শেষ আপডেট: 7th February 2025 14:41
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনকে উপলক্ষ করে বাংলা একাডেমি যখন ১০০টি পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ করে সেই সময় সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক কবি মহম্মদ নূরুল হুদা আমাকে একদিন ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ বা এই ধরনের একটি গ্রন্থ রচনার প্রস্তাব দেন। আমি প্রস্তাবটি সবিনয়ে প্রত্যাখান করে মহাপরিচালক মহোদয়কে জানাই, ১৯৫৭ সালে আইনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের আনীত প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এদেশে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় এ কথা সত্যি, কিন্তু শুধু এই একটি তথ্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক রচনা অসম্ভব। হয়তো স্বাধীনতা উত্তরকালেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিকাশ ও মানোন্নয়নে আরও অবদান রেখেছেন, কিন্তু তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই। অতএব এই বইটি লেখার জন্যে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণার জন্যে যথেষ্ট সময় দিয়ে এই গ্রন্থটি রচনা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী গ্রন্থমালা নেড়ে চেড়ে দেখলে দেখা যাবে এর বেশিরভাগই সারবস্তুহীন এবং সীমাহীন স্তাবকতায় পরিপূর্ণ। অপ্রয়োজনীয় এইসব কপিপেস্ট গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর বিশাল কীর্তিময় জীবন, রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে অনিবার্য করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্যতা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বল্প কয়েকটি বাদ দিলে এইসব গ্রন্থের রচয়িতা, আকস্মিক বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে যথারীতি গা ঢাকা দিয়েছেন এবং পরিস্থিতি অনুকুলে আসার অপেক্ষায় আছেন।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দীর্ঘ ১৫ বছর যেসব গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্ট তাঁদের সত্যমিথ্যা লেখায় শাসক গোষ্ঠীর মনোরঞ্জন করে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা লাভ করেছেন, অযোগ্যতা সত্ত্বেও উচ্চতর পদ দখল করেছেন, বিভিন্ন পুরস্কার ও অনুদান লাভ করেছেন এবং সরকারের অনুগ্রহে গাড়ি বাড়ি প্লটসহ বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাঁরা হঠাৎ করেই উধাও। যেসব স্তাবক লেখক কবি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যের কীর্তিগাথা রচনায় দিস্তা দিস্তা কাগজ অপচয় করেছেন, তাঁরা ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে, যখন ইতিহাসের অবিস্মরণীয় সাক্ষী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনটি ধ্বংস করা হচ্ছে তখন মুখে কুলূপ এঁটে বসে আছেন কেন!
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও আমরা এই একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। আওয়ামী লিগের বাঘা বাঘা নেতা তখন গর্তে ঢুকে পড়েন, সুবিধাভোগী লেখক সাংবাদিকেরা প্রতিবাদে কলম ধরতে সাহস করেননি, সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কতিপয় তরুণ ১৯৭৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে সেই সাহসী সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়!’ এর পরপরই চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় আরও একটি প্রতিবাদী সংকলন। এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার থেকে বঞ্চিত ড. মোহাম্মদ হান্নানের গবেষণা গ্রন্থ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ: প্রথম মিছিল প্রথম সাহিত্য প্রতিক্রিয়া গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, যাঁরা যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে এই লেখাগুলো প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা কেউই শাসকদলের সুবিধাভোগী ছিলেন না এবং পরবর্তী সময়েও কোনো সুযোগ-সুবিধা লাভ করেননি। এমনকি এই সাহসী তরুণদের কেউই আওয়ামী লিগ বা ছাত্রলিগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সহজেই অনুমান করা যায় সারা দেশে শাসকদল ও তাদের লেজুড়বৃত্তিতে নিয়োজিত দাপুটে ছাত্র সংগঠনের বাইরে বিপুলসংখ্যক দেশপ্রেমিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ আছেন, যাঁরা ইতিহাসের নির্মোহ ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করেন।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি যে প্রকৃতপক্ষে কোনও কর্তৃত্ববাদী একনায়কের পিতার বাড়ি নয়, এটি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ, সে সত্যটি সম্ভবত আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের বিভ্রান্তির কারণ দ্বিমুখি। প্রধানত শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও উচ্চতার জায়গা থেকে নামিয়ে এনে তাঁকে আওয়ামী লীগের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি এবং জাতির অবিসংবাদিত নেতা থেকে ব্যক্তিবিশেষের পিতা হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এই আত্মঘাতী অপচেষ্টার সূত্রে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর এবং তাদের উত্তরসূরীরা বিভ্রান্তি ছড়ানোর দ্বিতীয় সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে বিলম্ব করেনি। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার নামে একদল বিভ্রান্ত মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং নিজেদের সামর্থের সঙ্গে তাদের যুক্ত করে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু জাদুঘর এবং স্বাধীনতার সূতিকাগারের ঐতিহাসিক স্মৃতি গুঁড়িয়ে দেওয়া সহজসাধ্য হয়েছে।
তবে একই সঙ্গে এই ঘটনা আদতেই কোনও মবের দ্বারা সংঘটিত কিনা এবং এটি কোনও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার।
দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন এবং অনির্বাচিত হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, রাজস্ব আদায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ রুটিনওয়ার্ক চালিয়ে যাওয়ার মতো একটি কর্মক্ষম সরকার রয়েছে। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগেই বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ৩২ নম্বর জ্বালিয়ে দেওয়া কিংবা শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ধ্বংস করা শেখ হাসিনার কৃতকর্মের ফল। তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যায় সে সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতাকে নিয়ন্ত্রণের মতো কোনও কার্যকর সরকারের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে আরও একটি লক্ষ্য করছি বর্তমানে সরকার থাকলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের বাহিনীগুলির কোনও ভুমিকা নেই। যদি থেকেই থাকে তাহলে একটি বাড়ি, সেই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধার হোক কিংবা রাজাকারের হোক অথবা সাধারণ কোনও মানুষেরই হোক, পূর্ব ঘোষণা দিয়ে তা ধ্বসস্তুপে পরিণত করার সময়ে সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করবে! আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান ছয় মাস আগে তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে জনগণের জানমাল রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দেশ জুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক নানা অপতৎপতরতা দেখে বাধ্য হয়ে বলতে হয়, তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।
নানা সুত্রে জানা যাচ্ছে, মুজিবের বাড়ি ভেঙে ফেলার ঘটনায় পাকিস্তান সেনা বাহিনী খুব খুশি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনন্দ উল্লাস এটাই প্রমাণ করে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি জওয়ান হাঁটু গেড়ে বসে অস্ত্র সমর্পন করে যে পরাজয় মেনে নিয়েছিল ৫৩ বছর পরে হলেও তারা সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।
পাকিস্তানিদের এই বিজয় পরাজিত শক্তির সহযোগী রাজাকার, আলবদর এবং তাদের উত্তরসূরিদের জন্য বিজয়ের আনন্দ বয়ে আনলেও দেশের ১৮ কোটি মানুষ, বিশেষ করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্যে তা কতোলটা খুশির বিষয় তা ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
লেখক: সাহিত্যিক