বহু মানুষকে হত্যার পর গাছে, ল্যাম্প পোষ্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কেউ প্রেরণা, অভয় না দিলে যা হওয়ার কথা নয়। যে শিশু-কিশোরেরা এই সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করল, ভিডিও করল, ভবিষ্যতে তারা কোন পথে হাঁটবে?
হিংসার ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট গণ অভ্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে তালিবানি ব্যবস্থা কায়েমের মহড়া চলছে। চেষ্টা সফল হলে হয়তো এলাকার মুরুব্বিই ঠিক করবে কাকে কারাগারা নিক্ষেপ করা হবে, আর প্রকাশ্যে ফাঁসি, মুণ্ডচ্ছেদ, গুলি করে হত্যা করা হবে কাকে।